আল্লাহ কোথায় অবস্থান করছেন – আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহ্ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা

আল্লাহ কোথায় অবস্থান করছেন – আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহ্ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা #শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনির এর গবেষণা মূলক প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে আপনাদের বন্ধুদের নিকট শেয়ার করুন।

ইবনুল জাওজী রঃ বলেন, ঐ সকল লোকদের এসব মুর্খতাসূলভ কথা-বার্তা কত নিকৃষ্ট যারা বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসের বহ্যিক অর্থের উপর নির্ভর করে যেভাবে খৃষ্টানরা ঈসা আঃ এর ব্যাপারে করেছিল। (ঈসা আঃ কে রুপক অর্থে আল্লাহর রুহ্ বলা হয়) তারা বলেছিল ঈসা আঃ বাস্তবেই আল্লাহর রুহ (প্রাণ)। (অর্থাৎ তিনিই আল্লাহ)। (কাশফুল মুশকিল)

তিনি খুব উত্তম কথা বলেছেন। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের প্রকাশ্য অর্থ গ্রহণ করার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার বিভ্রান্তির জন্ম হয়েছে। যার বেশ কিছু প্রমাণ আমরা পূর্বের পোষ্ট সমূহে উল্লেখ করেছি। আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কিত বিভ্রান্তি এ বিষয়ে আরেকটি উদাহরণ। একদল লোক দাবী করেছে আল্লাহ সব জায়গায় আছেন। তারা নিজেদের পক্ষে বেশ কিছু দলিল-প্রমাণ পেশ করেছে। যেমন,

তিনিই আল্লাহ, আকাশে ও পৃথিবীতে আছেন। তিনি জানেন তোমরা কি গোপন করো আর কি প্রকাশ করো। (সুরা আনয়াম-০৩)

আল্লাহ পূর্ব পশ্চিমের মালিক। তোমরা যেদিকেই মুখ ফিরাও সেদিকে তার চেহারা রয়েছে। তিনি সর্বব্যাপী মহাজ্ঞানী। (সুরা বাকারাহ-১১৫)

তিনি তোমাদের সাথে আছেন তোমরা সেখানেই থাকো না কেনো। তিনি তোমাদের কার্যাবলী পর্য্‌বেক্ষণ করছেন। (সুরা হাদীদ-০৪)

রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, যখন তোমাদের কেউ সলাত আদায় করে সে যেনো তার সামনের দিকে থুথু নিক্ষেপ না করে কেননা যে সলাত আদায় করে আল্লাহ তার সামনের দিকে থাকেন। (বুখারী ও মুসলিম)

এই সকল আয়াত ও হাদীসের প্রকাশ্য অর্থের উপর নির্ভর করে একদল লোক আল্লাহ তায়ালার আকাশ ও পৃথিবীর সর্বত্র বিরাজমান এমন দাবী করে।

আর অন্য একদল বলেছে তিনি আকাশে আছেন। তারা নিজেদের পক্ষে বেশ কিছু আয়াত ও হাদীস ব্যবহার করে। যেমন,

তোমরা কি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেলে যে যিনি আকাশে আছেন (আল্লাহ) তোমাদের পায়ের নিচের মাটি ধসিয়ে দিতে পারেন। (সুরা মুলক-১৬)

ফিরআউন বলল, হে হামান আমার জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণ করো যাতে আমি আকাশে উঠতে সক্ষম হই এবং মুসার ইলাহকে দেখতে পারি। (সুরা মুমিন-৩৬,৩৭)

তারা বলে, মুসা আঃ দাবী করেছিলেন যে তার রব আকাশে আছেন সেকারণে ফিরআউন তামাশার ছলে বলেছিল তবে আকাশে উঠে আমি দেখবো সেখানে কোনো রব আছে কিনা।

রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,

পৃথিবীবাসীর প্রতি তোমরা দয়া প্রদর্শন করো যিনি আকাশে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করবেন। (আবৃ দাউদ, তিরমিযী বলেছেন, হাসান সহীহ)

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে, রসুলুল্লাহ সাঃ একটি দাসীকে প্রশ্ন করেন, “আল্লাহ কোথায়?” সে বলে, “আকাশে”। এরপর তিনি বলেন, “আমি কে?” সে বলে, “আপনি আল্লাহর রাসুল”। একারণে রসুলুল্লাহ সাঃ স্বাক্ষ্য দেন যে, উক্ত দাসীটি ঈমানদার।

এই সকল দলিল-প্রমাণের বহ্যিক অর্থের উপর নির্ভর করে একদল লোক বলে আল্লাহ্ আকাশে আছেন। এই সকল আয়াত ও হাদীসের প্রকাশ্য অর্থের উপর নির্ভর করে উপরে যে দুটি মত বর্ণনা করা হয়েছে উভয় মতই ভ্রান্ত ও অগ্রহণযোগ্য। আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের ওলামায়ে কিরামের নিকট সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত আক্বীদা হলো, আকাশ ও পৃথিবী উভয়ই আল্লাহর সৃষ্টি। আর আল্লাহ তার সৃষ্টির অভ্যন্তরে অবস্থান করা হতে পবিত্র। তিনি স্বত্ত্বাগতভাবে সকল সৃষ্টি হতে বিচ্ছিন্ন। তবে তিনি তার জ্ঞান ও নিয়ন্ত্রণের দিক থেকে প্রতিটি সৃষ্টির সাথে আছেন। তাই বলা হয়েছে, “তোমরা যেখানেই থাকে না কেনো তিনি তোমাদের সাথে আছেন” অর্থাৎ তোমরা কি করছো বা কি করছো না সে সম্পর্কে তিনি খবর রাখেন। এমন নয় যে, তিনি প্রকৃতই সকলেন সাথে এবং সর্বস্থানে অবস্থান করছেন। এ আক্বীদাটি হিন্দুদের সর্বেশ্বরবাদ এবং ওয়াদাতুল উজুদ মতালম্বী একদল তাসাউফপন্থীর বিভ্রান্ত মস্তিস্কের সৃষ্টি। যেহেতু আল্লাহ বলেন, (আর-রাহমান আরশের উপর আছেন। (সুরা তহা-৫)

এই আয়াত উল্লেখের পর ইবনে আব্দিল বার রঃ বলেন, এটা মু’তাযিলা ও জাহামিয়্যাদের বিপক্ষে দলিল যারা বলে আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান। (আত-তামহীদ) অন্য একস্থানে তিনি এ মতটিকে জাহামিয়্যা ও মু’তাজিলাদের মুর্খতাসূলভ মত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

ইমাম আজ-জাহাবী রঃ আল-উলু নামক কিতাবে ইমাম আবু ইউসুফ রঃ থেকে বর্ণনা করেন তার নিকট এমন কিছু ব্যক্তিকে হাজির করা হলো যারা বলতো “আল্লাহ্ সর্বত্র বিরাজমান” তিনি তাদের কাউকে কয়েদ করেন আর কিছু লোককে প্রহার করেন এবং তাদের নিয়ে মানুষের মাঝে প্রদক্ষিন করেন।

আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের সাথে থাকা সম্পর্কিত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্দুল বার রঃ আরো বলেন, বিজ্ঞ সাহাবা ও তাবেইনরা, যাদের নিকট হতে আমরা আল্লাহর দ্বীনের জ্ঞান পেয়েছি তারা এই সকল আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আল্লাহ আরশের উপর আছেন কিন্তু তার জ্ঞান সর্বত্র বিরাজমান। গ্রহণযোগ্য কেউই এই মতের বিপরীত মত পোষণ করেনি। (আত-তামহীদ)

অর্থাৎ এই ব্যাখ্যার উপর উম্মতে মুসলিমার ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ইমাম আজ-জাহাবী তার আল-উলু নামক কিতাবে বিভিন্ন ওলামায়ে কিরাম থেকে অনুরুপ কথা বর্ণনা করেছেন যারা বলেছেন, আল্লাহ্ আরশের উপর আছেন কিন্তু তার জ্ঞান ও ক্ষমতা সর্বত্র বিরাজমান। একইভাবে তিনি আকাশে আছেন একথার অর্থ তিনি আকাশে অবস্থান করছেন এমন নয় বরং এর অর্থ তিনি সমস্ত সৃষ্টির উর্দ্ধে আছেন। এখানে হয়তো সামা বা আকাম অর্থ উর্দ্ধে বা উপরে বুঝাতে হবে সেক্ষেত্রে অর্থ হবে তিনি উপরে আছেন। অথবা ফি বা ‘এ’ বলতে আলা বা উপরে বুঝতে হবে। সেক্ষেত্রে অর্থ হবে, তিনি আকাশের উপরে আছেন।

ইমাম নাব্বী রঃ বলেন, কাজি ইয়াদ রঃ বলেছেন, ফুকাহা, মুহাদ্দিস, কালামশাস্ত্রবিদ, গবেষক ও মুকাল্লিদ ইত্যাদি সর্বশ্রেণীর মুসলিমরা এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত করেন নি যে, যেসব দলিল প্রমাণে বাহ্যিকভাবে আল্লাহ আকাশে আছেন এমন বলা হয়েছে যেমন আল্লাহর বাণী, “যিনি আকাশে আছেন তোমরা কি তার ব্যাপারে নির্ভয় হয়ে গেছো যে তিনি হয়তো তোমাদের নিয়ে মাটি ধসিয়ে দেবেন?” এই সকল আয়াতের প্রকাশ্য অর্থ উদ্দেশ্য নয় বরং তারা সকলে এটার কোনো না কোনো ব্যাখ্যার উল্লেখ করেছেন। এদের মধ্যে যারা কোনো প্রকার সীমা ও প্রকৃতি নির্ধারন ব্যাতিরেখে সাধারনভাবে আল্লাহ উপরে আছেন এমনটি বলেছেন তারা বলেছেন এখানে আকাশে আছেন বলতে আকাশের উপরে বোঝানো হয়েছে। অধিকতর সতর্কতা অবলম্বনকারী অন্যান্য গবেষক ও কালামশাস্ত্রবিদ বলেছেন, আল্লাহ কোনো দিকে আছে আমরা এমন বলবো না। (শারহে মুসলিম)

মোট কথা উম্মতে মুসলিমার সর্বশ্রেনীর ওলাময়ে কিরাম এ বিষয়ে একমত যে, আল্লাহ আকাশে অবস্থান করছেন এটা সঠিক আক্বীদা নয় তবে তাদের মধ্যে একদল বলেছেন আমরা বলবো তিনি উপরের দিকে আছেন অন্য আরেকদল বলেছেন আমরা আল্লাহর ব্যাপারে দিক শব্দ প্রয়োগ করবো না।

ইবনে তাইমিয়া রঃ বলেন, যে বলে আল্লাহ আকাশে আছেন আসলে সেটার উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ উপরে আছেন এবং সকল সৃষ্টির উর্দ্ধে আছেন। (মাজমুউল ফাতাই)

তিনি আরো বলেন, যে মনে করে এই আয়াতের অর্থ; আল্লাহ আকাশের অভ্যন্তরে আছেন তবে সে সর্বসম্মতিক্রমে মুর্খ ও পথভ্রষ্ট বলে গণ্য হবে। (মাজমুউল ফাতাই)

ইমাম কুরতুবী রঃ এ বিষয়ে সুন্দর আলোচনা করেছেন। “আকাশে যিনি আছেন তোমরা কি তার ব্যাপারে নির্ভয় হয়ে গেছো?” এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, বিজ্ঞ ওলামায়ে কিরাম বলেছেন আকাশের উপরে যিনি আছেন তোমরা কি তার ব্যাপারে নির্ভীক হয়ে গেছো? (এখানে অভ্যন্তরে বলতে উপরে বোঝানো হয়েছে) যেমন অন্য আয়াতে বলা হয়েছে পৃথিবীর অভ্যন্তরে ভ্রমণ করো অর্থাৎ পৃথিবীর ‍উপরে। এর অর্থ আল্লাহ আকাশের উপরে আছেন, আকাশকে স্পর্শ করে বা আকাশে অবস্থান গ্রহণ করে নয় কর্তৃত্ব ও পরিচালনার দিক থেকে এটা বলা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি আকাশের পরিচালক ও মালিক। যেমন বলা হয় অমুক ইরাকের উপর (দায়িত্ব প্রাপ্ত) বা হিযাজের উপর (দায়িত্বপ্রাপ্ত) অর্থাৎ সে ইরাক বা হিযাজের উপর কর্তৃত্বশীল এবং সেখানকার আমীর। আল্লাহ উপরে থাকার ব্যাপারে প্রচুর দলিল-প্রমাণ রয়েছে যা কেবল একজন বেদ্বীন ছাড়া কেউ অস্বীকার করতে পারে না। এই উচ্চতার উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহকে সম্মান প্রদর্শন করা এবং তাকে যাবতীয় হীন ও নিচ বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত ঘোষণা করা। এখানে অবস্থান বা দিক ইত্যাদি সীমা-পরিসীমা উদ্দেশ্য নয় কেননা তা সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য। (তাফসীরে কুরতুবী)

এরপর তিনি বলেন, এর কারণ তিনি স্থান সৃষ্টি করেছেন অতএব তিনি স্থানের মুখাপেক্ষী নন। সকল কিছু সৃষ্টি করার পূর্বে কোনো স্থান বা সময় ছিল না তখনও আল্লাহ ছিলেন। তার তখন স্থান ও সময়ের প্রয়োজন হয়নি। তিনি তখন যেভাবে ছিলেন এখনও সেভাবেই আছেন। (তাফসীরে কুরতুবী)

ইমাম কুরতুবীর এই বিশ্লেষণটি খুবই চমৎকার। আল্লাহ উপরে আছেন। এর অর্থ যদি দিক বা অবস্থান ধরা হয় তবে তাতে স্পষ্ট বৈপরিত্ব সৃষ্টি হয়। যেহেতু উপর বিষয়টিই একটি আপেক্ষিক বিষয়। আমরা জানি পৃথিবী ফুটবলের মতো বৃত্তাকার। একটি ফুটবলের উপর কয়েকটি পিপড়া যেভাবে হাটাহাটি করে আমরাও সেভাবে পৃথিবীপৃষ্ঠে চলাফেরা করি এবং বসবাস করি। পৃথিবীর চারিপাশ ঘিরে বিভিন্ন একালা ও দেশে মানুষ বসবাস করি। পৃথিবীর চারিপাশ ঘিরে বিভিন্ন এলাকা ও দেশে মানুষ বসবাস করে। প্রত্যেকে নিজের মাথার উপর আকাশ দেখতে পায়। যেহেতু পৃথিবীকে ঘিরে যে শূন্যস্থান তাকেই আকাশ বলা হয়। এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অধিবাসীদের নিকট উপর বলতে বিভিন্ন দিক বোঝাবে, একই দিক নয়। এমনও হতে পারে যে, এক দেশের লোক উপর বলতে যে দিকে ইঙ্গিত করছে অন্য দেশের লোকেরা উপর বলতে ঠিক তার বিপরীত দিকে ইঙ্গিত করছে। তাই দু দেশের লোকের নিকট উপরের দিক বিভিন্ন দিকে হবে। যারা ভূগোল সম্পর্কে অবগত আছেন তারা সহজেই আমার কথা বুঝতে সক্ষম হবেন। তবু বোঝার সুবিধার জন্য আমরা একটি চিত্রের মাধ্যমে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করবো। নিচের চিত্রে আমরা একটি বৃত্ত দেখতে পাচ্ছি। মনে করি এটি পৃথিবী। এই গোলাকার পৃথিবীর উপরিভাগের তীরচিহৃগুলিকে এক এক একটি মানুষ হিসেবে কল্পণা করি। যারা পৃথিবীপৃষ্ঠে দাড়িয়ে আছেন। পৃথিবীর চারিপাশের শূন্যস্থানকেই মূলত আকাশ বলা হয়। প্রতিটি তীর চিহৃ যেদিকে ইঙ্গিত করছে ‍উক্ত স্থান থেকে সেটিই হলো উপরের দিক এবং সেদিকে আকাশ। সে হিসেবে ‘এ’ বিন্দুতে অবস্থিত ব্যক্তি উপর বলতে যেদিকে ইঙ্গিত করে ‘বি’ বিন্দুতে অবস্থিত ব্যক্তি ঠিক তার বিপরীত দিকে ইঙ্গিত করে।

আল্লাহ কোথায় অবস্থান করছেন

এখন যদি আমরা আল্লাহ্ উপরে আছেন বলতে প্রকৃত অর্থেই তিনি উপরের দিকে অবস্থান করেন এমন বুঝি তবে তাতে পৃথিবীর একেকটি অবস্থান স্বাপেক্ষে তার অবস্থান পরিবর্তীত হয়। আর আল্লাহর শানে এটা সম্ভব নয়।

ইমাম কুরতুবী রঃ বলেন, পূর্ববর্তী প্রায় সকল আলেমরা এবং পরবর্তী নেতৃস্থানীয় ওলামায়ে কিরামের নিকট গ্রহণযোগ্য মত হলো আল্লাহ্ তায়ালার ব্যাপারে দিক শব্দ প্রয়োগ না করা। তাদের নিকট আল্লাহর উপরে থাকার বিষয়টি দিক হিসেবে নয়। কেননা যদি বলা হয় তিনি একটি নির্দিষ্ট দিকে আছেন তবে এর অর্থ দাড়ায় তিনি কোনো স্থানে এবং কোনো একটি সীমায় অবস্থান করছেন। আর কোনো স্থান ও সীমায় অবস্থান করার কথা বলা হলে স্থীর থাকা বা নড়াচড়া করার বিষয়টি এসে যায়। আর এগুলো সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য। কালাম শাস্ত্রবিদ ওলামায়ে কিরামের এটিই মত।

এরপর তিনি বলেন, সালফে সালেহীনরা আল্লাহর ব্যাপারে নির্দিষ্ট দিক অস্বীকার করেন নি আবার আল্লাহর ব্যাপারে সেটা উল্লেখও করেননি। বরং আল্লাহর কিতাবে যেভাবে এসেছে এবং তার রসুলগণ সেভাবে খবর দিয়েছেন তারা সকলে সেভাবেই বলতেন। তারা কেউই আল্লাহ প্রকৃত অর্থেই আরশের উপর আছেন এ ব্যাপারটি অস্বীকার করেন নি। (তাফসীরে কুরতুবী)

অর্থাৎ সালফে সালেহীনদের পন্থা ছিল দিক বা অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করা বরং আল্লাহ তার কিতাবে যেভাবে বলেছেন সেভাবে স্বীকার করে নেওয়া এবং নিরব থাকা। যেমনটি আমরা পূর্বে বহু বার বলেছি। তবে কেউ কেউ দিক ও অবস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাখ্যার অবতারণা করেছেন। যারা এসব ব্যাখ্যার অবতারণা করেছেন তাদের বেশিরভাগ আল্লাহর ব্যাপারে দিক ও অবস্থান ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগের বিপক্ষে। কেউ কেউ অবশ্য আল্লাহ্ আরশের উপরে আছেন এই হিসেবে তার অবস্থান উপরের দিকে এমন মন্তব্য করেছেন। তাদের ব্যাপারে অবাক হয়ে কাজি ইয়াদ রঃ বলেন, “আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়া” এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, এসব আয়াত সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ না করা উচিৎ। অথচ তাদের কেউ কেউ আল্লাহ একটি নির্দিষ্ট দিকে আছেন এমন কথা বলেছেন।

এরপর তিনি বলেন, নির্দিষ্ট দিকের কথা বলাই কি ব্যাখ্যা প্রদান করা নয়! বরং শরীয়ত যেসব শব্দ প্রয়োগ করেছেন সেগুলো প্রয়োগ করা যেমন তিনি বলেছেন, “আল্লাহ তার বান্দাদের উপর পরাক্রমশালী”, এবং “তিনি আরশের উপর” ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগ করা এবং সেই সাথে স্বাভাবিক বুদ্ধির মাধ্যমে এবং আল্লাহর বাণী “তার মতো কিছুই নেই” এর মাধ্যমে যে বিষয় প্রমাণিত হয়েছে তাতে বিশ্বাস করাই বেশি নিরাপদ আল্লাহ যার মঙ্গল চান তার জন্য। (শারহে মুসলিম)

অর্থাৎ কাজি ইয়াদ রঃ আল্লাহ সম্পর্কে দিক বা অবস্থান ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগ করার চেয়ে সালফে সালেহীনদের ব্যাখ্যা প্রদান ছাড়াই নিরব থাকার পন্থাটি অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন। আল্লাহ আরশের উপরে আছেন এ কথাটি স্বীকার করে নিতে হবে এবং চুপ থাকতে হবে। দিক বা অবস্থান ইত্যাদি কোনো বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হবে না।

অতএব এখানে দুটি পন্থার যে কোন একটি অবলম্বন করতে হবে। হয়তো আমরা সাধারনভাবে বলবো আল্লাহ উপরে আছেন কিন্তু কিভাবে আছেন তা বলবো না। কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করবো না দিক বা অবস্থান আছে বা নেই ইত্যাদি কোনো শব্দ তার উপর প্রয়োগ করবো না। এটাই ছিল সালফে সালেহীনদের পথ। আর যদি কোনো ব্যাখ্যা করতেই হয় তবে বলবো দিক বা অবস্থান হিসেবে নয় বরং আল্লাহর সুউচ্চ সম্মান বোঝাতে এবং তিনি সৃষ্টির উর্দ্ধে আছেন এটা বোঝাতে এখানে উপরে বলা হয়েছে। যারা ব্যাখ্যা করেছেন তাদের বেশিরভাগ এমন ব্যাখ্যা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালা স্বত্ত্বাগতভাবে সৃষ্টি হতে বিচ্ছিন্ন এবং সকল সৃষ্টির উর্দ্ধে, সৃষ্টির কোনো কিছু তার মধ্যে নয় তিনিও সৃষ্টির কোনো কিছুর মধ্যে নন এই আক্বীদাটি পূর্বতর্তী ও পরবর্তী সমস্ত ওলামায়ে কিরামের ইজমার মাধ্যমে প্রমাণিত একটি অকাট্য আক্বীদা। আল্লাহ তায়ালা উর্দ্ধে বলতে তারা মূলত এটাই বোঝাতেন যে, তার সত্ত্বা সৃষ্টির সংস্পর্শ থেকে বহু দূরে। তবে তার জ্ঞান ও নিয়ন্ত্রন প্রতিটি সৃষ্টিকে ঘিরে আছে। তারা এ বিষয়টি অত্যাধিক গুরুত্বসহকারে বর্ণনা করেছেন যাতে মূর্তিপূজারীরা তাদের মূর্তির মধ্যে আল্লাহর উপস্থিতির দাবী করতে না পারে। একইভাবে যাতে কেউ খৃষ্টানদের মতো আল-হুলুল তথা মানুষের মধ্যে আল্লাহর অবতীর্ণ হওয়া বা কিছু তাসাউফপন্থীর মতো ফানা ফিল্লাহ্ তথা আল্লাহর সঙ্গে কোনো বান্দা মিশে যাওয়ার দাবী করতে না পারে।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া রঃ বলেন, পূর্ববর্তী ইমামগণ বলেন, আল্লাহ তার আরশের উপর আছেন সমস্ত সৃষ্টি হতে তিনি সত্ত্বাগতভাবে বিচ্ছিন্ন আছেন। যেমনটি কুরআন সুন্নাহ্ ও পূর্ববর্তীদের ইজমার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। অন্যস্থানে তিনি বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, তিনি আকাশের উর্দ্ধে আরশের উপর আছেন। তিনি সৃষ্টি থেকে স্বত্ত্বাগতভাবে বিচ্ছিন্ন আছেন। তার সৃষ্টির মধ্যে তার স্বত্ত্বার কোনো কিছু নেই এবং তার স্বত্ত্বার মধ্যে তার সৃষ্টির কিছু নেই। (মাজমুয়ায়ে ফাতাওয়া)

ইমাম আজ-জাহাবী রঃ তার আল-উলু নামক কিতাবে বিশটিরও বেশি পূর্ববর্তী বরেণ্য আলেম হতে এ মত বর্ণনা করেছেন। সেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, আল্লাহ তার সৃষ্টি স্বত্ত্বাগতভাবে বিছিন্ন। তিনি সৃষ্টির সাথে মিশ্রিত হন না এবং সৃষ্টি তার সাথে মিশ্রিত হয় না। সৃষ্টির কোনো কিছুর সাথে তার স্বত্ত্বার কোনো কিছু স্পর্শ করে বা সংযুক্ত হয়ে নেই। তবে তার জ্ঞান ও নিয়ন্ত্রণ সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত আছে। বিভিন্ন শব্দের মাধ্যমে ওলামায়ে কিরাম এই মতবাদটি তুলে ধরেছেন। যা ইমাম আজ-জাহাবী তার গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।

আল্লাহ স্বত্ত্বাগতভাবে তার সৃষ্টির সংস্পর্ষ ও সংযোগ থেকে মুক্ত। আহলুস্ সুন্নাহ্ ওয়াল জামায়াতের ওলামায়ে কিরামের সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত এই আক্বীদাটি স্পষ্টভাবে অন্য আরেকটি আক্বীদা প্রমাণ করে আর তা হলো, আল্লাহ কোনো স্থানে অবস্থিত নহেন। কারণ স্থান আল্লাহর সৃষ্টি আর তিনি সত্ত্বাগতভাবে তার সৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত বা সংযুক্ত নন। অর্থাৎ তিনি কোনো স্থানে অবস্থিত নন।

উপরের আলোচনার সারমর্ম হলো, আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে ওলামায়ে কিরাম তিনটি বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছেন,

১। আল্লাহ্ সর্বত্র বিরাজমান নন।

২। তিনি আকাশের অভ্যান্তরে অবস্থিত নন।

৩। তিনি সৃষ্টির সংস্পর্ষ ও সংযোগ থেকে মুক্ত।

তিনটি বিষয়ই মূলত একটি কথায় প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তার সৃষ্টির মধ্যে নন এবং তার সৃষ্টি তার সাথে সংযুক্ত নয় বরং তিনি আরশের উপরে আছেন। এই আক্বীদাটি যে মনে প্রাণে গ্রহণ করে। সে এ বিষয়ে সঠিক পথ প্রাপ্ত হয়। এরপর যদি সে অন্য কোনো ব্যাখ্যা প্রদান না করে বরং চুপ থাকে তবে তাকে নিন্দা করা হবে না। যেহেতু চুপ থাকাই সালফে সালেহীনদের পথ। আর যদি কেউ ব্যাখ্যা দিয়ে বলে আল্লাহ্ উর্দ্ধে আছেন এটা দিক বা অবস্থান বোঝায় না বরং সম্মান ও সৃষ্টির সাথে বিচ্ছিন্নতা বোঝায় তবে তাকে জাহামিয়্যা আখ্যায়িত করে তিরস্কার করা যাবে না। কারণ এধরনের ব্যাখ্যা বহু সংখ্যক আলেম থেকে বর্ণিত আছে যারা জাহামিয়্যা ছিলেন না। আর পূর্বে আমরা এ ব্যাখ্যার যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছি। একইভাবে যদি কেউ বলে আল্লাহ তার সৃষ্টির মধ্যে অবস্থিত বা সৃষ্টির সাথে সংযুক্ত নন কিন্তু তিনি আরশের উপরে এটা বোঝানোর জন্য “আল্লাহর অবস্থান উপরের দিকে” এভাবে মন্তব্য করে অর্থাৎ এ অর্থে আল্লাহর ব্যাপারে দিক ও স্থান শব্দদুটি প্রয়োগ করে তাকেও মুজাসসিমা বলা হবে না। কারণ এর মাধ্যমে সে আসলে সৃষ্টির সাথে আল্লাহর সাদৃশ্য প্রমাণ করছে না। তাছাড়া আহুলুস সুন্নাহ্ ওয়াল জামায়াতের ওলামায়ে কিরামের কেউ কেউ এমন কথা বলেছেন যেমনটি আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। মোট কথা, ওলামায়ে কিরামের ঐক্যমতের মাধ্যমে প্রমাণিত মৌলিক বিষয়াবলী স্বীকার করে নেওয়ার পর এধরনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে সামান্য দ্বিমত হলেই কাউকে বিদয়াতী বলে হৈ-হট্টোগোল করা উচিৎ নয় বরং মুসলিমদের উচিৎ যতদূর সম্ভব সদ্ভাব বজায় রেখে চলা।

আল্লাহ কোথায় অবস্থান করছেন – আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহ্ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা #শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনির এর গবেষণা মূলক প্রবন্ধ পড়া শেষ হলে শেয়ার করুন। একই সাথে আল্লাহ কোথায় অবস্থান করছেন প্রবন্ধটি সম্পর্কে আপনার মতামত কমেন্ট করুন।

tag: আল্লাহ কোথায় অবস্থান করছেন আল্লাহ কোথায় অবস্থান করছেন আল্লাহ কোথায় অবস্থান করছেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *