তাগুত শব্দের সঠিক অর্থ – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর

তাগুত শব্দের সঠিক অর্থ – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর এর তাওহীদ আরমান গ্রন্থের তাওহীদের সাথে সম্পৃক্ত কিছু শব্দের অর্থ নামক প্রবন্ধ থেকে নেয়া হয়েছে তাগুত শব্দের সঠিক অর্থ জানুন এবং আপনার বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করুন

“ তাগুত ” শব্দটি “তুগইয়ান” মাসদার হতে উদগত যার অর্থ সীমা অতিক্রম করা। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে এবং রাসুলুল্লাহ সাঃ এর বিভিন্ন হাদীসে তাগুত শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে কেউ তাগুতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে সে শক্ত হাতল ধরে। (সুরা বাকারা-২৫৬)

অন্য আয়াতে এসেছে, তারা তো তাগুতের নিকট বিচারপ্রার্থী হতে চায় অথচ তাদের তাগুতকে অস্বীকার করতেই বলা হয়েছিল। (নিসা-৬০)

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, আমি প্রতিটি উম্মতের নিকট রসুল প্রেরণ করেছি এই উদ্দেশ্যে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুতকে পরিত্যাগ করো। (সুরা নাহল-৩৬)

রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, “তোমরা তোমাদের পূর্বপূরুষের নামে এবং তাগুতের নামে কসম করো না। (সহীহ মুসলিম)

সহীহ মুসলিমের অন্য একটি রেওয়ায়েতে এসেছে, কিয়ামতের দিন বলা হবে, “যে যার ইবাদত করতো সে তার সাথে চলে যাও” এর ফলে যে যার ইবাদত করতো সে তাকে অনুসরন করবে। সেখানে বলা হয়েছে, “যারা তাগুতের ইবাদত করতো তারা তাগুতকে অনুসরণ করবে” (সহীহ মুসলিম)

তাগুতের অর্থ সম্পর্কে তাফসীরে বিভিন্ন ব্যাখ্যা এসেছে। এ বিষয়ে ওলামায়ে কিরাম যেসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ উল্লেখ করেছেন তা দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।

১. তাগুত হলো বাতিল উপাস্যসমূহ, আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করা হয়।

ইবনে কাছির রঃ বলেন, ইমাম মালিক বলেছেন, আল্লাহ্ ছাড়া যা কিছুর ইবাদত করা হয় তাই তাগুত।

ইমাম কুরতুবী তার তাফসীরেও ইমাম মালিক হতে অনুরুপ বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। এই অর্থে বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে তাগুতের ব্যাখ্যায় মূর্তি উল্লেখ করা হয়েছে।

২। তাগুত হলো, মানুষকে আল্লাহর দ্বীন হতে বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট করার ব্যাপারে ভূমিকা রাখে এমন নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি। এই অর্থে যারা কোনো বাতিল উপাস্যের ইবাদতের দিকে আহ্বান করে বা যে কোনো প্রকার শিরক-কুফর ও পথভ্রষ্টতার প্রচার-প্রসার করে তারা সকলে তাগুত বলে গণ্য হবে। এ হিসেবে শয়তান, জাদুকর, গনক, পথভ্রষ্ট শাসক, নীতিভ্রষ্ট বিচারক ইত্যাদি সকল শ্রেণীর লোককে তাগুত বলা যায়।

ইমাম বাইদাবী রঃ তাগুতের অর্থ সম্পর্কে বলেন, শয়তান, মূর্তি বা আল্লাহ ছাড়া যা কিছুর ইবাদত করা হয় অথবা যারা আল্লাহর ইবাদত থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখে। (তাফসীরে বাইদাবী)

অন্য স্থানে তিনি বলেন, “তাগুত শব্দটি প্রতিটি ভ্রান্ত বিষয়ের উপর প্রয়োগ করা হয় তা উপাস্য হোক আর যাই হোক”।

শা’বী আতা এবং মুজহিদ থেকে বর্ণিত আছে, তারা বলেন, তাগুত হলো, শয়তান, গনক এবং বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতার ব্যাপারে নেতৃত্বস্থানীয় ব্যাক্তি। (লিসানুল আরব)

এই অর্থে কা’ব ইবনে আশরাফকেও তাগুত বলা হয়েছে। যেহেতু সে ইয়াহুদীদের মধ্যে নেতৃত্বস্থানীয় ছিল এবং মানুষকে আল্লাহর দ্বীন থেকে ফিরিয়ে রাখার ব্যাপারে তার ব্যাপক ভূমিকা ছিল। সে মানুষের মাঝে বিভিন্ন সমস্যায় বিচারক হিসেবেও ভূমিকা রাখতো।

ইমাম কুরতুবী ইকরিমা থেকে বর্ণনা করেন, তাগুত হলো কা’ব ইবনে আশরাফ। এর প্রমাণ হলো, আল্লাহর বাণী, “তারা তো তাগুতের নিকট বিচার প্রার্থী হতে চায়”। (তাফসীরে কুরতুবী)

ইবনে আব্বাস রাঃ থেকেও অনুরুপ বর্ণনা আছে। (লিসানুল আরব)

উপরোক্ত বিশ্লেষণের আলোকে বলা যায়, তাগুত শব্দটি মূলত দুটি অর্থে ব্যাবহৃত হয়। আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করা হয় ঐ সকল বাতিল উপাস্যসমূহ এবং পথভ্রষ্টতা ও বিভ্রান্তির দিকে আহ্বান করে এমন নেতা নেত্রীবর্গ।

যদি প্রথম অর্থে তাগুত শদ্বটি প্রয়োগ করা হয় তবে আল্লাহর পরিবর্তে মানুষ, জ্বিন, মূর্তি ইত্যাদি যা কিছুর ইবাদত করা হয় তাই তাগুত হিসেবে গণ্য হবে। তবে তাগুত শদ্বটি এমন কারো ব্যাপারে প্রয়োগ করা যাবে না যাদের সম্মান করতে শারয়ীভাবে আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেমন, ঐ সকল নবী-রাসুল বা নেককার ব্যক্তিরা যাদের মৃত্যুর পর কিছু নির্বোধ লোক তাদের ইবাদত করা শুরু করেছে। না তারা এর নির্দেশ দিয়েছেন আর না তারা এব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। মোট কথা, শারয়ী দৃষ্টিকোন থেকে সম্মানিত ও মর্যাদাবান ব্যাক্তি বা বিষয়ের উদ্দেশ্যে ‘তাগুত’ শদ্বটি প্রয়োগ করা যাবে না। এছাড়া অন্য যে কোনো বাতিল উপাস্যের ব্যাপারে তাগুত শদ্ব প্রয়োগ করা যাবে তা জড় বা জীব যাই হোক না কেনো।

আর যদি দ্বিতীয় অর্থে তাগুত শব্দটি প্রয়োগ করা হয় তবে, যে কোনো প্রকার পথভ্রষ্টতা ও বিভ্রান্তির প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে নিয়োজিত ও নিবেদিত যে কাউকে তাগুত নামে আখ্যায়িত করা যায়। এ অর্থে শয়তান, গনক, জাদুকর, মানব রচিত আইন রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করে এমন শাসক বা এই সকল আইনে বিচার-ফয়সালা করে এমন বিচারক ইত্যাদি সকল শ্রেণীর উপর তাগুত শব্দ প্রয়োগ করা যায়। ‘তাগুত’ শব্দটির প্রয়োগ সম্পর্কে জেনে নেওয়ার পর প্রশ্ন হলো, সকল তাগুতই কি কাফির? এ বিষয়ের উত্তরে আমরা পূর্বের কথারই পুনরাবৃত্তি করবো। আর তা হলো, ‘তাগুত’ শব্দটি যত অর্থে প্রযোজ্য হয় প্রতিটি ক্ষেত্রে শিরক-কুফর বা কাফির-মুশরিক বিধান জারী করা সম্ভব নয়। বরং পূর্বে বর্ণিত মূলনীতিটির আলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করে না। উদাহরণ স্বরুপ  যে মূর্তিকে ইবাদত করা হয় তাকে তাগুত বলা হয়েছে কিন্তু মূর্তিকে কাফির বা মুশরিক বলা হবে। উক্ত মূর্তির ইবাদতের দিকে যে আহ্বান করে তাকে তাগুত বলা হবে কাফির বা মুশরিকও বলা হবে, যেহেতু শিরক-কুফরের দিকে আহ্বান করাও কুফরী যেমনটি আমরা পূর্বে বলেছি। একইভাবে জাদুকর, গনককে তাগুত বলা হয়েছে কিন্তু সকল প্রকার জাদুকর ও গনককে কাফির বলা যায় না। বরং যে জাদুকর কুফরী কালামের মাধ্যমে জাদু করে এবং যে গনক সকল বিষয়ে গায়েব জানার দাবী করে তারা কাফির হবে। আর যেসব জাদুকর ও গনকের মধ্যে কোনো কুফরী পাওয়া যায় না তারা কাফির হবে না। পথভ্রষ্টতা ও বিভ্রান্তিতে নেতৃত্বস্থানীয় ব্যাক্তিরা বা মানব রচিত আইনের প্রতিষ্ঠাতা ও সেগুলোর মাধ্যমে যারা বিচার করে তাদের তাগুত হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় তবে তারা ঢালাওভাবে কাফিরে পরিনত হবে না। বরং দেখতে হবে তারা মানবরচিত আইনকে উত্তম ও বৈধ আইন মনে করে কিনা। এই সকল বিবেচনা স্বাপেক্ষেই এসব ব্যাক্তিদের উপর শিরক-কুফরের বিধান প্রয়োগ করা যায়। কারো ব্যাপারে ‘তাগুত’ শব্দ প্রয়োগ করা হলেই তাকে কাফির হিসেবে ঘোষণা করা সঠিক কর্মপন্থা নয়।

তাগুত শব্দের সঠিক অর্থ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *