হাকীকত ও মাযাজ – কোরআন হাদীস বোঝার ক্ষেত্রে ত্রূটি বিচ্যুতি – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর
হাকীকত ও মাযাজ – কোরআন হাদীস বোঝার ক্ষেত্রে ত্রূটি বিচ্যুতি – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর এর মাজহাব বনাম আহলে হাদীস গ্রন্থ হতে হুবহু সংকলিত
হাকীকত (حقیقة ) বলতে বোঝায় প্রকৃত অর্থ আর মাযাজ (مجاز) বলতে বোঝায় রুপক অর্থ। ভাষা ব্যাবহারের সময় কখনও কোনো শব্দকে তার প্রকৃত অর্থে ব্যবহার না করে রুপক অর্থে ব্যবহার করা হয়। যেমন স্বামী যদি স্ত্রীকে চাঁদ বলে তবে সেটা আকাশের চাঁদ বোঝায় না। একইভাবে যুদ্ধবাজ বীরকে সিংহ বললে বনের সিংহ বোঝায় না। এসবই ভাষার রুপক ব্যবহার। কোরআন ও হাদীসে বহু শব্দকে রুপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন,
ফজরের সাদা সুতা কালো সুতা হতে পৃথক না হওয়া পর্যন্ত তোমরা পানাহার করতে থাকো। (সুরা বাকারা-১৮৭)
আয়াতে রমজান মাসে সাহরী খাওয়ার শেষ সময় বর্ণনা করা হচ্ছে। কিছু কিছু সাহাবী রাঃ এই আয়াতে সুতা (خیط) শব্দটিকে প্রকৃত অর্থে গ্রহণ করেছিলেন তারা বালিশের নিচে সাদা ও কালো দুটি সুতা রেখে লক্ষ করতেন কখন একটিকে আরেকটি হতে চেনা যায়। আদী ইবনে হাতীম রাঃ এমনটি করার পর সকালে রসুলুল্লাহ সাঃ এর নিকট এসে বললেন,
হে আল্লাহর রসুল আমি আমার বালিশের নিচে দুটি সুতা রেখেছিলাম।
রসুলুল্লাহ সাঃ শুনে বললেন, যদি তুমি (আকাশের) সাদা সুতা আর কালো সুতাকে বালিশের নিচে রেখে থাকো তবে তো তোমার বালিশ অনেক প্রশস্ত। (সহীহ বুখারী)
মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, তোমার বালিশ দেখছি খুবই প্রশস্ত! ওটা তো রাতের আধার আর দিনের আলো। (সহীহু মুসলিম)
অর্থাৎ আয়াতে সুতা শব্দটি প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত হয়নি বরং দিগন্তের সাদা ও কালো রশ্মিকে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু কিছু সাহাবা রাঃ শব্দটিকে প্রকৃত অর্থে নেওয়ার কারণে ভুল বুঝেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, এখানে নাপাক বলতে একজন মুশরিক কুকুর ও শুকরের মতো নাপাক এমন বোঝানো হয়নি। বরং বোঝানো হয়েছে তার আকীদা চিন্তা দর্শন ইত্যাদি নাপাক। এ কারণে কোনো মুশরিকের ঘাম, চোখের পানি ইত্যাদি শরীরে লাগলে সে স্থান ধৌত করার প্রয়োজন নেই।
যে আয়াতে মুমিনকে হত্যা করলে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে প্রবেশ করার কথা উল্লেখ আছে সেখানে চিরস্থায়ী বা খুলুদ (خلود ) শব্দটি তার প্রকৃত অর্থ প্রকাশ করছে না। ইমাম বায়দাবী আয়াতটির বিভিন্ন ব্যাখ্যা উল্লেখ করার সময় বলেন, এমন হতে পারে যে এখানে চিরস্থায়ী বলতে লম্বা সময় বোঝানো হয়েছে। (তাফসীরে বায়দাবী)
খন্দকের যুদ্ধের পর রসুলুল্লাহ সাঃ বানু কুরাইজার উপর আক্রমন করার ইচ্ছা করলেন। তিনি সাহাবায়ে কিরামের উদ্দেশ্যে বললেন, কেউ যেনো বনু কুরাইজাতে না পৌছে আসরের সলাত না পড়ে। রসুলুল্লাহ সাঃ এর পক্ষ হতে এটা ছিল স্পষ্ট নির্দেশ। সাহাবায়ে কিরাম রাঃ দ্রুত বানু কুরাইজার দিকে রওয়ানা হলেন। বানু কুরাইজাতে পৌছানোর পূর্বেই আসরের সময় শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হলে উপস্থিত সাহাবায়ে কিরাম নিজেদের মধ্যে বিতর্তে জড়িয়ে পড়েন।
তাদের মধ্যে কেউ কেউ বললেন আমরা বানু কুরাইজাতে না পৌছে সলাত আদায় করবো না অন্য দল বললেন আমরা এখানেই সলাত আদায় করে নেবো রসুলুল্লাহ সাঃ এটা উদ্দেশ্য করেন নি। (সহীহ বুখারী)
অন্যান্য বর্ণনাতে এসেছে প্রথম দলটি বললো, রসুলুল্লাহ সাঃ আমাদের উপর স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন যেনো আমরা বানু কুরাইজায় না পৌছে আসরের সলাত আদায় না করি। অতএব এরা রসুলুল্লাহ সাঃ সূর্য ডুবে যাওয়ার পর আসরের সলাত আদায় করে(তিবরানী)। দ্বিতীয় দলটি বলেছিল রসুলুল্লাহ সাঃ এর উদ্দেশ্য এটা ছিল না যে তোমরা সলাত ত্যাগ করো (মুস্তাদরাকে হাকিম) বরং তিনি চেয়েছিলেন তোমরা দ্রুত যাও। ইমাম বুখারীর বর্ণনায় এসেছে,
রসুলুল্লাহ সাঃ এর নিকট এই খবর পৌছানো হলে তিনি কাউকেই তিরষ্কার করেননি। (সহীহ বুখারী)
এখানে দেখা যাচ্ছে রসুলুল্লাহ সাঃ এর স্পষ্ট নির্দেশ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তার অর্থ নিয়ে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কথাটির প্রকৃত অর্থের উপর আমল করেছেন আর কেউ এটার প্রকৃত অর্থ উদ্দেশ্য মনে করেন নি। তারা মনে করেছেন বানু কুরাইজায় না যেয়ে আসরের সলাত পড়ো না এই কথার মাধ্যমে উদ্দেশ্য হলো দ্রুত যাও যাতে আসরের সময় শেষ হওয়ার আগেই বানু কুরাইজাতে পৌছাতে পারো। উভয় দল নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে গবেষণা করে যা সঠিক মনে হয়েছে তার উপর আমল করেছেন সেকারণে রসুলুল্লাহ সাঃ কাউকেই তিরষ্কার করেননি। ভাষার প্রয়োগবিধি সম্পর্কে যাদের জ্ঞান নেই তারা এই ধরণের মতপার্থক্যক্যে অর্থহীন মনে করবে এটাই স্বাভাবিক। অতএব কোরআন হাদীস সঠিকভাবে বুঝতে হলে ভাষার প্রয়োগ ও ব্যবহারের নিয়মনীতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
পূর্বে আমরা যেসব হাদীস উল্লেখ করেছি তার মধ্যে যে হাদীসে আত্মহত্যাকারী জাহান্নামের চির চিরস্থায়ীভাবে শাস্তি পেতে থাকবে বলা হয়েছে সেটার ক্ষেত্রে একই কথা।
রসুলুল্লাহ সাঃ যেসব হাদীসে বংশ তুলে গালি দেওয়া, মৃতের জন্য বিলাপ করা, অন্যকে পিতা বলে পরিচয় দেওয়া ইত্যাদি কাজকে কুফরী হিসাবে গণ্য করেছেন। বা এসবে লিপ্ত হলে জান্নাত তার উপর হারাম এমন বলেছেন। ঐসব হাদীসে কুফরী বলতে ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় এমন কুফরী বোঝানো হয়নি। জান্নাত হারাম বলতেও সে কখনও জান্নাতে প্রবেশ করবে না এমন বোঝানো হয়নি। তাগলীজ বা অধিক কঠোরতার জন্যই এভাবে বলা হয়েছে।
এসকল ব্যাপারই হাকীকত মাযাজ বা প্রকৃত অর্থ ও রুপক অর্থের সাথে সংশ্লিষ্ট। যদি কেউ এই মূলনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে কোরআনের বহু আয়াত ও রসুলুল্লাহ সাঃ এর বহু হাদীসের সঠিক অর্থ জানা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। ইমাম সুয়ূতী বলেন,
যদি কোরআনের রুপক বলে কিছু না থাকতো তবে তার অর্ধেক সৌন্দর্য বিলীন হদয়ে যেতো। (আলইতকান)