সাজির সাজানো ঘর | পর্ব-২ |ইসলামীক গল্প |bd islamic site
সাজির সাজানো ঘর ইসলামীক গল্প এর ১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এলী ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকেই বেশ কিছুক্ষন নীরবে বসে ছিলেন| মনটা তার আজ ভীষণ খারাপ| অনেক দিন থেকে এই এক সমস্যা তার| হঠাৎ হঠাৎ অকারণেই মনটা খারাপ হয়ে যায়| অন্তরের ভীতর থেকে একটা বেদনা যেনো উৎলে ওঠে| এমন একটা বেদনা যা কাউকে বলা যায় না| কারো কথায় শান্তনা পাওয়া যায় না| এসময় তাই তিনি নীরব থাকতেই পছন্দ করেন| কারো সাথে কোনো কথা বলেন না| কেবলই চুপটি করে বসে থাকেন| ক্লাসরুমে বসে আজও তিন সে চেষ্টাই করে চলেছেন| কিন্তু প্রাইমারী স্কুলের একটা ক্লাসরুম আর গরুর হাট বোধ হয় সমান ব্যাপার| নীরাবতা এখানে দুস্প্রাপ্য একটা বস্তু| ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা নীরাবতার শত্রু| হৈ চৈ আর হুল্লোড়ে মেতে থাকাই তাদের অভ্যাস| তাদের মাঝে বসে নিজের নীরাবতাকেও তাই ধরে রাখা মুশকিল| বারংবার শুধু ধ্যান ভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে তার| শেষে বিরক্ত হয়ে মাথাটা তুলে চশমার উপর দিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকলের ক্লাসের দিকে| বোঝার চেষ্টা করলেন কি হচ্ছে| দেখলেন, কয়েকজন মেয়ে এক জায়গায় জড় হয়ে হৈ হুল্লোড় করছে| কোনো দিকে নজর নেই তাদের| শিক্ষিকা ক্লাস রুমে থাকতে এমন একটা আচরণ করা নিঃসন্দেহে বড় মাপের অনিয়ম| আর সেই শিক্ষিকা যদি হয় স্বয়ং প্রধান শিক্ষিকা তবে তো তা বিরাট বড় অনিয়ম| সেই বড় অনিয়মটাকে ধামা চাপা দিতেই অনেক বড় মাপের একটা ধমক দিলেন এলী ম্যাডাম|
— চুপ|
সাথে সাথে চুপ হয়ে গেলো সবাই| বসে পড়লো যে যার স্থানে| এলী ম্যাডামের মনে হলো সবাই বসে পড়ার পরও কিছু একটা অনিয়ম রয়েই গিয়ছে| ক্লাসের মধ্যে| ব্যাপারটা কি সেটা বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো তার| কিছুক্ষণ এদিক সেদিক তাকিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন| ছেলে-মেয়েগুলো হৈ চৈ করার জন্য নিজেদের জায়গা ছেড়ে এক স্তানে জড় হয়েছিলো| পরে তার ধমক শুনে যে যেখানে দাড়িয়ে ছিলো সেখানেই বসে পড়েছে| আগের জায়গায় ফিরে আসেনি কেউ| তাতে স্থানে স্থানে একই ব্যঞ্চ এ চার-পাচজন বসেছে ঠাসাঠাসি করে আর আগের জায়গাগুলো পুরা ফাকা হয়ে পড়ে আছে| এই ব্যাপারটিও বেজাই বেখাপ্পা লাগছে| তার কাছে| কড় করে আরো একটা ধমক দিয়ে তিনি বললেন,
— যে যার জায়গায় ফিরে যাও|
যে যার জায়গায় ফিরে গিয়ে ক্লাসে যখন শৃঙ্খলা ফিরে আসলো তখন তিনিও প্রসঙ্গে ফিরে আসলেন| যারা নিজের স্থান ছেড়ে অন্যত্র গোলমাল করছিলো ডান হাতের বেতটি দ্বারা তাদের দিকে ইশারা করে ধমক দিয়ে বললেন,
— এই তোরা এখান থেকে ওখানে গিয়ে গোলমাল করছিলি কেনো?
এমনই জোরে ধমক দিয়ে কথাটা বললেন যে, তার হাতের ইশারার আওতায় যেসব মেয়েরা ছিলো সবারই হৃদকম্প শুরু হয়ে গেলো| ভয়ে মুখে কারো কথা সরলো না| পুরা ক্লাসটা আরো একবার নীরব হয়ে গেলো| এলী ম্যাডাম নিজেই এবার নীরাবতা ভাঙলেন| চিৎকার করে বললেন,
— কী রে| চুপ করে আছিস কেনো? কি হয়েছে বল|
উপাই না দেখে স্বপনা নামের একটি মেয়ে শেষে উঠে দাড়িয়ে বলল,
— ম্যাডাম দেখেন| ও কেমন বিশ্রী পোশাক পরে স্কুলে এসেছে|
কথাটা বলে, সে হাতের ইশারায় নিকটেই বসে থাকা তারই বয়সের আরেকজনকে দেখিয়ে দিলো| তারপর অন্য হাতটি মুখে ধরে ফিক করে হেসে উঠলো| তার হাসির সাথে তাল মিলিয়ে হিস হিস করে হেসে উঠলো বাকী ছেলে-মেয়েরা| তারপর ধমক খাওয়ার ভয়ে আবারো চুপ হয়ে গেলো সবাই|
এলী ম্যাডাম স্বপ্নার হাতের ইশারা অনুসরণ করে দৃষ্টি ফেরালেন| কিন্তু বিশ্রী কিছুই দেখতে পেলেন না| একটা বেখাপ্পা বেপার অবশ্য দেখলেন| দেখলেন| উত্তর দিকের দেওয়াল ঘেষে কয়েকটা মেয়ের মাঝে খুব সুন্দর পোশাক পরে বসে আছে অতি সুদর্শন একটা ছেলে| ছেলেটার পোশাক আশাকের মধ্যে তিনি বিশ্রী কিছুই দেখতে পেলেন না| তবে এতগুলো মেয়ের মাঝে ছেলেটাকে বসে থাকতে দেখে কিছুটা অবাকই হলেন| এই এলাকার ছেলে-মেয়েরা সাধারণত মিলে-মিশে বসে না| ছেলেরা একদিকে বসে আর মেয়েরা বসে অন্যদিকে| তিনি এখানে প্রধান শিক্ষিকা হয়ে আসার পর থেকেই অনেকবার চেষ্টা করেছেন তাদের একত্রে বসাতে কিন্তু ব্যার্থ হয়েছেন বারবারই| অনেক কষ্টে কেবর ইনফিন আর ক্লাস ওয়ানে এই নিয়মটা চালু করতে পেরেছেন| টু-তেও চলে কিছুটা| কিন্তু ফোর ফাইভের ছেলে-মেয়েদের কিছুতেই একত্রে বসানো যায় না| বিদঘুটে একটা এলাকায় এসে পড়েছেন তিনি| এখানকার সব লোকেরা বড় বেশি সেকেলে| আজ ক্লাস ফোরে একটা ছেলেকে মেয়েদের মাঝে বসতে দেখে তিনি তাই বেজাই খুশি হয়ে যান| ছেলেটাকে ডেকে আদর করতে ইচ্ছা হয় তার| ডাকতেও গেলেন একবার কিন্তু কিছুতেই তার নাম মনে করতে পারলেন না| বয়স বাড়লে এই একটা সমস্যা দেখা দেয় সবার ক্ষত্রে| স্মৃতি শক্তি দূর্বল হয়ে আসে| এলী মেডাম অবশ্য সেটা বিশ্বাস করেন না| তিনি দাবী করেন তার স্মরণ শক্তি আগের মতোই আছে| কোনো কিচু ভুলে গেলে তাই তিনি সেটা স্মরণ করার জন্য আরো বেশি জিদ ধরে বসে| ভাল করে মনে করার চেষ্টা করেন ছেলেটার নাম| একটু ভেবেই তার মনে হলো, ঐ কোনায় যে মেয়েটা বসে তার নাম জাহানারা| অবাক ব্যাপার হলো, ছেলেটা হুবহু জাহানারার মতো দেখতে| তারই মতো লম্বা-চওড়া তারই মতো মুখের গঠন| জাহানারারই জমজ ভাই হবে হয়তো| তার নামও হয়তো হবে জাহানারারই মতো| এলী মেডাম ভাবলেন,
— সেটা কি হতে পারে! জাহান?
তাপর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে তার দিকে ইশারা করে বললেন,
— এই ছেলে তোমার নাম কি?
সাথে সাথেই হেসে উঠলো ক্লাসের সবাই| এলী ম্যাডাম দারুণ বিব্রত হলেন| কোনো ছাত্রের নাম মনে না থাকলে তাকে আবার জিজ্ঞাসা করার মধ্যে হাসির কারণটা কি সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলেন না| শেষে ভাবলেন,
— ছেলেপিলের আবার হাসতে কারণ লাগে! তারা তো এমনইতেই হাসে|
অতএব সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে| আবারো ছেলেটার দিকি দৃষ্টি দিলৈন তিনি| তখনও তাকে মুখ কাচুমাচু করে নীরবে বসে থাকতে দেখে ধমক দিয়ে বললেন,
— এই খোকা বলো| কি নাম তোমার?
আবারো শোনা গেলো ফিকফিক করে হাসির শব্দ| সেই সাথে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো সেই ছেলেটার মুখ| হাসি থামানোর জন্য এলী ম্যাডাম আবারো কড়া করে একটা ধমক দিলেন| তারপর কড়া দৃষ্টিতেই তাকলেন ছেলেটারর দিকে| ম্যাডামকে ওভাবে রাগত দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে সে তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়িয়ে বলল,
— ম্যাডাম আমি জাহানারা| আমি ছেলে নই| আমি মেয়ে|
কথাটা শুনে যেনো বাজ পড়ার মতো অবস্থা হলো এলী ম্যাডামের মাথায়| এই তাহলে সেই জাহানারার| আজ তাহলে ছেলেদের পোশাক পরেই স্কুলে এসেছে সে! এই এলাকার কোনো মেয়ে যে ছেলেদের পোশাক পরে স্কুলে আসতে পারে সেটা ভাবতেও পারেননি তিনি| তাই তো এত সব ভাবনা চিন্তা করেছেন কিন্তু একটিবারের জন্যও এমন সম্ভাবনার কথা তার মাথায় আসেনি| চাঁরপাচ বছর ধরে এই এলাকার মেয়েদের মাঝে আত্মসচেতনতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন তিনি কিন্তু পারছেন না কিছুতেই| জাহানার কাজ দেখে তিনি তাই আহ্লাদে একেবারে আটখানা হয়ে যান| এ জীবনে এমন ভাগ্য যে তার হবে সেটা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি| তাকে তিনি হাতের ইশারায় কাছে ডাকেন তারপর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
— ভদ্র মেয়ে, লক্ষ্মী মেয়ে|
জাহানারা তখুনি ঠোট ফুলিয়ে বলে,
— কিন্তু ম্যাডাম| এরা সবাই বলছে এই পোশাকে নাকি আমাকে বিশ্রী দেখাচ্ছে| আমাকে নাকি পাগলী পাগলী দেখাচ্ছে|
কথাটা শুনে একেবারে বুকের মধ্যে আঘাত লাগলো এলী ম্যাডামের| এমন একটা মহৎ নিয়ে এমন বিশ্রীভাবে টিটকারী করা নিরবে সহ্য করা যায় না| তিনি হুংকার ছেড়ে বললেন,
— কে বলেছে একথা?
জাহানারা আবারো ঠোট ফুলিয়ে বলল,
— সবাই বলেছে| বলেছে ছেলেদের পোশাক মেয়েরা পরলে বিশ্রী লাগে|
এলী ম্যাডাম এবার একটু বিপদে পড়ে গেলেন| কোনো একটা অপরাধ দুয়েকজন করলে তার কঠিন শাস্তি দেওয়া যায় কিন্তু সবাই মিলে করলে তার শাস্তি হালকা হয়ে যায়| হালকা ভাবে ধমক দিয়েই তাই তিনি বললেন,
— কেনো? বিশ্রী হবে কেনো? ছেলে মেয়ে দুটোই সমান একথা তোমরা জানো না?
এটা অবশ্য ক্লাসের সবাই জানে| এরই মধ্যে কম করে হলেও এক হাজার বার তো এলী মেডামের মুখ থেকেই তারা শুনেছে কথাটা| এছাড়া অন্যান্য শিক্ষকরা বলেছেন কয়েকবার| কেউ কেউ টিভিতেও বলতে শুনেছে এই কথাটা| একথার তাই কেউ কোনো প্রতিবাদ করলো না| শুধু এক পাশ থেকে একটা মেয়ে ঠোট বেকিয়ে বলে উঠলো,
— ছেলে-মেয়ে যদি সমানই হবে তাহলে ছেলেদের পোশাক পরে তাদের মতো হতে চাচ্ছো কেনো? নিজের পোশাক নিজে পরে নিজের দামটা ধরে রাখাই তো ভাল অন্যের মতো হয়ে নকল সাজবো কেনো?
এক নিশ্বাসে কথা গুলৌ বলে ফেলে মেয়েটা| তার কথাগুলো শুনে এলী ম্যাডাম আবারো চশমার ফাক দিয়ে তাকালেন| তারপর হালকা ধমক দিয়ে বললেন,
— কথাটা কে বলল?
এক কোনা থেকে একটা মেয়ে উঠে দাড়ালো| দাড়িয়েই আবার বলল,
— ঠিকই তো বলেছি, সমান হলেই কি একজনকে আরেকজনের মতো হতে হয়! কম্পিউটার আর ফ্রীজের দাম তো সমান| তাই বলে কি কম্পিউটারের মধ্যে মাছ-মাংস আর ফ্রীজের মধ্যে গান আর ছবি লোড করা যায়?
এলী ম্যাডাম সেদিকে দৃষ্টি দিয়েই চমকে উঠলেন| এ হলো, চম্পা| এই ক্লাসের সব চেয়ে পাজি মেয়ে| কটু কথায় ভীষণ পটু সে| সাহসও আছে খুব| যার তার সামনে যা তা বলে দিতে একটুও বুক কাপে না তার| শাস্তি দিয়েও তাকে টাইট করা যায় না| একটা বাহানা করে ঠিকই শাস্তিটা এড়িয়ে যায়| এ স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের মারধর করা নিষেধ| কান মলা বা এই জাতীয় লঘু শাস্তি দেওয়া যায়| মানবতার দোহাই দিয়ে এলী ম্যাডাম নিজেই করেছেন এই আইন| একদিন একটা ব্যাপারে রাগান্বিত হয়ে এলী ম্যাডাম তাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন| বললেন,
— কান ধরে দাড়িয়ে থাক|
সাথে সাথে চম্পা বলে উঠলো,
— পা পিছলে পড়ে গিয়ে হাতে আর পায়ে ব্যাথা পেয়েছি| হাত দিয়ে কান ধরতে পারবো না| পা দিয়ে দাড়াতেও পারবো না| তবে আপনি বললে সারাটা সিদ ব্যাঞ্চে বসে থাকতে পারবো|
এলী ম্যাডামও নাছোড়বান্দা| বললেন,
— বসেই যদি থাকবে তবে বাইরে গিয়ে রোদে বসে থাকো| যতক্ষণ না আমার ক্লাস শেষ হয়|
সাথে সাথেই চম্বা বের হয়ে গেলো| তারপর সূর্যের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে| একটা গাছের ছায়ার খুব নিকটে রোদে জ্বল জ্বল করছে এমন একটা জায়গা দেখিয়ে বলল,
— ম্যাডাম এখানে বসবো?
এলী ম্যাডাম সরল মনে বললেন,
— হু হু| ওখানে বসলেই হবে|
আর মনে মনে ভাবলেন এই প্রচন্ড গরমে রোদে বসে থেকে পাজি মেয়েটা আজ খুব শায়েস্তা হবে| কিন্তু তার সে আশার গুড়ে বালি পড়ে গেলো| চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যে দেখা গেলো গাছের ছায়া ঘুরে তার মাথার উপর থেকে পাঁ পর্যন্ত ঢেকে ফেলেছে| চম্পা জানতো এমনই হবে| ছায়া মাপার বিদ্যাটা জানা আছে তার| জোহর আর আসরের সলাতের ওয়াক্ত কখন হয় সেটা বোঝাতে গিয়ে সাজি আপু ছায়া মাপার বিদ্যাটা শিখিয়ে দিয়েছে তাকে| সেই অনুযায়ী হিসেবে করেই বসেছে চম্পা| ফলও পেয়েছে আশানুরুপ| কিছুক্ষণের মধ্যেই ছায়া এসে পড়েছে তার গায়ের উপর| সেই সাথে বইতে শুরু করেছে ফুরফুরে হাওয়া| সেই ফুরফুরে হাওয়াই চম্পার মেজাজটাও ফুরফুরে হয়ে গেলো| দুই হাতের দুটি করে আঙ্গুল দিয়ে মানুষের মতো দুটি পা বানিয়ে দুদিক থেকে হাটিয়ে একবার নিকটে নিয়ে যায় আরেকবার দূরে নিয়ে যায়| আর মুখে বারংবার বলতে থাকে,
ইলাটিং বিলাটিং সই লো
কিসের খবর আইলো …..
একাকী এমনই ফুরফুরে মেজাজে সে খেলাটি খেলতে থাকলো যে ক্লাসের বাকী ছাত্ররাই তার উপর হিংসা করতে লাগলো| তারা হয়তো ভাছিলো যদি এমন শাস্তি তাদেরও দেওয়া হতো| হিংসা হলো এলী ম্যাডামেরও| ফেলে আসা ছেলে বেলার কথা মনে করে আর বর্তমান সময়ে যে দায়িত্ব আর দুঃচিন্তার ভার তার কাধে চেপে বসেছে তার সাথে সেই সহজ-সরল সময়টিকে তুলনা করে| সেদিন চম্পাকে শাস্তি দিতে গিয়ে তিনি নিজেই কিছুটা শায়েস্তা হয়েছেন| এমন ঘটনা আরো দুয়েকটা আছে| আজ আবারো মুখ খুলেছে পাজি মেয়েটা| এলী ম্যাডাম তাই নিজের করণীয় ঠিক করতে পারলেন না| মুখ বুজে তার কথাই কেবল শুনতে লাগলেন| ম্যাডামকে চুপ থাকতে দেখে আরও সাহস বেড়ে গেলো চম্পার| একটু থেমে আরো দুয়েকটা কথা স্মরণ করে নিয়ে বলল,
— যে নিজের দাম বোঝে সে নিজের পরিচয় ধরে রাখে অন্যের মতো হতে চায় না| কৈ ছেলেরা তো আমাদের মতো হতে চায় না| তারা তো মাথায় ওড়না দিয়ে ঘুরে বেড়ায় না| তাদের দাম তারা বোঝে আমার আমাদের দাম আমরা বুঝবো না!
নিজের অজান্তেই মাথা ঝাকালেন এলী ম্যাডাম| চম্পার কথাগুলো ভীষণ ভাবিয়ে তুলল তাকে| মন্দ বলেনি সে|
— সত্যিই তো!
মনে মনে ভাবতে লাগলেন তিনি| বিশ্বের বড় বড় পন্ডিতরা ছেলে মেয়ে সমান এই অজুহাতে ছেলে আর মেয়েকে একই রকম বানাতে চাচ্ছে| একই শিক্ষাই উভয়কে শিক্ষিত করা, একই রকম সাজে সজ্জিত করা, একই কর্মে নিয়োগ করা ইত্যাদি| কিন্তু দুটো জিনিসের দাম সমান হলেই কি দুটো জিনিস দ্বারা একই কাজ করানো সাজে! একটা ভাল কম্পিউটার আর একটা ভাল ফ্রীজের দাম বলতে গেলে সমানই| তাই বলে কি কম্পিউটারের মধ্যে মাছ মাংস আর ফ্রীজের মধ্যে নানা রকম অ্ডিও ভিডিও সংরক্ষণ করা চলে! বরং দুটো জিনিসেরই মূল্য আছে বিধাই তাদের নিজ নিজ স্থানে রেখে ব্যবহার করতে হয়| একটিকে আরেকটির মতো বানিয়ে ফেলা সঠিক হয় না| কাদা-মাটির মতো তুচ্ছ ও মূল্যহীন জিনিসকেই পশু-পাখি বা ফুল-ফল এর মতো আকৃতিতে গড়ে বাজারে বিক্রয় করতে হয় তা না হলে বিক্রি হয় না| যেহেতু তার নিজের কোনো মুল্য নেই| কিন্তু যার নিজের মুল্য আছে তাকে তার আকৃতিতে রেখে দিলেই সুবিধা হয়| তাতে চাহিদা বাড়ে| অর্থাৎ মূল্য আছে যার তাকে তার মতো রাখলেই চলে কিন্তু মুল্য নেই যার তাকেই অন্যের মতো হতে হয়| না হলে চলে না|
— দুনিয়ার তাবৎ নারীবাদীরা তাহলে নারীদের মূল্যহীনই প্রমাণ করতে চাচ্ছে!
চম্বার কথাটা এলী ম্যাডামের মাথায় প্রচন্ড একটা আঘাত হানলো| সেই আঠারো বছর বয়স থেকে নারীবাদী সংগঠনের সংঙ্গে জড়িত তিনি| নানা অজুহাতে ছেলে-মেয়েকে একত্রে মিশিয়ে খিচুড়ি পাকানোর মতবাদের তিনি ঘোরতর সমর্থক| এদেশের সংখ্যালঘু খৃষ্টান সম্প্রদায়ের তিনি একজন| সেই সুবাধে ইউরোপ ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছেন| সেখানে পড়াশুনাও করেছেন কয়েকটা বছর| তাদের ক্রিষ্টি কালচার খুব কাছ থেকে দেখেছেন| এদেশ থেকে খৃষ্টান হয়ে ইউরোপে গিয়ে তিনি কর্যত নাস্তিক হয়ে ফিরে এসেছেন| আর ফিরে এসেই ধর্ম-টর্ম বাদ দিয়ে প্রচারে নেমেছেন সমতা আর নারী স্বাধীনতার পক্ষে| এসব ব্যাপারে নানা রকম সব সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন| পূর্বে প্রতিষ্ঠিত অনেক সংগঠনের সাথে নিয়মতি যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন এতটা দিন| একের পর এক বিয়েও করেছেন এমনই মুক্তমনা আর স্বাধীনচেতা কয়েকজন মানুষকে| তারা সবাই বিযের পরও স্বাধীনই থেকে গেছে| তার বাহুডোরে আবদ্ধ থাকেনি| তিনিও বিয়ের পর স্বাধীন জীবন-যাপনই করেছেন| ফলে গভীর কোনো প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি কোনো স্বামীর সাথেই| ঝড়ো হাওয়ার মতোই তারা এসেছে তার জীবনে| অন্তরে শীতল একটা পরশ বুলিয়ে দিয়ে আবার আবার ঝড়ো হাওয়ার মতোই চলে গেছে| তাদের কেউ তো তাকে ডিভর্স দিয়েছে আর কাউকে তিনিই ডিভোর্স দিয়েছেন| তিনি যাকে রাখতে চেয়েছেন তাকে রাখতে পারেননি কারণ সে স্বাধীন আর তাকে যে রাখতে চেয়েছে সেও রাখতে পারেনি কারণ তিনি স্বাধীন| কয়েকজন স্বামীর সাথে সংসার করে যে দু’য়েকটা ছেলে মেয়ে তার হয়েছে তারাও একই রকম স্বাধীনতাকামী| ছেলেরা ভবঘুরে হয়ে গেছে আর মেয়েরা কোনো না কোনো ভবঘুরের হাত ধরে কোথায় যে ভেগেছে তিনি ঠিক মতো জানেনও না| এই এলাকায় একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে তিনি একাই থাকেন| কালে ভদ্রে ফোন-টোন করে ছেলে-মেয়েরা| দু মিনিটের জন্য বেড়াতেও আসে কখনও সখনও| বাকি সময়টা তাকে একাই কাটাতে হয়| ভাগ্যিস এদেশে আছেন| পাড়া-প্রতিবেশীরা তাই একটু আধটু খোঁজ খবর করে| ইউরোপ বা আমেরিকার কোনো দেশে হলে সেটাও কপালে জুটতো না| বল্গাহীন স্বাধীনতাই তাকে পুরোপুরি নিসঙ্গ করে ছেড়েছে| স্বাধীনতা আর সমতার প্রতি সারাটা জীবনের প্রীতি এখন তাই তার কাছে ভীতিতে পরিণত হয়েছে| সমতা আর স্বাধীনতার যে মুলমন্ত্র তিনি ইউরোপ থেকে আমদানী করেছেন তার সত্যতা আর যৌক্তিকতা সম্পর্কেও সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে কিছুটা| তবে সারাটা জীবন ধরে যে বিদ্যা তিনি শিখেছেন তার আলোকে এই সন্দেহের গ্রহণযোগ্র কোনো ভিত্তি খুঁজে পাননি তাই সন্দেহটাকেই অমুলক ভেবে মাথা ঝাড়া দিয়ে চিন্তাটা দূল করার চেষ্টা করেছেন| কিন্তু চম্পার এই কথায় তার মনের সেসব সন্দেহ আবারো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে| ছোট্ট একটা কথা কিন্তু অকাট্য আর স্পষ্ট| এই ছোট্ট কথাটাই বুঝে উঠতে পারেনি অনেক বড় বড় মাথার লোকেরা| তার মধ্যে তিনি নিজেই একজন| কিন্তু এই ছোট্ট মেয়েটা একথা শিখলো কোথা থেকে| এই বয়সে এতটা জ্ঞানের কথা তো তার জানার কথা নয়| জিনিয়াসদের ব্যাপার অবশ্য আলাদা| অল্প বয়সেই তারা এমন সব গভীর বিষয়ে কথা বলে যা শুনলেও বড় বড় পন্ডিতদের চোখ চোড়কগাছে উঠে যায়| কোথা থেকে যে সেসব কথা তারা বলে তার উৎসই খুঁজে পাওয়া যায় না| সুযোগ বুঝে অন্ধ বিশ্বাসীরা বিষয়টাকে জুড়ে দেয় স্রষ্টার সাথে| বলে তাদের উপর দৈব বাণী নাযিল হয়| মুসলমানরা বলে ইলহাম হয়| বিজ্ঞানীরা অবশ্য বিষয়টার ব্যাখ্যা করেন ভিন্নভাবে তাদের মস্তিষ্কের আকার-আকৃতি আর মেধার বিকাশকেই তারা এর কারণ মনে করেন| তবে কি চম্পা একটা জিনিয়াস গার্ল! তার ভাব দেখে তো এমন মনে হয় না| তার সব কথা-বার্তা আর কার্যকলাপে অগোছালো দুষ্টুমির অস্তিত্ব আছে বটে কিন্তু পরিকল্পিত কোনো গভীর জ্ঞানের কথা তো পাওয়া যায় না| তবে কি তাকে কেউ শিখিয়ে দিয়েছে কথাগুলো? কৌতুহল চেপে রাখতে পারেন না এলী ম্যাডাম| ভীষণ আগ্রহী হয়ৈ বলেন,
— এসব কথা তোকে কে শিখিয়েছে রে?
চম্পাও সাথে সাথে উত্তর দেয়|
— সাজি আপু বলেছে|
— সাজি!
ঠোঁ বাকা করে বলেন এলী ম্যাডাম|
— সে আবার কে?
— ওমা! আপনি সাজি আপুকে চেনেন না!
ঠোঁট বাঁকা করে চম্পাও| এমনভাবে কথাটা বরে যেনো সাজি কোনো প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে| বিশ্বজোড়া বুঝি তার ক্ষ্যাতি| তাকে না চিনলে তাই মানই থাকে না| চম্পা যতটা ভাব দেখায় ততটা অবশ্যই নয় তবে কিছুটা খ্যাতি আছে সাজির| ছোট থেকেই নানা ব্যাপারে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে আসছে সে| এলাকার সবাই তাকে বু্দ্ধিমতি বলেই জানে| ইংরেজীতে হয়তো তাকেই জিনিয়াস বলা যায়| নানা প্রয়োজনে তার কাছে হাজির হয় এলাকার মেয়েরা| কেউ কারো কাছে টাকা ধার দিয়েছে তার পর কয়েক কিস্তিতে কত টাকা শোধ করে আর কত টাকা বাকি আছে সেসব হিসাব জানতে হলে দুই পক্ষই সোজা হাজির হয় সাজির কাছে| জানে সে অংকে পাকা ঈমানও বেশ পাকা তারা| তাই তার গুনতেও ভুল হবে না আবার তার কাছে মিথ্যাও শুনতে হবে না| এছাড়া আরো একটা জটিল কাজ করে সাজি| ডাক্তারের লেখা প্রেসক্রিপশন দেখে বলে দেয় ফার্মেসীতে ঠিক ঠিক ঔষধ দিয়েছে নাকি নাম পাল্টে ভেজাল ওষুধ দিয়েছে| এতটুকু বয়সে প্রেসক্রিপশন পড়তে সে ভারি দক্ষ| বয়স হওয়ার পর থেকেই তার বাবা-মা সারা বছরই নানা রকম ওষুধ পাতি খান| কবিরাজের কাছে যান না একবারও| বলেন,
— আমাদের রোজী কবিরাজের কাছে যেতে নিষেধ করতো| বলতো আল্লাহ রোগ দিয়েছেন রোগের ওষুধও দিয়েছেন| রোগ হলে ওষুধ খেতে হবে| তাবীজ নেওয়া যাবে না|
তারপর প্রায়ই তারা শোনান মানু কবিরাজের তাবিজ খুলে মাটি ভরে দেওয়ার কাহিনী| একই কাহিনী শুনতে শুনেত সাজির কানে ঘাটা পড়ে গিয়েছে| তাছাড়া এই অজুহাতে বাড়িতে ওষুধের কারখানা বসিয়ে দেওয়াটা তার পছন্দ হয় না| চোখ পাকিয়ে সে বলে,
— তাই বলে কি ওষুধের খীর পাকিয়ে খেতে হবে!
কথাটা শুনে বাবা-মা দুজনেই হেসে ওঠে| ছোটন থাকলে সেও হাসে| সাজি তখন ভীষণ রেগে যায়| মুখ গোমড়া করে বলে,
— রোজী আপু যা বলেছে সেটাই মানতে হবে আর আমি যেটা বলবো সেটা শুনে হাসতে হবে?
কথাটা শুনে আবারো হেসে ওঠে সবাই| সাজি রাগে গজগজ করতে করতে উঠেই চলে যায় সেখান থেকে| তবে ঘটনাটা ভুলে যায় না| ভুলে যাওয়ার পাত্রীই নয় সে| সব কিছুতে ভীষণ জেদ তারা| বাবা-মা নতুন কোনো প্রেসক্রীপশন আর নতুন কিছু ওষুধ নিয়ে হাজির হলেই সে তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে| রোজী আপু যেভাবে মানু কবিরাজের তাবীজে ভুল ধরেছিলো সেও চেষ্টা করে ওষুধের মধ্যে ভুল খুঁজে বের করার| প্রথমে প্রেশক্রিপশনের লখা সে কিছুই বুঝতে পারতো না| ওষুধের লেখাগুলো সহজেই বুঝতে পারতো| তখন ওষুধ দেখে দেখে প্রেশক্রিপশনের লেখাটা মেলাতো| এভাবে ধীরে ধীরে প্রেশক্রিপশের লেখা পড়ার বিরাট ওস্তাদ হয়ে যায় সে| ততদিনে কিসের সাথে কি মেলানো দরকার সে বুদ্ধিটাও তার হয়ে গেছে| সে তখন প্রশক্রিপশনের লেখা পড়ে পড়ে ওষুধগুলো মেলাতো| তখনুই ধরা পড়ে যেতো দুয়েকটা অনিয়ম| অমনি সে চেচিয়ে উঠতো,
— এই দেখো ভেজাল ওষুধ দিয়েছে|
কান্ড দেখে ভীষণ অবাক হয়ে যেতেন ছোটনের বাবা-মা| ছোটনের বাবা শিক্ষিত মানুষ তবে এভাবে মিলিয়ে দেখার বুদ্ধিটা তার মাথায় আসেনি| মাথায় আসলেই বা কী! প্রেসক্রিপশনের যা লেখা তিনি তা পড়তে পারবেন| সাজির কথায় তিনি তাই ভরসা পেতেন না| কিন্তু সাজি জোর দিয়ে বলতো,
— এখুনি ফার্মেসীতে যাও সঠিক ওষুধ নিয়ে এসো|
তখুনি নয় তবে পরে সময় করে ছোটনের বাবা ফার্মেসীত যেতেন| কিছুটা সঠিক ওষুধ নেওয়ার তাগাদাই আর বাকীটা সাজির কথা যাচাই করার উদ্দেশ্যে| গিয়ে কিন্তু তাজ্জব বনে যেতেন| দেখতেন ওষুধ ঠিকই বদলে গিয়েছে| দোকানী বলতো,
— একই ওষুধ অন্য কোম্পানী|
ছোটনের বাবা তখন বলতেন,
— কোন কোম্পানী?
আর তাতেই দেখতেন মহা গোলাযোগ| বেশিরভাগ সময়ই দেখা যেতে ভাল একটা কোম্পানীর বদলে দিয়েছে অনেক কমা একটা কোম্পানীর ওষুধ| তাতে অকাজ কিছু না হলেও কাজের কাজ কতটুকু হয় সেটাই প্রশ্ন|
আবার কখনও জীভে কামড় দিয়ে বলতো,
— ইস! ভুল হয়ে গেছে| এ ওষুধ খেলে তো আপনার সমস্যা হতো| শুনে দাতে দাত ঘষে রাগ প্রকাশ করতেন ছোটনের বাবা| এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে সাজিকে না দেখিয়ে আর ওষুধই খেতে মন চায় না|
সাজির এই বিদ্যার কথা পড়াার লোকেরাও জানে| তারাও তাই ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ ফার্মেসী থেকে কিনে আনার সাথে সাথে সাজিকে দেখিয়ে নিয়ে যায়| সাজির কাছে অনুমতি না নিয়ে তারা ওষুধ খায় না| এতসব প্রেসক্রিপশন ঘটতে ঘটতে কোন রোগের কি ওষুধ সে ব্যাপারেও অনেকটা জানা হয়ে গেছে সাজির| মাঝে মাঝে সাহস করে দুয়েকজনকে চিকিৎসাও দেয় সে| ছোট্ট একটা কাগজে লিখে দেয় দুয়েকটা ওষুধের নাম| ইচ্ছা করলেই সাজি ডাক্তারদের মতো জড়িয়ে লিখতে পারে কিন্তু সেটা সে করে না| সে গোটা গোটা অক্ষরে স্পষ্ট করে লেখে| মানুষের উপর সহজ করাই তার উদ্দেশ্য জটিল করা নয়| সেসব ওষুধ মানুষ বাজার থেকে কিনে এনে খায়| তাকে রোগটাও সারে ডাক্তার খরচটাও বাঁচে| ওষুধ নিতে অনেকেই ভিড় করে কিন্তু সাজি সবাইকে ওষুধ দেয় না| কেবল যার সমস্যা মনে হয় অতি সামান্য তাকেই একটু উপকার করে| বাকীদের ডাক্তারের কাছে যেতে বলে| এভাবে যাচাই বাছায়ের ফলে সাজির ওষুধে বলতে গেলে শতভাগ কাজ হয়| তার সুনামটাও তাই চারিদিকে ছড়িয়ে যায়| সাজির এই কারসাজিতে মানু কবিরাতের কবিরাজীর ব্যাবসাটা লাটে ওঠার জোগাড় হয়েছে| সাজির উপর তাই সে ভিষণ ক্ষ্যাপা| তার নাম শুনলেই মুখ ভ্যংচে বলে ওঠে,
— গ্রামের লোকেরা কত বোকা! অতটুকু একটা মেয়ের কাছে চিকিৎসা নেয়|
বুধোর বাপ সাথে সাথেই প্রতিবাদ করে ওঠে|
— তুমিও তো বাবা সেই দশ-বারো বছর বয়স থেকে তাবীজ-তুমার করছো| দাদার কাছে আগেই শিখে নিয়েছিলে বিদ্যেটা তারপর একদিন স্বপ্নে কি যে দেখলে সেই থেকে স্বপ্নে পাওয়া চিকিৎসার নাম করে ব্যবসা খুলে বসলে| আমাদের সাজি তো আর তোমার মতো ব্যবসা করে না|
চুন খেয়ে মুখ পুড়ে গেলে যেমন ভাব হয়| বুধোর বাপের এই কথায় মানু কবিরাজের মুখের ভাবটা অবিকল তেমনই হয়ে যায়| রাগে গজগজ করতে থাকে কিন্তু মুখে কিছুই বলে না| জানে কথা বললে আরো গোপন খবর ফাঁস করে দেবে বুড়োটা| বয়স তার আশি-নব্বই হবে| গ্রামের এমন কোনো লোক নেই যাকে সে মায়ের পেট থেকে বের হতে দেখেনি| আবার ভাব দেখে মনে হচ্ছে সবার মরণ দেখে তবে সে মরবে| কারো খবর তার কাছে তাই গোপন নয়| তার সাথে তাই তর্ক চলে না|
গ্রামের আর পাঁচটা লোকও সাজিকে ভালবাসে আর পছন্দ করে| তার নামটি এখন সবার মুখে মুখে| এলী ম্যাডাম তাকে চিনতে পারছে না দেখে চম্পা তাই ভীষণ অবাক হয়| হাত দিয়ে পূর্ব দিকে ইশারা করে বলে,
— ঐ যে, মোল্লা বাড়ির মেয়ে ….
মোল্লা বাড়ির কথা শুনে এলী ম্যাডামের দুটি চোখ গোল্লা গোল্লা হয়ে যায়| এতক্ষণে তিনি সাজিকে চিনতে পারেন| তার নাম আগেও শুনেছেন বটে আর সাজি যে মোল্লা বাড়ির সাজিই হবে সেটাও তিনি বুঝতে পারছিলেন তবু মনে মনে চাচ্ছিলেন অন্য কেউ হোক| অন্য কেউ হলেই বোধ হয় তার ভাল হতো| এই এলাকায় এসে পর্যন্ত তিনি শুনছে মোল্লা বাড়ির কথা আর ঐ বাড়ির সাজি নামে একটা মেয়ের নানা কারসাজির কথা| গ্রামের লোকেরা স্কুলে ছাত্রী ভর্তি করাতে আসে আর বলে আমার মেয়েটাকে কিন্তু সাজির মতো তৈরী করে দিতে হবে| অনেক সময় ছেলের বাবারাও বলে সাজির মতো ছেলে বানিয়ে দিতে হবে আমার| প্রথমে এসব শুনে তিনি বিরক্ত হয়ে বলতেন,
— কে এই সাজি? কোন স্কুলে পড়ে সে?
উত্তরে তারা বলতো,
— এ হলো মোল্লা বাড়ির সাজি| কোনো স্কুলেই পড়ে না সে| তবে সবাইকে পড়ায়|
কথা শুনে তো চোখ চড়ক গাছে উঠে যায় এলী ম্যাডামের| ইচ্ছা হয় একবার দেখতেই যাবেন মেয়েটাকে| কিন্তু মোল্লা বাড়ি কথাটা শুনে তিনি পিছিয়ে আসেন| তার আর সাহস হয় না| বোধ হয় তার ভয় হয় মানুষের বাড়িতে যেমন চোর ধরার জন্য কুকুর থাকে মোল্লাদের বাড়িতে হয়তো বেধর্মী নাস্তিক ধরার জন্য কুকুর থাকে| গেলেই একেবারে খপ করে পায়ে কামড় বসিয়ে দেবে| কিংবা কে জানে হয়তো তার ভয় হয় মোল্লা বাড়ি গেলে তার নাস্তিক সহকর্মীদের কাছে তার মান থাকবে না| কিছুটা ভয় আর কিছুটা সংকোচের কারণেই এতদিন সাজির সাথে দেখা করা হয়নি তার| কিন্তু আজ তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন| এই মেয়েটার সাথে দেখা করতেই হবে|
সাজির সাজানো ঘর ইসলামীক গল্প এর ৩য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন