ইসলামে দাস প্রথা – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মুনীর

ইসলামে দাস প্রথা শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মুনীর এর প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে শেয়ার করতে ভুলবে না।

কাফির-মুশরিকরা ইসলামের যেসব বিষয়ে জোর আপত্তি-অভিযোগ উত্থাপন করে “দাসপ্রথা” তার মধ্যে একটি। একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে টাকার বিনিময়ে ক্রয় করবে এবং তাকে দাস হিসেবে গন্য করবে ব্যাপারটি শোনা মাত্র কিছু লোক হৈ-চৈ করে ওঠে। এই পরিপ্রেক্ষিতে অনেক মুসলিমকে বলতে শোনা যায়, ইসলামে দাসপ্রথা একসময় ছিল কিন্তু এখন সেটা মানসুখ (রহিত) হয়ে গেছে। কেউ আবার বিভিন্নভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন আসলে ইসলামে দাসপ্রথা বলে কখনও কিছু ছিল না। এর কেউই এ বিষয়েটি সম্পর্কে কিছুই জানে না বরং প্রত্যেকে নিজ নিজ খেয়াল খুশি মতো কথা বলে।

সত্য কথা হলো, একটি বিশেষ পরিসরে ইসলামে দাসপ্রথার অনুমতি রয়েছে। তবে সেটি সূদূর অতীতে বা হাল আমলে পৃথিবীর অন্য যে কোনো স্থানে প্রচলিত দাসপ্রথা অপেক্ষা সম্পূর্ণ আলাদা ও অনন্য। মূলত দুটি দিক সম্পর্কে অবহিত হলে ইসলামে দাস প্রথার প্রকৃত স্বরুপ জানা সম্ভব হবে।

ক) কিভাবে একজন ব্যক্তি দাস হিসেবে গন্য হয়?

খ) দাস হওয়ার পর তার সাথে কিরুপ আচরণ করা হয়?

আরব সমাজে রসুলুল্লাহ সাঃ আগমন করার পূর্ব থেকেই দাসপ্রথার প্রচলন ছিল। তারা একে অপরকে দাস বানানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিষিদ্ধ পন্থা-পদ্ধতির অনুসরণ করতো। যেমন, কাউকে চুরি করে বেঁচে দেওয়া বা কোনো অসহায় লোককে একা পেয়ে তাকে বিক্রি করে মূল্য গ্রহণ করা (যেভাবে ইউসুফ আঃ কে কিছু লোক কুয়া থেকে উদ্ধার করে বেচে দিয়েছিল, সুরা ইউসুফ-১৯-২০)

ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে বিক্রয় করে ঋণ পরিশোধ করা, কারণে-অকারণে যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হওয়া এবং যুদ্ধ বন্দিদের দাসে পরিনত করা ইত্যাদি। একজন ব্যক্তিকে দাসে পরিনত করার এই সব পদ্ধতির মধ্যে বেশিরভাগই ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, তিনজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন আমি নিজে অভিযোগ করবো। এরপর তিনি তিনজন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেছেন এদের একজন হলো, “যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করে” (সহীহ্ বুখারী)

এই হাদীসটির মাধ্যমে কাউকে চুরি করে বা অসহায় অবস্থায় কুড়িয়ে পেয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করা বা নিজে দাস হিসেবে গ্রহণ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একইভাবে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে দাসে পরিনত করাও এই হাদীসে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইবনে হাযার আসক্বলানী রঃ ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে দাস হিসেবে বিক্রয় করে ঋণ পরিশোধ করা সংক্রান্ত আলোচনাতে বলেন, “এ বিষয়টি নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যপারে ইজমা সম্পাদিত হয়েছে” (ফাতহুল বারী)

ইসলাম দাসপ্রথার এই সকল পন্থা-পদ্ধতিগুলো নিষিদ্ধ করার পর কেবল দুটি পদ্ধতি অবশিষ্ট রেখেছে যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি দাস হিসেবে গন্য হতে পারে।

ক) দাসীর গর্ভে জন্ম নেওয়া সন্তান জন্মানোর পর দাস হিসেবে গণ্য হওয়া।

খ) যুদ্ধবন্দি নারী-পুরুষ বা শিশুদের দাস হিসেবে গ্রহণ করা, যদি মুসলিমদের খলীফা তাদের দাস-দাসী হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন।

এছাড়া নারী-পুরুষ বা শিশুদের দাস হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে মৌলিক কথা হলো ইসলাম মানুষকে দাস বানানোর জন্য যুদ্ধ করে না বরং কাফির-মুশরিকরা মুসলিমদের উপর আক্রমন করলে আত্নরক্ষার জন্য এবং তারা আক্রমণ না করলেও তাদের ইসলামের দাওয়াত দেওয়া অথবা জিজিয় প্রদান করে ইসলামী রাষ্ট্রের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করার জন্য মুসলিমরা যুদ্ধ বিগ্রহ পরিচালনা করে থাকে। অর্থাৎ মুসলিমরা সাধারনত কাফির-মুশরিকদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে থাকে। অনেক সময় যেসব মুসলিম খলীফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে অথবা মুসলিম হওয়ার পরও কোনো ফরজ দায়িত্ব যেমন নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ইত্যাদি পালন করতে অস্বীকার করে তবে মুসলিমরা খলীফার পক্ষাবলম্বন করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে থাকে। যেমনটি হয়েছিল, আবু বকর রাঃ এর সময় যাকাত অস্বীকারকারীদের সাথে। এক্ষেত্রে জ্ঞাতব্য বিষয় হলো, মুসলিম বিদ্রোহী বা পাপাচারী ব্যক্তিদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলে তাদের মধ্যকার নারী-পুরুষ বা শিশু কাউকে দাস বানানো যাবে না। দাস বানানো হবে কেবল কাফির-মুশরিক যুদ্ধবন্দীদের।

যেসব কাফিররা ইসলাম গ্রহণ করে না এবং ইসলামী রাষ্ট্রের বশ্যতা স্বীকার করে না বরং মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় তাদের মধ্যকার যুদ্ধবাজ পুরুষদের ব্যাপারে মুসলিমরা চারটি সিদ্ধান্তের যে কোনো একটি গ্রহণ করতে পারে,

ক) তাকে হ্যা করা

খ) তাকে দাস হিসেবে গ্রহণ করা

গ) তাকে কিছু মুক্তিপনের বিনিময়ে বা অন্য কোনো মুসলিম বন্দিকে কাফিরদের হাত থেকে মুক্ত করার বিনিময়ে কাফিরদের নিকট ফিরিয়ে দেওয়া।

ঘ) তাকে বিনা মূল্যে ছেড়ে দেওয়া।

রাসুলুল্লাহ সাঃ যুদ্ধে নারী ও শিশুদের হত্যা করার ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন যেহেতু সাধারনত তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে না। তাদের ব্যাপারে বিধান হলো বন্দি হওয়ার সাথে সাথেই শিশুরা মুসলিমদের হাতে বন্দি হওয়ার মাধ্যমে মুসলিমে পরিণত হলে, তাদের ব্যাপারে উপরোক্ত চারটি পদ্ধতির মধ্যে কেবল দুটি পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়। তাদের হয়তো দাস বানানো হবে অথবা মুক্ত ভাবে ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসের সুযোগ কারে দেওয়া হবে। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে হত্যা করা ছাড়া অন্য যে কোন পদ্ধতি অবলম্বন করা যাবে অর্থাৎ তাদের বিনাশর্তে মুক্ত করা যাবে, কাফিরদের নিকট থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ করে বা অন্য কোনো মুসলিমকে মুক্ত করার শর্তে তাদের কাফিরদের হাতে অর্পণ করা যাবে এবং তাদের দাসী বানানো যাবে।

এখন যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে বা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহযোগিতা করেছে বন্দি হওয়ার পর তাদের দাস বানানো হলে সেটা তাদের উপর স্পষ্ট দয়া করা ছাড়া কিছু নয় কেননা সেই ব্যক্তিকে হত্যা করাও বৈধ। যদি তাকে হত্যা ও দাস বানানোর মাঝে যে কোনো একটিকে বাছাই করার সুযোগ দেওয়া হয় তবে সে নিজেও হয়তো নিহত হওয়ার পরিবর্তে দাস হওয়াকেই বেছে নেবে। সুতরাং এই বিষয়টির যৌক্তিকতা নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠতে পারে না।

নারী ও শিশুদের দাস হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে কথা হলো প্রথমেই লক্ষ রাখতে হবে কাফিরদের বিরুদ্ধে মুসলিমরা যুদ্ধ করে কোনো। কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট বর্ণনানুযায়ী এটা প্রমাণিত যে কাফিররা হয়তো মুসলিম হবে অথবা বিণীতভাবে জিজিয়া প্রদানের মাধ্যম ইসলামী রাষ্ট্রের বশ্যতা স্বীকার করবে। তাদের সাথে যুদ্ধ করে এ দুটি বিষয়ের যে কোনো একটি আদায় করে নিতে হবে। কিন্তু যখন তারা আপোসে এটা মেনে না নিয়ে মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে তখন তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের যে কেউ মুসলিমদের হাতে বন্দি হলে মুসলিমরা তাদের আপোসে কাফিরদের নিকট ফিরিয়ে দিতে পারে না।

এর প্রথম ও প্রধান কারণ মুসলিমরা কাফিরদের ইসলামে প্রবেশ করানো বা কমপক্ষে ইসলামী রাষ্ট্রের আইন-কানুনের বশ্যতা স্বীকার করা তথা ইসলামী পরিবেশে বসবাস করে ইসলামের সৌন্দর্য অনুধাবন করার সুযোগ সৃষ্টি করার জন্যই যুদ্ধ করে থাকে। কাফিরদের স্ত্রী ও সন্তানদের হাতের নাগালে পেয়েও তাদের ইসলামী রাষ্ট্রের ইসলামী পরিবেশে না রেখে পুনরায় কুফরীর পঁচা ডোবায় ফিরিয়ে দেওয়া মোটেও যৌক্তিক হতে পারে না।   দ্বিতীয়ত যারা মুসলিমদের সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় রয়েছে, তাদের হত্যা করছে, তাদের সন্তানদের পিতৃহারা ও মায়েদের সন্তানহারা করছে। সুযোগ পেলে মুসলিম নারী ও শিশুদের হত্যা ও মানহানী করছে তাদের কলিজার টুকরো স্ত্রী-সন্তানদের হাতে পাওয়ার পরও বিনা বাধায় ফেরত দেওয়া অর্থ হলো ঐ সকল কাফিরদের দীর্ঘ সময় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো মানসিক অবস্থা সৃষ্টি করে দেওয়া। যেহেতু তারা সর্পূর্ণ নিশ্চিত থাকবে যে, মুসলিমরা আমাদের নারী ও শিশুদের কোনো ক্ষতিই করবে না। ফলে একটা বড় গুরুদায়িত্ব তাদের কাধঁ থেকে নেমে যাবে। শত্রুকে এই ধরনের উদারতা প্রদর্শন নিরেট বোকার পরিচয় ছাড়া কিছু নয়। যারা চিলে কোঠায় বসে সাহিত্য চর্চা করেন এবং কাগজ-কলমে দীগিজয় করেন তারা এসব নীতিবক্য ফলাও করে প্রচার করতে পারেন কিন্তু যুদ্ধের ময়দান সম্পর্কে যার অভিজ্ঞতা আছে সে জানে কিভাবে শত্রুকে মানসিক চাপে রেখে যুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে হয়। তার পক্ষে এমন বোকমী করা সম্ভব নয়।

এছাড়া আরো একটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য। তা হলো, কোনো এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনা করার মাধ্যমে সেটা দখল করার পর কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সেখানকার যুদ্ধবাজ সকল পুরুষকে হত্যা করা হবে বা দাস বানানো হবে। সে ক্ষেত্রে সেখানকার নারী ও শিশুদের দায়িত্বভার কে গ্রহণ করবে?

ইসলামী ভাবধারার সাথে সঙ্গতি রেখে চিন্তা করলে দেখা যাবে কাফিরদের নারী ও শিশুরা বন্দি হওয়ার পর তাদের পুনরায় কুফরীর অন্ধকারে ফিরিয়ে দেওয়া সঠিক নয় বরং তাদের ইসলামী রাষ্ট্রের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় দিতে হবে এটাই সঠিক। কিন্তু এত ব্যাপক সংখ্যক নারী ও শিশুকে ইসলামী রাষ্ট্রে কিভাবে স্থান দেওয়া হবে? তাদের কর্ম সংস্থান কি হবে এবং তাদের দায়িত্বভার কার উপর অর্পণ করা হবে? এই সকল প্রশ্নের সমাধান আধুনা চিন্তাবিদদের নিকট নেই। তারা কেবল কিছু নীতিবাক্য প্রদান করেন। সে নীতিবাক্য যতটাই অবাস্তব হোক তাতে তাদের কোনো যায় আসে না। তারা হয়তো বলবেন এই সকল বন্দিদের মেহমান হিসেবে ইসলামী রাষ্ট্রে রাখতে হবে, অথবা কোনো বন্দি-আশ্রম খুলে সেখানে তাদের বিনি-পয়সায় খাওয়া-পরা দিতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু এভাবে লক্ষ-লক্ষ বেকার মানুষের খোর-পোষের যোগান দিতে দিতে রাষ্ট্রেএক সময় দেউলিয়া হয়ে যাবে সেটা এনাদের দৃষ্টিতে ধরে না। ইসলাম এ ক্ষেত্রে এমন একটি বিধান দিয়েছে যাতে এই সকল লোকেরা একটি রাষ্ট্রীয় বোঝা নয় বরং রাষ্ট্রীয় সম্পদে পরিনত হয়েছে। তাদের খোর-পোষ দেওয়ার জন্য কাউকে বাধ্য করতে হচ্ছে না বরং মানুষ স্বেচ্ছায় আগ্রহভরে তাদের গ্রহণ করছে, তাদের যথাযোগ্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে এবং তাদের এভাবে স্বয়ংক্রিয় পন্থায় তাদের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা হচ্ছে। এই ব্যবস্থাটি হলো কোনো একজন ব্যক্তিকে অন্য আরেকজনের উপর স্থায়ী কর্তৃত্ব দেওয়া। সে তার ভাল-মন্দ দেখা-শোনা করবে এবং তাকে যথাযোগ্য কাজে লাগাবে। তার সাথে সর্বপ্রকারের সদাচারন করবে। এই ব্যক্তি হলো ঐ ব্যক্তির কর্তা বা সায়্যিদ আর এই বিষয়টিকেই বলা হয় দাস প্রথা। দাস অর্থ একজন মানুষকে গরু-ছাগলের মতো চতুস্পদ জন্তু হিসেবে গন্য করা নয় বরং তাকে একজন মানুষের পরিপূর্ণ অধিকার দেওয়া হবে। তবে তার উপর আরেকজনের কর্তৃত্ব দেওয়া হবে যাতে সে তাকে পরিচালিত করে।

আবু জর রাঃ একবার তার এক দাসকে গালি দিলে রসুলুল্লাহ সাঃ তাকে বললেন,

এরা হচ্ছে তোমাদের ভাই। তোমাদের উপর তাদের দায়িত্বভার অর্পিত হয়েছে। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীনস্ত করেছেন। যার অধীনে তার এক ভাই থাকে সে নিজে যা খায় তাকে তাই খাওয়াবে এবং নিজে যা পরিধান করে তাকে তাই পারাবে। তাদের এমন কোনো কাজ দেবে না যা তারা করতে সক্ষম নয় যদি তেমন কোনো কাজ করার প্রয়োজন হয় তবে তাকে সহযোগিতা করবে। (বুখারী ও মুসলিম)

এই হচ্ছে ইসলামের “দাস প্রথা” এই সদাচরণ ও সুবিচারকে যারা নিন্দা করেন তারা যুদ্ধ বন্দিদের ব্যাপারে কি আচরণ করেন সেটা লক্ষ্য করা যেতে পারে। দীর্ঘকাল সংকির্ণ প্রকোষ্ঠে আটকে রেখে নির্যাতন করা, কঠিন কঠিন দায়িত্ব অর্পন করা ও তা সম্পন্ন করতে বাধ্য করা, কারণে-অকারণে শাস্তির সম্মুখীন করা এই হচ্ছে যুদ্ধ-বন্দীদের সাথে তাদের মানবিক আচরণ! যারা এই প্রকার আচরণকেই পছন্দ করে আর ইসলামের দাস প্রথাকে নিন্দা করে তাদের বিকৃত মস্তিস্কের এই চিন্তাধারাকে গুরুত্ব দেওয়ার কোনোই কারণ নেই।

এটা গেল যু্দ্ধ বন্দিদের ব্যাপারে। এখন দাসীর গর্ভে জন্ম নেওয়া সন্তানকে দাসে পরিনত করার ব্যাপারে মূলনীতি হলো,

সন্তান দাসত্বের ব্যাপারে তার মাকে অনুসরণ করবে। (বাদাইউস্ সানায়ি)

অর্থাৎ যদি কোনো দাসী অন্য একজন দাস বা স্বাধীন পুরুষের সাথে বিবাহ করে তবে তার সন্তান দাস হবে কিন্তু যদি কোনো স্বাধীন মহিলা কোনো দাসের সাথে বিবাহ করে তবে তার সন্তান স্বাধীন বলে গন্য হবে।

তবে যদি কোনো ব্যক্তি তার নিজের দাসীকে শয্যাসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করে আর তার গর্ভে সন্তান আসে তবে উক্ত সন্তান এবং ঐ দাসী উভয়ে মুক্ত হয়ে যাবে। এই দাসীকে বলা হয় “উম্মে ওয়ালাদ”

রাসুলুল্লাহ সাঃ এর কোনো একজন দাসীর গর্ভে ইব্রাহীম নামে একটি পুত্র সন্তান হয়। পরবর্তীতে রসুলুল্লাহ সাঃ উক্ত দাসী সম্পর্কে বলেন, “তার সন্তানই তাকে মুক্ত করেছে” (ইবনে মাযা)

এই হাদীসটির সনদ ভীষণ দুর্বল। অন্য একটি রেওয়ায়েতে এসেছে, “উম্মে ওয়ালাদ মুক্ত বলে গন্য হবে” (দারে কুতনী)

রসুলুল্লাহ সাঃ এর কথা হিসেবে এটা দূর্বলভাবে বর্ণিত হয়েছে তবে উমর রাঃ হতে মাওকুফভাবে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। (ইবনে হাযার আল-আসকালানী আত-তালখীসে একথা বলেছেন)

ক) সাধারনত পুরুষরা কর্মক্ষম হয়ে থাকে ফলে মানুষ তাদের ব্যবসা-বানিজ্য, চাষাবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার কাজে-কর্মে লাগতে পারে। এভাবে দাসদের মাধ্যমে মানুষ উপকৃত হতে পারে বিধায় তারা তাদের ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করে। নারীরা হয় এর বিপরীত। তাদের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় না। কিন্তু আমরা দেখেছি যুদ্ধে বন্দিদের একটি বিরাট অংশ হবে নারী ও শিশু যেহেতু বেশিরভাগ পুরুষ হয়তো যুদ্ধে নিহত হবে অথবা তাদের বন্দি করার পর বিভিন্ন অপরাধে হত্যা করা হবে। এই বিপুল সংখ্যক নারীকে যাদের দায়িত্বে অর্পণ করা হবে তারা যদি কোনো ভাবে লাভবান না হতে পারে তবে তাদের দায়িত্বভার কেনো গ্রহণ করবে? এই লাভের একটি অংশ হলো তাদের গর্ভস্থ সন্তানকে নিজের কাজে গালানোর আশা যেটাকে সামনে রেখে মানুষ এই সকল নারীদের দায়ভার গ্রহণ করতে সম্মত হবে।

খ) একজন দাসীকে যখন কেউ নিজের শয্যসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করে এবং নিজে তার উপকার ভোগ করে তখন সন্তান জন্মালে সেটা দাস হিসেবে গন্য হবে না বরং সে সন্তা এবং তার মা উভয়ে মুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু অনেক সময় একজন ব্যক্তির অধীনে বহু সংখ্যক দাসী থাকতে পারে যাদের সবাইকে সে নিজের জন্য গ্রহণ করতে সক্ষম নয় বা সেটা তার ইচ্ছা নয়। এ অবস্থায় এ সকল নারীদের অন্যত্র বিবাহ দেওয়া একান্ত জরুরী যেহেতু তারাও মানুষ এবং স্বাভাবিক মানবিক চাহিদা তাদেরও আছে। কিন্তু অন্যত্র বিবাহ দেওয়া হলে উক্ত দাসীর মালিক দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির শিকার হবে। যেহেতু ঐ দাসী তার স্বামীর সহচর্যে থাকবে এবং তাদের সন্তান জন্মালে সে তার লালন-পালনে ব্যস্ত থাকবে। তার স্বামী তাকে তালাক না দেওয়া পর্যন্ত ঐ দাসীর মালিক তাকে ফেরত নিতে পারবে না। এমনও হতে পারে যে, হয়তো উক্ত দাসীটি একবার বিবাহ হওয়ার পর চিরকালের জন্য তার মনিবের আর কোনো উপকারেই আসবে না। এই ক্ষতির বিনিময়ে যদি উক্ত দাসীর মালিকের কোনো লাভ না থাকে তবে সে এতবড় ক্ষতি স্বীকার করে দাসীটিকে অন্যত্র বিবাহ দেবে না বা দিতে রাজি হবে না এটাই স্বাভাবিক। এভাবে ঐ সকল নারীদের স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত করা হবে। একারণে উক্ত দাসীর সন্তানকে তার মনিবের কর্তৃত্বের অধীন করা হয়েছে যাতে সে তাকে পরবর্তীতে নিজের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারে এবং এই আশাকে সামনে রেখে তার বিবাহের পথে বাধা হয়ে না দাড়ায় বরং নিজ আগ্রহে তার বিবাহের ব্যবস্থা করে।

এটা হলো, জন্মসূত্রে দাস হিসেবে পরিগনিত হওয়ার ব্যাখ্যা। এখন যে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে দাসে পরিনত করে আমরা পূর্বেই বলেছি, তার সম্পর্কে আলেমদের মাঝে দ্বিমত রয়েছে। যদি ধরেও নিই এটা বৈধ তবু বলতে হয় যে নিজেই নিজেকে দাসে পরিনত করতে সম্মত হয় তার ব্যাপারে আমাদের কি বলার আছে?

এখানে আরেকটি প্রশ্ন অনেকের মনে সৃষ্টি হতে পারে যে, বিবাহ না করেই দাসীদের শয্যাসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করা কিভাবে বৈধ হতে পারে? এ বিষয়ে সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। কেউ কেউ দাসী বলতে মনে করে কাজের মেয়ে। তারা বিষয়টিকে অবাস্তব মনে করে। কিন্তু দাসী বলতে সাধারন কাজের মেয়ে বোঝায়না বরং  ঐ সকল নারীদের বোঝায় যারা কাফির অবস্থায় যুদ্ধে বন্দি হয় এবং খলীফা তাদের একেক জনকে একেক জন মুসলিমের দায়িত্বে অর্পন করেন। এ কর্তৃত্ব স্থায়ী। কোনো দাসী তার মনিবের ইচ্ছার বাইরে তার সঙ্গ পরিত্যাগ করতে সক্ষম নয়। এভাবে কোনো নারী নিজের কর্তৃত্বাধীন হলে তাকে নিজের জন্য গ্রহণ করাও বৈধ অন্যত্র বিবাহ প্রদান করাও বৈধ। নিজের জন্য গ্রহণ করা হলে তাকে অন্যত্র বিবাহ দেওয়া বৈধ হবে না এবং অন্যত্র বিবাহ দিলে নিজের জন্য গ্রহণ করা যাবে না। সুতরাং নিজের স্থায়ী অধীকার ও কর্তৃত্বে থাকা দাসীর সাথে সহবাস করা আর নিজের বিবাহিত স্ত্রীর সাথে সহবাস করা একই বিষয়। এর মধ্যে কোনোটি চত্রিহীনতা বলে গণ্য নয়। বড় কথা হলো, বিবাহকে যিনি বৈধ করেছেন নিজের অধীকারে থাকা নারীদের সাথে সহবাস করাও তিনিই বৈধ করেছেন। এর মধ্যে একটিকে আরেকটি অপেক্ষা ভিন্ন মনে করার কোনো সুযোগ নেই।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, যারা নিজের স্ত্রী বা দাসীদের সাথে সহবাস করে তারা নিন্দিত নয়। (সুরা মুমিনুন-৬)

উপরোক্ত আলোচনায় একজন ব্যক্তি কিভাবে দাসে পরিনত হতে পারে এবং দাসে পরিনত হওয়ার পর ইসলাম তার সাথে কি ধরণের আচরণ করার নির্দেশ দেয় সে বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে চিন্তা করলে দেখা যাবে বিষয়টি শক্ত ভিত্তির ‍উপর প্রতিষ্ঠিত। যারা এসব বিষয়ের উপর আপত্তি-অভিযোগ উত্থাপণ করেন তারা ভীষণভাবে অজ্ঞ। একদিকে তারা যেমন ইসলামে দাস প্রথার স্বরুপ সম্পর্কে জানে না। বিপরীত দিকে তারা বর্তমানে সভ্যতার দাবীদাররা যুদ্ধ-বন্দীদের সাথে কিরুপ আচরণ করে সেটাও লক্ষ্য করে না। এই সকল পক্ষপাতদুষ্ট একপেশে গবেষকদের মতামতের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা মোটেও সঙ্গত নয়।

ইসলামে দাস প্রথা শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর এর প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে আপনার বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করতে ভুলবেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *