আল-আমর ওয়ান-নাহী বা আদেশ-নিষেধ – কোরআন হাদিস বোঝার ক্ষেত্রে এই ধরনের ত্রুটি বিচ্যুতিতে পতিত হওয়ার কারন সমূহ

আল-আমর ওয়ান-নাহী বা আদেশ-নিষেধ – কোরআন হাদিস বোঝার ক্ষেত্রে এই ধরনের ত্রুটি বিচ্যুতিতে পতিত হওয়ার কারন সমূহ – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর

আরবীতে আদেশ দেওয়ার জন্য যে শব্দ ব্যাবহার করা হয় তাকে আমর বলে। আমরের সীগা সাধারণত কোনো কিছু ফরজ বোঝাতে ব্যবাহার করা হয়। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন,

সলাত কায়েম করো, যাকাত দাও। (সূরা বাকারা-৪৩)

কিন্তু সব সময় আদেশ দেওয়ার মাধ্যমে ফরজ ও ওয়াজিব বোঝায় না। আদেশ প্রদানের মাধ্যমে বিভিন্ন অর্থ বোঝানো হয়।

ক। ফরজ বা ওয়াজিব বোঝানো যেমনটি আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি।

খ। ফরজ বা ওয়াজিব নয় বরং করলে ভাল না করলে সমস্যা নেই তথা মুস্তাহাব বোঝানোর জন্য । যেমন আল্লাহর বাণী,

যখন তোমরা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাকিতে লেনদেন করো তখন তা লিখে রাখো। (সূরা বাকারাহ-২৮২) এখানে যে লিখে রাখার আদেশ দেওয়া হয়েছে তা বাধ্যতামূলক নয় বরং তা উত্তম যদি কেউ কোনো কারনে না লিখে রাখে তবে তাতে পাপী হবে না।

রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, যে কেউ ওযু করে সে নাকে পানি দিয়ে তা ঝেড়ে ফেলুক। (বুখারী ও মুসলিম) এই হাদীস হতে কেউ কেউ বলেছেন ওযুতে নাকে পানি দিয়ে ঝেড়ে ফেলা ফরজ কিন্তু জমহুর আলেমের মতে এটা সুন্নাত। অর্থাৎ তারা এখানে আদেশের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক বোঝেননি।

গ। কখনও কখনও আদেশ প্রদানের মাধ্যমে ফরজ বা মুস্তাহাব কিছুই বোঝানো হয় না শুধু মাত্র কাজটির বৈধ হওয়া নির্দেশ করে। যেমন, আল্লাহর বাণী, যখন সলাত সম্পন্ন হয় তখন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর নেয়ামত তালাশ করো। (সূরা জুমআ-১০)

যখন তোমরা হজ্জের ইহরাম ভেঙ্গে ফেল তখন শিকার করো। (সূরা মায়েদা-২)

একবার সাহাবারা ইহরাম ভেঙ্গে ফেললে রসুলুল্লাহ সাঃ তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা স্ত্রীর সাথে মিলিত হও।

ইমাম বুখারী জাবির রাঃ হতে উল্লেখ করেছেন যে, রসুলুল্লাহ সাঃ এর এই আদেশ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, (এই আদেশের মাধ্যমে) বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়নি বরং পুরুষদের জন্য স্ত্রীদের বৈধ করা হয়েছে। (সহীহ্ বুখারী)

এরকম বহু আয়াত রয়েছে যেখানে কোনো কাজ আদেশের ভঙ্গিতে বলা হয়েছে অথচ সেটা বাধ্যতামূলক বা মুস্তাহাব কিছুই নয়। সেটা করলে কোনো পুরষ্কারের আশাও নেই বরং সেটা কেবল মাত্র বৈধ বা মুবাহ পর্যায়ের।

ঘ। কখনও কখনও সীগাতুল আমর বা আদেশ প্রদানের শব্দ সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে ব্যাবহার করা হয়। যেমন আল্লাহর বাণী, তোমরা যা খুশি আমল করো তিনি তোমরা যা কিছু করো তা দেখেন। (হামিম আস সাজদা-৪০) এই আয়াতে আদেশের মাধ্যমে উপরের তিনটি অর্থের কোনোটিই উদ্দেশ্য নয়। কেননা এখানে যা খুশি আমল করার আদেশ দেওয়া হচ্ছে না বা যা খুশি আমল করা বৈধও বলা হচ্ছে না।

রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, যদি তোমার লজ্জা না থাকে তবে যা খুশি তাই করতে পারো। (সহীহ বুখারী)

হাদীসে যার লজ্জা নেই সব কিছু করা বৈধ এমন উদ্দেশ্য নয় বরং তাকে তিরষ্কার করা উদ্দেশ্য।

অন্য একটি হাদীসে এসেছে দুজন লোক অন্য একজনের গীবত করলে রসুলুল্লাহ সাঃ তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা নেমে গিয়ে এই মৃত গাধার মাংস হতে আহার করো।

তারা দুজন অবাক হয়ে বলল, হে আল্লাহর নবী, এটা আবার কেউ খায় নাকি?

রসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, তোমরা একটু পূর্বে তোমাদের এক ভাই সম্পর্কে যা কিছু বলেছো তা এটা খাওয়া অপেক্ষা নিকৃষ্ট (আবু দাউদ)

এই হাদীসেও এটা খাও বলতে উক্ত গাধার মাংস খাওয়া মাধ্যতামূলক, মুস্তাহাব বা বৈধ ইত্যাদি কোনো অর্থই উদ্দেশ্য নয় বরং গীবতের ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য এভাবে বলা হয়েছে।

ঙ। অনেক সময় সম্মানিত কোনো ব্যক্তি অধিনস্তদের প্রতি দয়া পরবশ বা অন্যদের মাঝে তার সম্মান অক্ষুণ্য রাখার জন্য কোনো আদেশ করে থাকেন সে ক্ষেত্রে উক্ত আদেশ অমান্য করা অপরাধ বলে গণ্য হয় না।

রসুলুল্লাহ সাঃ একবার অনুপস্থিত থাকলে আবু বকর রাঃ লোকদের নিয়ে সলাত আদায় করতে শুরু করেন। তাদের সলাত শুরু হওয়ার পর রসুলুল্লাহ সাঃ হাজির হলে আবু বকর রাঃ পিছনে ফিরে আসতে শুরু করেন। রসুলুল্লাহ সাঃ তাকে হাত দ্বারা ইশারা করে যথা স্থানে থাকতে আদেশ করেন তবু আবু বকর রাঃ পিছনে ফিরে আসেন। রসুলুল্লাহ সাঃ সলাত আদায় করার পর তাকে প্রশ্ন করলেন, হে আবু বকর আমি তোমাকে আদেশ করার পরও তুমি কেনো স্থীর থাকলে না? (বুখারী ও মুসলিম)

আবু বকর রাঃ বললেন, আপনি হাজির থাকার পরও আবু কুহাফার ছেলের জন্য ইমাম হয়ে সালাত আদায় করাটা শোভা পায় না।

এই হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম আন নাব্বী রঃ বলেন, এতে দলীল রয়েছে যে যদি কোনো অনুসারীকে তার অনুসরণীয় ব্যাক্তি কোনো কাজের আদেশ করে আর উক্ত ব্যাক্তি বুঝতে পারে এই আদেশের মাধ্যমে উক্ত কাজটি বাধ্যতামূলক করা উদ্দেশ্য নয় বরং তাকে মর্যাদা দেওয়া উদ্দেশ্য তবে সে এই নির্দেশ পরিত্যাগ করতে পারে এটা অবাধ্যতা বলে গণ্য হবে না বরং আদব, বিনম্রতা ও ভাষা বোঝার দক্ষতা বলে পরিগনিত হবে। (শারহে মুসলিম)

সীগাতুন নাহী বা নিষেধাজ্ঞাসূচক শব্দ সীগাতুল আমর বা আদেশ সূচক শব্দের মতো বিভিন্ন অর্থে ব্যাবহৃত হয়।

ক। কোনো কিছু নিষিদ্ধ বা হারাম সাব্যস্ত করার জন্য। যেমন তোমরা জিনার নিকটবর্তী হয়োনা, সুদ খেয়োনা ইত্যাদি।

খ। হারাম নয় বরং মাকরুহ বোঝানোর জন্য। উম্মে আতীয়্যা বলেন, আমাদের (মেয়েদের) (মৃতদেহের) পিছু নিতে নিষেধ করা হয়েছে তবে এটা হারাম করা হয়নি। (সহীহ বুখারী)

অর্থাৎ অনেক সময় কোনো কিছু হতে নিষেধ করা হয় কিন্তু এর মাধ্যমে হারাম করা উদ্দেশ্য হয়না তবে উক্ত কাজটি পরিত্যাগ করা উত্তম এমন উদ্দেশ্য হয়।

গ। অনেক সময় কোনো কাজ করলে নিষেধ করা হয় অথচ তার মাধ্যমে কাজটি হারাম বা মাকরুহ উদ্দেশ্য নয় বরং কাজটি বৈধ। রসুলুল্লাহ সাঃ আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আসকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তুমি সাত দিনে কোরান খতম করো এর অধিক করো না। (সহীহ বুখারী)

কোনো কোনো হাদীসে তিন দিনের কথা বর্ণিত আছে। এ বিষয়ে আলেমদের মতমত হলো কোরানের অর্থে বা তিলাওয়াতে কোনোরুপ অস্পষ্টাতা সৃষ্টি না করে যত কম সময়ে পারা যায় তেলাওয়াত করতে দোষ নেই। ইবনে হাযার রঃ বলেন, পূর্ববর্তী বহুসংখক ওলামায়ে কিরাম হতে বর্ণিত আছে যে তারা তিন দিনের কমে কোরআন খতম দিয়েছেন। (ফাতহুল বারী)

এরপর তিনি বলেন, ইমাম নাব্বী বলেন সঠিক কথা হলো ব্যক্তি ভেদে এটা বিভিন্ন রকম হতে পারে।

এরপর ইমাম নাব্বী বিভিন্ন ব্যক্তির জন্য বিভিন্ন রকম অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন গবেষকের উচিত যতটুকু সম্ভব চিন্তা গবেষণা করে পাঠ করা। অন্যান্য দ্বীনী কাজে লিপ্ত ব্যাক্তির উচিৎ উক্ত কাজের ক্ষতি না করে যতটুকু সম্ভব তিলাওয়াত করা। আর সাধারণ লোকেরা তাড়াহুড়া না করে এবং নিজেকে ক্লান্ত না করে যত বেশি পারে পাঠ করতে পারে।

কিছু লোক আছে কোনো ইমাম বা মুজতাহিদ তিন দিনের কমে কোরআন তিলওয়াত করেছেন এমন কথা শুনলেই বলে ওঠেন উক্ত ইমাম পাপ কাজে লিপ্ত হয়েছেন কারণ রসুলুল্লাহ সাঃ তিন দিনের কমে কোরআন তিলাওয়াত করতে নিশেধ করেছেন। নিশেধ করা হলেই যে হারাম বোঝায় না এ বিষয়ে পুরোপুরি অজ্ঞ থাকার কারণেই এরা এমন কথা বলে থাকে।

ঘ। অনেক সময় সীগাতুল আমরের মতো সীগাতুন নাহীও সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। নুহ আঃ তার সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা আমাকে ধ্বংস করার জন্য চেষ্টা করো আর আমাকে কোনো অবকাশ দিয়োনা। (ইউনুস-৭১)

এখানে অবকাশ দিয়োনা। এই কথার মাধ্যমে আসলে অবকাশ দিতে নিষেধ করা হচ্ছে না বরং এখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে সীগাতুন নাহী ব্যাবহার করা হয়েছে।

ঙ। অনেক সময় অধিনস্তদের উপর সহজ করার উদ্দেশ্যে বা অন্য কোনো কারণে কোনো কাজ হতে তাদের নিষেধ করা হয়। উক্ত নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা অপরাধ বলে গণ্য হয় না। যেমন রসুলুল্লাহ সাঃ সাহাবায়ে কিরামের উদ্দেশ্যে বললেন, (তোমরা সওমে বিসাল করো না।)

কোনোরুপ পানাহার না করে একাধারে কয়েকদিন সওম পালন করাকে সওমে বিসাল বলা হয়। রসুলুল্লাহ সাঃ কে এমন সওম পালন করতে দেখে সাহাবায়ে কিরামও তা করতে শুরু করলে রসুলুল্লাহ সাঃ তাদের সওমে বিসাল করতে নিষেধ করেন। হাদীসের পরবর্তী অংশে এসেছে, কিন্তু তারা সওমে বিসাল পরিত্যাগ করলো না। (সহীহ বুখারী) অর্থাৎ রসুলুল্লাহ সাঃ নিষেধ করার পরও সাহাবায়ে কিরাম রাঃ সওমে বিসাল থেকে বিরত হলেন না। এর ব্যাখ্যায় হাযার রঃ বলেন, সওমে বিসাল যে রাখা বৈধ এ ব্যাপারে দলীল হলো রসুলুল্লাহ সাঃ এর আদেশের পরও সাহাবায়ে কিরাম রাঃ এটা হতে বিরত হননি। এতে বোঝা যায় তারা এখানে নিষেধাজ্ঞা হতে হারাম বোঝেননি বরং ভিন্ন অর্থ বুঝেছেন। (ফাতহুল বারী)

আল-আমর ওয়ান-নাহী বা আদেশ-নিষেধ আল-আমর ওয়ান-নাহী বা আদেশ-নিষেধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *