হযরত তালহা ইবন ওবায়দুল্লাহ (রা.) এর জীবনী। bd islamic site

ওহুদ যুদ্ধে হযরত তালহার ভূমিকার কারণে রাসূল (সা.) বলেছিলেন, ‘কেউ যদি কোন মৃত ব্যক্তিকে দুনিয়ায় হেঁটে বেড়াতে আনন্দ পেতে চায়, সে যেনো তালহা ইবন ওবায়দুল্লাহকে দেখে’।
তাঁর নাম তালহা। ডাক নাম আবূ মুহাম্মদ তালহা ও আবূ মুহাম্মদ ফাইয়াজ। আব্বার নাম ওবায়দুল্লাহ এবং মা’র নাম সোবাহ বা সা’বা। তালহার বংশগত সম্পর্ক সপ্তম পুরুষ গিয়ে রাসূল (সা.)-এর বংশ লতিকার সাথে মিলিত হয়েছে। অপর দিকে তাঁর মা সোবাহ (রা.) প্রখ্যাত সাহাবী আলী ইবনুল হাদরামীর (রা.) বোন ছিলেন।
রাসূল (সা.)-এর নবুয়াত প্রাপ্তির প্রথম দিকেই তালহা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র পনেরো বছর। হযরত তালহা (রা.)-এর ইসলাম গ্রহণ ছিলো একটি চমকপ্রদ ঘটনা। ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে ঐ কিশোর বয়সেই অন্যান্য আরব ব্যবসায়ীর সাথে তালহা (রা.) ব্যবসায়িক কাজে বসরা যান। তাদের বাণিজ্য কাফেলা বসরা শহরে পৌঁছানোর পর সবাই কেনা-বেচার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এরই এক পর্যায়ে তালহা (রা.) অন্যান্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তিনি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বাজারে ঘোরাফেরার সময়ে এমন একটি ঘোষণা শুনলেন যা তাঁর জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিলো। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি তখন বসরার বাজারে। একজন খ্রিস্টান পাদ্রীকে ঘোষণা করতে শুনলাম ‘ওহে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। আপনারা এ বাজারে আগত লোকদের জিজ্ঞেস করুন, তাদের মধ্যে মক্কাবাসী কোন লোক আছে কিনা’। আমি নিকটেই ছিলাম। দ্রুত তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি মক্কার লোক’। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে আহমদ কি আত্মপ্রকাশ করেছেন?’ বললাম, ‘কোন আহমদ?’ বললেন, ‘আবদুল্লাহ ইবন আবদিল মুত্তালিবের পুত্র। যে মাসে তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন, এটা সেই মাস। তিনি হবেন শেষ নবী। মক্কায় আত্মপ্রকাশ করে কালো পাথর ও খেজুর উদ্যান বিশিষ্ট ভূমির দিকে হিজরত করবেন। যুবক, খুব তাড়াতাড়ি তোমার ‘তাঁর কাছে যাওয়া উচিত’। এরপর তালহা (রা.) বলেন, তাঁর এ কথা আমার অন্তরে দারুণ প্রভাব বিস্তার করলো। আমি আমার কাফেলা ফেলে রেখে বাহনে সওয়ার হলাম। বাড়িতে পৌঁছেই পরিবারের লোকদের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, আমার যাওয়ার পর মক্কায় নতুন কিছু কি ঘটেছে? তারা বললো, ‘হ্যাঁ, মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ (সা.) নিজেকে নবী বলে দাবী করছেন এবং আবূ কুহাফার ছেলে আবূ বকর তাঁর অনুসারী হয়েছেন’।
তিনি আরো বলেন, ‘আমি আবূ বকরের (রা.) কাছে গেলাম এবং তাকে জিজ্ঞেস করলাম- এ কথা কি সত্যি যে, মুহাম্মদ নবুয়াত দাবী করেছেন এবং আপনি তাঁর অনুসারী হয়েছেন?’ তিনি বললেন হ্যাঁ, তারপর আমাকেও ইসলামের দাওয়াত দিলেন। আমি তখন তাঁর কাছে খ্রিস্টান পাদরীর সব কথা খুলে বললাম। অতঃপর তিনি আমাকে রাসূল (সা.)-এর কাছে নিয়ে গেলেন। আমি সেখানে কলেমা শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করলাম এবং নবী (সা.)-এর কাছে পাদরীর সব কথা বললাম। তিনি শুনে খুব খুশি হলেন। এভাবে আমি হলাম হযরত আবূ বকর (রা.)-এর হাতে চতুর্থ ইসলাম গ্রহণকারী।
হযরত তালহা (রা.)-এর আব্বা ওবাইদুল্লাহ রাসূল (সা.)-এর নবুওয়াত লাভের পূর্বেই ইন্তেকাল করেন। তবে তাঁর মা সোবাহ ইসলাম গ্রহণ করেন এবং দীর্ঘজীবী হন। একটা ঘটনা থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। হযরত ওসমান (রা.) যখন বিদ্রোহীদের দ্বারা অবরুদ্ধ ছিলেন তখন সোবাহ (রা.) হযরত তালহা (রা.) কে উদ্দেশ্যে করে বলেন, ‘বাবা! তুমি স্বীয় ব্যক্তিত্বের প্রভাবে বিদ্রোহীদেরকে সরিয়ে দাও’। এ সময় তালহার (রা.) বয়স ষাট বছর। এ হিসাব মতে সোবাহ (রা.) কমপক্ষে আশি বছর যাবত ছিলেন।
তালহা’র (রা.) শৈশব-কৈশোর সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানা যায় না। এটুকু জানা যায় যে, তিনি রাসূল (সা.)-এর মদীনায় হিজরতের চব্বিশ কি পঁচিশ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন। আর একটা ব্যাপারে সবাই একমত- তা হলো তিনি খুব শৈশবকাল থেকেই ব্যবসার সাথে জড়িত হন এবং একটু বড় হলেই ব্যবসায়িক কাজে দেশ-বিদেশে গমন করেন। অন্যান্যের মতো হযরত তালহা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করার পর নানাভাবে অত্যাচারিত হন। বিশেষ করে তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের পক্ষ থেকে তাঁর ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালানো হয় বেশি। এ ব্যাপারে তাঁর মা সোবাহও কম ছিলেন না। মাসউদ ইবন খারাশ বলেন, ‘একদিন আমি সাফা মারওয়ার মাঝখানে দৌড়াচ্ছি, এমন সময় দেখলাম, একদল লোক হাত পা বাঁধা একটি যুবককে ধরে টেনে নিয়ে আসছে। তারপর তাকে উপুড় করে শুইয়ে তাঁর পিঠে ও মাতার বেদম মার শুরু করলো। তাদের পেছনে একজন বৃদ্ধা মহিলা চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে তাকে গাল দিচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম- ছেলেটির এ অবস্থা কেন? তারা বললো, এ হচ্ছে তালহা ইবন ওবাইদুল্লাহ। পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করে বানূ হাশিমের সেই লোকটির অনুসারী হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, এই মহিলাটি কে? তারা বললো, সোবাহ বিনতু আল হাদরামী, যুবকটির মা।
তালহার আপন ভাই ওসমান ইবন ওবাইদুল্লাহ এবং কুরাইশদের সিংহ বলে পরিচিত নাওফিল ইবন খুয়াইলিদও তাঁর সাথে নির্দয় ব্যবহার করে। তারা একই রশিতে তালহা (রা.) ও হযরত আবূ বকরকে এক রশিতে বাঁধা হয়েছিলো এ জন্য তাদেরকে বলা হয় ‘কারীনান’।
হিজরতের পূর্বে মক্কাতেই গোপনে তালহা (রা.) ইসলাম প্রচারে কাজ চালিয় যাচ্ছিলেন। ৬২২ সনের অক্টোবর মাসে রাসূল (সা.) হযরত আবূ বকরকে সঙ্গে নিয়ে হিযরত করেন। তাদের পথ প্রদর্শক আবদুল্লাহকে সব ঘটনা বলেন। এরপর আবদুল্লাহ ইবনে আবূ বকর পরিবার-পরিজনসহ মদীনায় হিজরতের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এমন সময় তালহা (রা.) ও শুয়াইব ইবন সিনান তাদের সাথে যোগ দেন। হযরত তালহা (রা.) এই কাফেলার আমীর নির্বাচিত হন।
মদীনায় পৌঁছে হযরত আসয়াদ-এর বাড়িতে তালহা (রা.) ও সুহায়েব ইবন সিনান অতিথি হন। মক্কায় অবস্থান কালে রাসূল (সা.) মদীনায় হিজরত করেন তখন তালহার সাথে প্রখ্যাত সাহাবী আবূ আইউব আনসারীর সাথে ভাই সম্পর্ক করে দেন। আর একটি বর্ণনায় জানা যায়, রাসূল (সা.) কাব বিন মালিকের (রা.) সাথে তাঁর ভাই সম্পর্ক পাতিয়ে দিয়েছিলেন এবং তাঁরা আপন ভাইয়ের মত আমৃত্যু সম্পর্ক টিকিয় রেখেছিলেন।
ইসলামের ইতিহাসে হিজরী দ্বিতীয় সন থেকে যুদ্ধাভিযান শুরু হয়। সর্বপ্রথম যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় তার নাম বদরের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে হযরত তালহা (রা.) অংশগ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এ যুদ্ধের সওয়াব থেকে তিনি বঞ্চিত হননি। বদর যুদ্ধ থেকে প্রাপ্ত মালে গণিমতের অংশও তিনি পেয়েছিলেন। মালে গণীমতের অংশ তালহা (রা.) কে প্রদানকালে রাসূল (সা.) বলেন, ‘তুমি জেহাদের সওয়াব থেকে মাহরুম হবে না’।
আসল ব্যাপার হলো, বদর যুদ্ধের সময় একদল কাফির মদীনার জনপদের ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা করছিলো। রাসূল (সা.) এ ষড়যন্ত্রের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য হযরত তালহাকে সেখানে পাঠান। যার কারণে তিনি বদর যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। তাই আমরা বলতে পারি তিনি বদর যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশ না নিলেও পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন।
হিজরী তৃতীয় সনে সংঘটিত ওহুদ যুদ্ধে তিনি অংশ গ্রহণ করেন। এবং এ যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। ওহুদ যুদ্ধের সেই সময়টি যখন মুসলমানরা শোচনীয়ভাবে পরাজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো, রাসূল (সা.) কে ঘিরে মুষ্টিমেয় কয়েকজন জানবাজ মুজাহিদ সাহাবী ছাড়া আর কেউই ছিলো না, হযরত তালহা (রা.) ছিলেন তাদের অন্যতম। এ সময় শত্রুদের হাতে আম্মার বিন ইয়াযিদ শহীদ হন। অন্যান্য সাহাবীরাও দারুণবাবে আহত হন। আবূ দুজানা তো রাসূল (সা.)-এর দেহকে আড়াল করে নিজের পুরো দেহটিকে ঢাল বানিয়ে নেন। আর হযরত তালহা (রা.) অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে ঢাল তলোয়ার নিয়ে শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং ঘুরে ঘুরে রাসূল (সা.) কে হেফাজত করার চেষ্টা করেন। তাঁর একক আক্রমণের প্রচণ্ডতায় সেদিন ওহুদ যুদ্ধের মোড় পুনরায় ভিন্ন রূপ নেয়। এরই এক পর্যায়ে যখন কাফেরদের আক্রমণ হ্রাস পায় তখন তালহা (রা.) রাসূল (সা.) কে পিঠে তুলে পাহাড়ের ওপর নিরাপদ স্থানে পৌঁছান।
ওহুদ যুদ্ধে তালহা (রা.) মারাত্মক আহত হন। এ সম্পর্কে হযরত আবূ বকর (রা.) বলেন, ‘এ সময় আমি ও আবূ উবাইদা রাসূল (সা.)-এর নিকট ফিরে এসে তাঁর সেবার জন্য এগিয়ে গেলে তিনি বললেন, ‘আমাকে ছাড়ো, তোমাদের বন্ধু তালহাকে দেখো’। আমরা তাকিয়ে দেখি তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় একটি গর্তে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর একটি হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্নপ্রায় এবং সারা দেহে তরবারী, তীর ও বর্শার সত্তরটিরও বেশি আঘাত’। এ কারণেই রাসূল (সা.) তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন, ‘যদি কেউ কোন মৃত ব্যক্তিকে পৃথিবীতে হেঁটে বেড়াতে দেখে আনন্দ পেতে চায়, সে যেনো তালহা ইবনে ওবাইদুল্লাহকে দেখে’। তাঁকে জীবিত শহীদ বলার করণও এটাই।
রাসূল (সা.) ওহুদ যুদ্ধে বীরত্বের কারণে তাঁকে খাইর (অতি উত্তম) উপাধিতে ভূষিত করেন। হযরত আবূ বকর (রা.) ওহুদ যুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠলেই বলতেন, ‘সে দিনটির সবটুকুই তালহার’। হযরত ওমর (রা.) তাঁকে ‘সাহেবে ওহুদ অর্থাৎ ওহুদওয়ালা’ বলে সম্বোধন করতেন।
মূলত এ যুদ্ধে হযরত তালহার ভূমিকায় রাসূল (সা.) মুগ্ধ হয়েই তাকে বেহেশতের সুসংবাদ দেন।
এক বদর যুদ্ধ ছাড়া তাঁর জীবদ্দশায় যতগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে তিনি তার সব ক’টিতেই সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। মক্কা বিজয়ের দিন হযরত তালহা (রা.) রাসূল (সা.)-এর সাথেই ছিলেন এবং তাঁর সাথেই কাবা ঘরে প্রবেশ করেন।
মক্কা বিজয়ের পর হুনাইনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধেও মুসলমানদের অবস্থা অনেকটা ওহুদের মত হয় কিন্তু হযরত তালহাসহ কয়েকজন জানবাজ মুজাহিদের কারণে নিশ্চিত পরাজয় থেকে মুসলমানরা রক্ষা পান।
বিদায় হজ্বে রাসূল (সা.)-এর যারা সফর সঙ্গী ছিলেন হযরত তালহা (রা.) সেইসব সৌভাগ্যবানদের একজন ছিলেন। জানা যায় এ সফরে রাসূল (সা.) ও তালহা (রা.) ছাড়া আর কারো কাছে কোরবানীর পশু ছিলো না।
রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালে তালহা (রা.) এতই বেদনা বিধুর হয়ে পড়েন যে, তিনি জনগণ থেকে দূরে একাকী অবস্থান গ্রহণ করেন। এমনকি খলীফা নির্বাচনের সময়ও তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি নিজে বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা সকল মুসীবতে ধৈর্য ধারনের হুকুম দিয়েছেন, তাই তাঁর বিচ্ছেদে ‘সবরে জামীল’ অবলম্বনের চেষ্টা করি এবং সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কাছে তাওফিক কামনা করি’।
হযরত আবূ বকর (রা.) খলীফা নির্বাচিত হওয়ার বেশ কয়েকদিন পরে তালহা (রা.) বাইয়াত গ্রহণ করলেও খলীফাকে পরামর্শ দানের ব্যাপারে তিনি অগ্রণী ছিলেন। যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে খলীফার জিহাদ ঘোষণার পক্ষে রায় দিয়ে তালহা বলেন, ‘যে দ্বীনে যাকাত থাকবে না তা সত্য ও সঠিক হতে পারে না’।
হযরত ওমর (রা.)-এর কঠোর ব্যবহারের কারণে হযরত তালহা (রা.) খলীফা মনোনয়নের সময় তাঁর বিপক্ষে মত দেন। কিন্তু হযরত ওমর (রা.) খলীফা হলে সেই তালহা হন তাঁর প্রধান পরামর্শদাতা।
হযরত ওসমান (রা.) বিদ্রোহীদের দ্বারা আক্রান্ত হলে তাঁর হেফাজতের জন্য তালহা (রা.) পুত্র মুহাম্মদ ইবন তালহা (রা.) কে নিয়োগ করেন। হযরত ওসমান (রা.) বিদ্রোহীদের হাতে শহীদ হলে অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। হযরত ওসমানের হত্যার বিচারের দাবীতে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। এ ব্যাপারে ইহুদী ইবন সাবা মুসলমান সেজে সুযোগ গ্রহণ করে। তারই চক্রান্ত মুসলমানদেরকে দ্বিধা বিভক্ত করে ফেলে। এক পর্যায়ে হযরত আয়েশার (রা.) সাথে পরামর্শ করে বসরার দিকে রওনা হন। হযরত আলী (রা.) এ সংবাদ পেয়ে বসরার উপকণ্ঠেই তাদের বাঁধা প্রদান করেন। ফলে উভয় পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করে। পরে হযরত কাকা ইবন আমরের মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষ যুদ্ধ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু ঐ ইবন সাবার তাবেদার লোকেরা রাতের অন্ধকারে উভয় পক্ষের ঘুমন্ত সৈনিকদের মনে করলো প্রতিপক্ষ অন্যায়ভাবে আক্রমণ করেছে। ফলে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। ইতিহাসে এ যুদ্ধটে উটের যুদ্ধ বলে। এ যুদ্ধে প্রতিপক্ষের একটি তীর এসে হযরত তালহার (রা.) পায়ে বিধে। ক্ষতস্থান থেকে বিরামহীনভাবে রক্ত পড়তে থাকে। কোনভাবেই যখন রক্তপড়া বন্ধ করা যাচ্ছিলো না, তখন কাকা ইবন আমরের অনুরোধে তিনি দারুল ইলাজে (হাসপাতাল) যান। অবশ্য সে সময় অনেক দেরি হয়ে গেছে। শরীর রক্তশূন্য হওয়ার কারণে দারুল ইলাজে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরেই তিনি শাহাদাতবরণ করেন। বসরাতেই তাঁকে দাফন করা হয়। দিনটি ছিল হিজরী ৩৬ সনের জুমাদাল ঊলা, অন্যমতে ১০ই জুমাদাল আখের। এ সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর।
হযরত তালহা (রা.) ছিলেন সেই যুগের একজন বিত্তশালী ব্যবসায়ী। অর্জিত অর্থ দুহাতে দান করতেও তিনি ছিলেন খুবই উদার। যার কারণে ঐতিহাসিকরা তাকে দানশীল তালহা বলে উল্লেখ করেছেন।
তাঁর দানশীলতার ব্যাপারে একটি ঘটনা প্রসিদ্ধ। হাদরামাউত থেকে একবার তাঁর হাতে নগদ সত্তর হাজার দিরহাম এলো। কিন্তু এতো টাকা তিনি কি করবেন তা ভেবে পেরেশান হয়ে পড়লেন। রাতে ঘুম হলো না। এ অবস্থা দেখে স্ত্রী হযরত আবূ বকরের কন্যা উম্মে কুলসুম স্বামীকে বললেন, ‘আপনার কি কিছু হয়েছে? আমার কোন আচরণে কি কষ্ট পেয়েছেন?
‘না! একজন মুসলমানের স্ত্রী হিসেবে তুমি খুবই চমৎকার। কিন্তু আমি সেই সন্ধ্যা থেকে ভাবছি এতো নগদ টাকা ঘরে রেখে ঘুমালে আল্লাহ তাঁর বান্দাহ সম্বন্ধে কি ভাববেন?’
‘এতে ঘাবড়াবার কি আছে। এতো রাতে গরীব দুঃখী ও আপনার আত্মীয়স্বজনদের কোথায় পাবেন? সকাল হলেই তাদের মাঝে ভাগ করে দেবেন’।
‘আল্লাহ তোমার ওপর রহম করুন। একেই বলে বাপ কে বেটি’। পরদিন ভোর হতে না হতেই আলাদা আলাদা প্যাকেটে সকল টাকা মুহাজির ও আনসার গরীব মিসকিনদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। অন্য একটি ঘটনাতেও দানশীল তালহাকে প্রত্যক্ষ করা যায়। একবার এক ব্যক্তি এসে আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা বলে তাঁর কাছে কিছু সাহায্যের জন্য আবেদন করলো। তালহা (রা.) লোকটিকে বললেন, ‘অমুক স্থানে আমার এক টুকরো জমি আছে। জমিটুকু তুমি নিতে পারো অথবা ঐ জমিটুকুর মূল্য হিসাবে হযরত ওসমান আমাকে তিনলাখ দিরহাম দিতে চেয়েছেন, তুমি ইচ্ছে করলে দিরহামও নিতে পারো’। লোকটি নগদ তিন লাখ দিরহামই নিলো।
জানা যায়, বানূ তামীম গোত্রের দুঃস্থ গরীবদের তিনি একাই লালন পালন করতেন। মোট কথা তিনি নিজেকে দুঃস্থ মানবতার সেবায় উৎসর্গ করেছিলেন।
ব্যক্তিগতভাবে তিনি অত্যন্ত উঁচুস্তরের মানুষ ছিলেন। একটি ঘটনা বললে ব্যাপারটি সবার কাছে পরিস্কার হবে। বহু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি উতবা ইবনে রাবীয়ার কন্যা উম্মে আবানকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন কিন্তু উম্মে আবান সমস্ত প্রস্তাব বাতিল করে হযরত তালহাকে পছন্দ করেন। এর কারণ জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমি তার স্বভাব চরিত্র অবগত আছি। তিনি ঘরে ঢোকার সময় হাসতে হাসতে ঢোকেন এবং যাওয়ার সময় হাসতে হাসতে যান। কেউ কিছু চাইলে কার্পণ্য করেন না এবং না চাইলেও অপেক্ষা করেন না। কেউ তাঁর কাজ করে দিলে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন এবং অপরাধ করলে ক্ষমা করেন।
তাবুকের যুদ্ধে হযরত কা’ব ইবনে মালেক (রা.) অংশগ্রহণ না করায় তাঁর ওপর রাসূল (সা.) নাখোশ হন। পরে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে মাফ করে আয়াত নাযিল হলে তালহা (রা.) ছুটে যান এবং কা’ব (রা.)-এর সাথে করমর্দন করেন। এ ব্যাপারে কা’ব (রা.) বলেন, ‘আমি তালহার (রা.) এই ব্যবহার কখনও ভুলবো না। কারণ, মুহাজিরগণের মধ্যে কেউই তাঁর মতো এমন বাবে এগিয়ে এসে আমার সাথে সাক্ষাত করেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *