যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান বা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর

যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর এর প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে আপনার বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করুন।

উপরে আমরা স্পষ্ট উল্লেখ করেছি যে, কুফরী কাজে কাফিরদের সহযোগিতা করা কুফরী। এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে, কোনো পাপ কাজে যে কাউকে সহযোগিতা করা পাপ কাজ, কিন্তু কুফরী নয়। মূলনীতির আলোকে কোনো মুসলিম যদি তথ্য প্রদান করে বা অন্য কোনো উপায়ে মুসলিমদের বিপরীতে কাফিরদের সহযোগিতা করে তার ব্যাপারে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত বর্ণনা করা যায়। যদি সে কুফরীর প্রচার-প্রসারের উদ্দেশ্যে এবং ইসলাম ধর্মকে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে এটা করে তবে তা কুফরী বলে গণ্য হবে কিন্তু কেবল মাত্র পূর্ব শত্রুতা বা দুনিয়াবী মাল-সম্পদের লোভে যারা এমন করে তারা ভীষণ অপরাধী বলে গণ্য হবে তবে কাফির হবে না। বর্তমানে এই মাসয়ালাটি বিতর্কের লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত হয়েছে। তাই এ বিষয়ে সুবিস্তারে আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। সমসাময়িক আলেম ওলামাদের কেউ কেউ মুসলিম কিভাবে কাফির হয় সে প্রসঙ্গে নতুন একটি বিষয় সংযোজন করে থাকেন। তারা বলেন, “মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরদের যে কোনো প্রকার সহযোগিতা প্রদান করা কুফরী”। যদি কোনো মুসলিম এমনটি করে সে কাফির হবে। এ বিষয়ের উপর নির্ভর করে যেসব মুসলিম গোয়েন্দা কাফিরদের নিকট মুসলিমদের গোপন খবর পৌছে দেয় তারা তাদের কাফির বলেন। একইভাবে কাফির ও মুরতাদ রাষ্ট্রপ্রদানের অধীনে যেসব মুসলিম সৈন্য রয়েছে, তারা তাদের স্পষ্ট কাফির হিসেবে ঘোষণা করে থাকেন। কেউ কেউ এ বিষয়ে পূর্ববর্তী ওলামায়ে কিরামের ইজমা সম্পাদিত হয়েছে এমন অযৌক্তিক দাবী করে। সমসাময়িক যুগের কিছু আলেম এটা বর্ণনা করেছেন আর আবেগপ্রবন তরুনরা তা লুফে নিয়েছে। কুরআন হাদীসের দলীল প্রমাণ ও পূর্ববর্তী ওলামায়ে দ্বীনের মতামতের আলোকে বিষয়টি যাচাই করে দেখার মতো নিরপেক্ষতা খুব কম লোকই প্রদর্শন করেছে। আমরা এখানে সেই পদ্ধতিই অবলম্বন করতে চাই আর আল্লাহই তৌফিক দাতা।

শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব রঃ বলেন, ঈমান ভঙ্গের অষ্টম কারণ হলো মুসলিমদের বিপক্ষে মুশরিকদের সাহায্য করা। (নাওয়াকিদ আল ইসলাম)

শায়েখ আব্দুল ওয়াহহাব নজদীর অনুসারী সমসাময়িক অন্যান্য নজদী ও সালাফী ওলামায়ে কিরাম অনুরুপ কথা বলে থাকেন। কেউ কেউ এ বিষয়ে ইজমাও উল্লেখ করে থাকেন। এ বিষয়ে ইজমার প্রমাণ স্বরুপ অনেকে বলেন, ঈমান ভঙ্গের দশটি কারণের মধ্যে শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব এ বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন এটা প্রমাণ করে এ বিষয়ে ইজমা হয়েছে। অথচ এ দশটি বিষয়ের মধ্যে সপ্তম বিষয়টি হলো, জাদু। আর জাদু সম্পর্কে হানাফী ও শাফেঈ মাজহাবের স্পষ্ট মত হলো তা নিজে কুফরী নয় যতক্ষণ না তার মধ্যে অন্য কোনো কুফরী পাওয়া যায়। এটাই প্রামাণ করে ইজমা উল্লেখের ব্যাপারে তারা কতটা অসতর্ক।

এ বিষয়ে ইজমা উল্লেখ করে শায়েখ বিন বায বলেন, মুসলিম উম্মার আলেমরা ইজমা করেছেন, যে ব্যক্তি মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরদের যে কোনো প্রকার সহযোগিতা প্রদান করে সে তাদের মতই কাফির হবে। (মাজমুয়ায়ে কাতাওয়ায়ে বিন বায)

এই সকল ওলামায়ে দ্বীন কি উদ্দেশ্যে এই মূলনীতিটি বর্ণনা করেছেন তা স্পষ্ট নয় তবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, যারা এই সকল মূলনীতিটি অকাট্য ও অলংঘনীয় হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং এর উপর নির্ভর করে মুসলিমদের বিপরীতে কাফির-মুশরিক ও মুরতাদ শাসকের অধীনে সৈনিক হিসেবে কর্মরত থাকে সে কাফির প্রমাণিত হয়। অথচ এই ধরনের ব্যক্তি কাফির না হওয়ার পক্ষে ওলামায়ে কিরামের স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে যা আমরা পরবর্তীতে বর্ণনা করবো ইনশাআল্লাহ।

শায়েখ বিন বায যে ইজমা উল্লেখ করেছেন তার মাধ্যমে তিনি কি উদ্দেশ্য করেছেন সে বিষয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়, কারণ তিনি নিজে ইরাকের সাবেক রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেনকে কুফরী মতবাদে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে কাফির হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু তার সাথে সহযোগী মুসলিম সৈন্যরা যদি তার মতবাদে বিশ্বাসী না হয় তবে কাফির হবে না এমন মন্তব্য করেছেন। সাদ্দাম হোসেন কাফির কিনা সে সম্পর্কে একটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,

সে কাফির, যদিও সে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করে, এমনকি যদি সলাত-সওমও পালন করে যতক্ষণ না সে, ধর্মদ্রোহী বা’ছ মতবাদ হলো, কুফরী ও পথভ্রষ্টতা। অতএব, তা থেকে তওবা না করা পর্যন্ত সে কাফির (মাজমুয়ায়ে ফাতাওয়ায়ে ইবনে বায)

অন্য এক স্থানে তিনি বলেন,

সাদ্দাম ইয়াহুদী খৃষ্টানদে চেয়ে বেশি কাফের। (মাজমুয়ায়ে ফাতাওয়ায়ৈ ইবনে বায)

কিন্তু সাদ্দাম হোসেনের সহযোগি মুসলিম সৈনিকদের তিনি কাফির বলেন নি। সাদ্দাম হোসেন কুয়েতের উপর হামলা করলে বিন বায মুসলিমদের তার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে নির্দেশ দেন। সাদ্দাম হোসেনকে ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের চেয়ে অধিক কাফির হিসেবে ঘোষণা করেন এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা পবিত্র জিহাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাকে প্রশ্ন করা হয় সাদ্দামের পক্ষে তো অনেক মুসলিম লড়াই করছে। তিনি বলেন,

যে মুসলিম সাদ্দামের পক্ষে যুদ্ধ করছে তার ব্যাপারে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ভয় রয়েছে যেহেতু সে জুলুম-অত্যাচারের ব্যাপারে তাকে সহযোগিতা করছে। সে কাফির হয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কাও রয়েছে যদি সে তার (সাদ্দামের) কুফরী মতবাদ গ্রহণ করে অথবা মুসলিমদের হত্যা করা বৈধ মনে করে। (মাজমুয়ায়ে ফাতাওয়ায়ে ইবনে বায)

অর্থাৎ তিনি কুফরী মতবাদ গ্রহণ করা বা মুসলিমকে হত্যা করার মতো হারাম কাজকে হালাল মনে করা ছাড়া কেবলমাত্র মুসলিমদের বিপক্ষে সাদ্দামের মতো একজন কাফির সর্দারকে সহযোগিতা করা কুফরী বলে মনে করেন নি।

সুতরাং “মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরদের যে কোনো সহযোগিতা প্রদান করা কুফরী” ইবনে বায নিজেও এই ফতোয়াটি সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য মনে করেন নি। বরং যে ব্যক্তি কাফিরদের কুফরী মতবাদ গ্রহণ করে তাদের সহযোগিতায় লিপ্ত হয় তার ব্যাপারে এটা প্রয়োগ করেছেন। শায়েখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব নজদীর কথার উদ্দেশ্যেও এমন হতে পারে। শায়েখ সালিহ্ আল-ফাওজান নাওয়াকিদুল ইসলামের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শায়েখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব নজদীর উপরোক্ত কথার ব্যাখ্যায় “কাফিরদের সহযোগিতা করার বিষয়টিকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছন। সেখানে তিনি বলেন, যদি কেউ কাফিরদের দ্বীনকে ভালবাসে এবং তারা যা কিছু করে তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে স্বেচ্ছায় তাদের সহযোগিতা করে তাবে এটা হবে বড় কুফর যার মাধ্যমে সে আল্লাহর দ্বীন থেকে বের হয়ে যাবে। (দারুস ফি শারহি নাওয়াকিদিল ইসলাম)

এরপর তিনি বলেন, যে কেউ মুসলিমদের বিপক্ষে কাফিরদের স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করে কিন্তু সে কাফিরদের দ্বীনকে ঘৃণা করে এবং সেটা মেনে না নেই তবে নিঃসন্দেহে এটা কবীরা গোনা হিসেবে গণ্য হবে আর এই ব্যক্তির ব্যাপারে কাফির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। (দারুস ফি শারহি নাওয়াকিদিল ইসলাম)

তিনি বলেছেন, কাফির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এর অর্থ কাফিরদের দ্বীন মেনে না নিয়ে তাদের সহযোগিতা করা স্পষ্ট কুফরী নয় তাই এর মাধ্যমে কোনো মুসলিমকে কাফির বলা যাবে না। যেহেতু আশঙ্কা বা সম্ভাবনার উপর নির্ভর করে কোনো মুসলিমকে কাফির বলা যায় না। এটা সর্ব স্বীকৃত মূলনীতি যেমনটি আমরা পূর্বে বহুবার বলেছি।

শায়েখ সলিহ্ আল-ফাওজান যে ব্যাখ্যা করেছেন শায়েখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব নাজদীর কথার ব্যাখ্যা যদি এটিই হয় তবে তা নিঃসন্দেহে সঠিক। এ ব্যাপারে ইজমা উল্লেখ করাও সঠিক। কিন্তু যদি শায়েখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব নাজদীর কথা থেকে এমন প্রমাণ করা হয় যে, মুসলিমদের বিপরীতে কাফিরদের যে কোনো প্রকার সহযোগিতা প্রদান করা সর্বাবস্থায় কুফরী হবে তবে তা উম্মতে মুসলিমার আলেমদের মতামতের আলোকে স্পষ্ট ভ্রান্তি হিসেবে গণ্য হবে।

এ মূলনীতিটির স্বপক্ষে একটি আয়াত বারবার পেশ করা হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ইমানদাররা, তোমরা ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে কেউ তাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে সে তাদের মধ্যেই অন্তর্ভূক্ত হয়। (সুরা মায়েদা-৫১)

কুরআন-হাদীস হতে কোনো বিষয়ে দলিল পেশ করা এবং তার আলোকে বিভিন্ন বিধি-বিধান প্রমাণ করার পন্থা পদ্ধতি সম্পর্কে যারা অবগত নয়, তারা এই আয়াতটিকে “মুসলিমদের বিপক্ষে কাফিরদের সহযোগিতা করা কুফরী” এ মূলনীতির স্বপক্ষে অকাট্য ও অলঙ্ঘনীয় দলিল হিসেবে মনে করে। সত্য কথা হলো, এই আয়াতটি হতে কোনো বিধান প্রমাণ করার জন্য সুক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। যেহেতু এখানে স্পষ্ট করে এমন বলা হয়নি যে, “মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সহায্য যে করে সে কাফির হয়ে যায়।” বরং এখানে বলা হয়েছে, “মুসলিমদের মধ্যে যে কেউ কাফিরদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে সে তাদের মধ্যে অন্তভূক্ত”। সুতরাং আয়াতটির দুটি অংশ রয়েছে।

ক। কাফিরদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা।

খ। যে এটা করে সে কাফিরদের মধ্যে অন্তভূক্ত হওয়া।

এই আয়াতটি হতে “মুসলিমদের বিপক্ষে কাফিরদের সহযোগিতা করা কুফরী” এটা প্রমাণ করতে হলে এর দুটি অংশের উপরই বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্ন, বন্ধু গ্রহণ করা বলতে কি বোঝায়?

বন্ধু গ্রহণ করা অর্থে উপরোক্ত আয়াতে আরবী শব্দ তাওয়াল্লী ব্যাবহার করা হয়েছে, যা মূল শব্দ, ওয়ালাইয়া বা ওয়ালা থেকে উদগত। যার অর্থ নিকটবর্তী হওয়া, ভালবাসা, সাহায্য করা, সম্পর্ক গড়া ইত্যাদি। (মু’জামুল ওয়াসিত) বাংলাতে বন্ধু গ্রহণ করা বা সম্পর্কিত হওয়া এখানে সমার্থবোধক শব্দ। এ দৃষ্টিকোন থেকে চিন্তা করলে দেখা যাবে, কাফিরদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন,

ক। ইসলামের বিপরীতে কাফিরদে ধর্ম মেনে নেওয়া।

খ। কাফিরদের সাথে ওঠা-বসা ও চলা-ফেরা করা।

গ। যুদ্ধ-বিগ্রহে কাফিরদের পক্ষাবল্বন করা।

ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়কে বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক হিসেবে গণ্য করা যায়। এখন প্রশ্ন হলো, উপরোক্ত আয়াতের অর্থ কি এটা যে, কাফিরদের সাথে যে কোনো প্রকার বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক স্থাপন করাই কুফরী হবে?

স্বাভাবিক চিন্তার মাধ্যমেই এটা অসম্ভব প্রমাণিত হয়।

যদি কোনো মসলিম হিন্দু বন্ধু-বান্ধবের সাথে ওঠা-বসা বা চলা-ফেরা করে তাকে কাফির বলা যেতে পারে না। যদিও এ কাজ প্রশংসিত নয়।

আত্নীয়তার বন্ধনের কারণে বা অন্য কোনো বৈধ কারণে কোনো কাফিরকে ভালবাসলে সেটি কুফরীও নয় নিষিদ্ধও নয়।

আল্লাহ তায়ালার রসুল সাঃ কে বলেন, আপনি যাকে ভালবাসেন তাকে তো পথ প্রদর্শন করতে সক্ষম নন। (সুরা কাসাস-৫৬)

মুফাসসিরীনে কিরামের নিকট এই আয়াতের একটি অর্থ হলো, রাসুলুল্লাহ সাঃ আবু তালেবকে আত্নীয়তার বন্ধনের কারণে ভালবাসতেন তাই তার হেদায়েত কামণা করতেন কিন্তু আল্লাহ্ তাকে জানিয়ে দেন যে, আপনি যাকে ভালবাসেন তাকে পথ প্রদর্শন করতে পারেন না বরং আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন। (আল-মাওরুদী তার তাফসীরে)

কাফিরদের প্রতি এই প্রকৃতির ভালবাসা নিষিদ্ধ নয়।

এমনকি শরীয়তে নিষিদ্ধ পন্থায় কাফিরদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলাও ক্ষেত্র বিশেষে কুফরী না হতে পারে। যদি কোনো মুসলিম পুরুষ একজন হিন্দু মহিলার সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং তার সাথে জেনা-ব্যাভিচারে লিপ্ত হয় তবু এই ব্যক্তিকে কাফির বলা যায় না। যদিও একাজ ঘৃণিত পাপ হিসেবে গণ্য।

মুসলিমদের বিপক্ষে কাফিরদের সহযোগিতা করার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এর মাধ্যমে কাফিরদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং তাদের সাথে সম্পর্ক করা হয় এটা সঠিক কিন্তু এটা কুফরী বলা যেতে পারে না যদিও এটা মারাত্মক অপরাধ। যেহেতু পাপ ও অপরাধের কারণে কোনো মুসলিমকে কাফির বলা যায় না যতক্ষণ না সে কাফিরদের ধর্মকে পছন্দ করে বা তাদের কুফরীর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাদের পক্ষাবলম্বন করে।

যদি প্রথম অংশের অর্থ ধরা হয়, কাফিরদের সাথে যে কোনো প্রকার বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক করা তবে দ্বিতীয় অংশে “সে তাদের মধ্যেই অন্তর্ভূক্ত” এর মাধ্যমে সে কাফির এমন অর্থ করা যাবে না। বরং এর উদ্দেশ্য হবে অধিক কঠোরতা প্রদর্শন। যেমনটি আমরা পূর্বেও বেশ কিছু আয়াত ও হাদীসের ক্ষেত্রে দেখেছি।

অন্য হাদীসে বলা হয়েছে, “যে কেউ কোনো সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য রাখে সে তাদের মধ্যেই অন্তর্ভূক্ত” [আবু দাউদ] (হাফিজ ইবনে হাজার আসক্বলানী রঃ বলেন, “হাদিসটিকে আবুদাউদ হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন। {ফাতহুল বারী} অন্য স্থানে তিনি বলেন, হাদীসটি আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন এবং ইবনে হিব্বাস সহীহ্ বলেছেন” শায়েখ আলবানীও হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। মিশকাত-৪৩৪৭) এই হাদীসটির অর্থের ব্যাপারে সকল ওলামায়ে কিরাম একমত যে, কাফিরদের সাথে যে কোনো প্রকার সাদৃশ্য রাখলেই একজন মুসলিম কাফির হয়ে যাবে তা নয় বরং হাদীসটির উদ্দেশ্য অধিক কঠোরতা প্রদর্শন করা এবং এধরণের কাজ থেকে সতর্ক করা। মোট কথা আয়াতটির প্রথম অংশে যদি আমরা সকল প্রকার বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক বুঝি তবে শেষের অংশে কুফরী নয় বরং পাপ ও নিষিদ্ধ কর্ম বুঝতে হবে এবং সেক্ষেত্রেও বন্ধুত্ব ও সম্পর্কের কিছু বিষয় এই আয়াতের বাইরে থাকবে যেহেতু কাফিরদের সাথে সম্পর্ক রাখা কিছু ক্ষেত্রে বৈধ যেমনটি আমরা দেখেছি।

আর যদি দ্বিতীয় অংশের অর্থ করা হয়, “সে কাফির হবে” তবে প্রথম অংশে বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক বলতে কাফিরদের সাথে যে কোনো প্রকার বন্ধুত্ব বোঝাবে না। বরং তাদের দ্বীন গ্রহণ করা এবং তাদের কুফরী আক্বীদা-বিশ্বাসকে মেনে নেওয়ার মাধ্যমে তাদের সাথে বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক করা বোঝাবে।

ইমাম আল-মাওরুদী রঃ তার তাফসীরে বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে কেউ তাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে সে তাদের মধ্যেই অন্তর্ভূক্ত হবে” এর দুটি অর্থ রয়েছে,

১। কাজে-কর্মে তাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা। সেক্ষেত্রে তাদের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হওয়া অর্থ আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার ব্যাপারে। (অর্থাৎ সে পাপী হবে, কাফির হবে না)।

২। যদি তাদের দ্বীন (ধর্ম) মেনে নিয়ে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা হয় তবে এখানে কুফরীর ব্যাপারেই তাদের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হবে (এই ব্যক্তি কাফির হবে)। [আন-নিকাত ওয়াল উয়ূন]

এই আয়াতটি যে, কুফরী ধর্ম গ্রহণের ব্যাপারে এ সম্পর্কে ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণনা রয়েছে। ইমাম মালিক রঃ তার মুয়াত্তায় বর্ণনা করেন, যেসব আরব পরবর্তীতে খৃষ্টান হয়ে গিয়েছিল, অন্যান্য খৃষ্টানদের মতো তাদের যবেহ করা পশুর মাংস খাওয়া যাবে কি না সে সম্পর্কে ইবনে আব্বাসকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এত কোনো সমস্যা নেই এবং এই আয়াতটি তেলাওয়াত করেন”

আল্লাহ তায়ালা ইয়াহুদী ও খৃষ্টনদের যবেহ করা পশুর মাংস খাওয়া মুসলিমদের জন্য বৈধ করেছেন। (সুরা মায়েদা-৫) এ আয়াতের উপর নির্ভর করে জন্মগত ইয়াহুদী-খৃষ্টানদের যবেহ করা পশু খাওয়া সকল আলেম বৈধ বলেছেন। কিন্তু যারা জন্মগত খৃষ্টান নয় তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, অগ্নিপূজা ইত্যাদি ধর্ম থেকে ইয়াহুদী বা খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে তাদের যবেহ করা পশু খাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়ে আলেমদের মাঝে দ্বিমত আছে। যারা এই ধরনের ইয়াহুদী-খৃষ্টানদের যবেহ করা পশু খাওয়া যাবে এমন মত দিয়েছেন তারা এই আয়াত থেকে দলিল পেশ করেছেন। যেহেতু এখানে বলা হয়েছে যে কেউ ইয়াহুদী খৃষ্টানদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে সে তাদের মধ্যেই অন্তর্ভূক্ত হয়। অর্থাৎ যে কেউ ইয়াহুদী খৃষ্টানদের ধর্ম গ্রহণ করে সে তাদের মধ্যেই অন্তর্ভূক্ত হবে। ফলে তার উপর তাদের যাবতীয় বিধান প্রযোজ্য হবে। মুসলিমদের জন্য তার যবেহ করা পশু খাওয়া এবং তার কন্যা বিবাহ করা বৈধ হবে ইত্যাদি। ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত উপরোক্ত বর্ণনাটিতে এ কথাই বলা হয়েছে।

এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, উপরোক্ত আয়াতটি ব্যবহার করে, “মুসলিমদের বিপক্ষে কাফিরদের যে কোনো প্রকার সহযোগিতা প্রদান করা কুফরী” এই মূলনীতি সাব্যস্ত করা সম্ভব নয়। পূর্ববর্তী ওলামায়ে কিরামের কারো স্পষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমে এই মুলনীতি সাব্যস্ত করা সম্ভব নয়। কেউ কেউ ইমাম কুরতুবী, ইবনে জারীর তাবারী, ইমাম বাগাবী প্রমুখ ওলামায়ে দ্বীনের কথা ভুলভাবে উপস্থাপণের মাধ্যমে বিষয়টি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু তা সম্ভব নয়। কারণ, এই সকল ওলামায়ে কিরামের যে কথার মাধ্যমে বিষয়টি প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় তা অস্পষ্ট এবং তার বিপরীতে তাদের স্পষ্ট বক্তব্য বিদ্যামান রয়েছে।

ইমাম কুরতুবী রঃ থেকে উল্লেখ করা হয়, তিনি সূরা মায়েদার উপরোক্ত আয়াতটির ব্যাখ্যায় বলেন, “যে কেউ তাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে” অর্থাৎ তাদের মুসলিমদের বিপক্ষে সাহায্য করে “তবে সে তাদের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত” আল্লাহ স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে, তার বিধান তাদের মতই হবে। এটা প্রামাণ করে, কোনো মসলিম মুরতাদের ওয়ারিশ হবে না। কাফিরদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিল আব্দুল্লহ্ ইবনে উবাই। আর সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া (মুসলিম মুরতাদের ওয়ারিশ না হওয়া) কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। (তাফসীরে কুরতুবী)

ইমাম কুরতুবীর এই কথাটিকে “যে কেউ মুসলিমদের বিপরীতে কাফিরদের যে কোনো প্রকার সহায়তা প্রদান করে সে কাফির” এ বিষয়ে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যুক্তি যুক্ত নয়। কারণ, ইমাম কুরতুবী এখানে “তারা কাফিরদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে” এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, “তারা মুসলিমদের বিপক্ষে তাদের সাহায্য করে” কি প্রকার সাহায্য তা তিনি স্পষ্ট করেননি। যদি ধরে নেওয়া হয়, ইমাম কুরতুবী এখানে যে কোনো প্রকার সাহায্য উদ্দেশ্য করেছেন এবং তার উপর কুফরীর বিধান জারী করেছেন তবে তা ভুল হবে কারণ অন্য স্থানে তিনি স্পষ্ট বলেন,

যে ব্যক্তি বারবার মুসলিমদের গোপন বিষয় কাফিরদের নিকট ফাস করে সে একাজের মাধ্যমে কাফির হবে না। যদি তার এ কাজ দুনিয়াবী কোনো উদ্দেশ্যে হয় এবং তার আকীদা সঠিক থাকে যেমনটি হাতিব রাঃ করেছেন যেহেতু তিনি তার আত্মীয় স্বজনদের নিরাপত্তার জন্য একাজ করেছিলেন দ্বীন ত্যাগের উদ্দেশ্যে নয়। (তাফসীরে কুরতুবী)

সুতরাং মুসলিমদের গোপন খবর কাফিরদের নিকট নিয়মিত আদান-প্রদানের মাধ্যমে কাফিরদের সাহায্য করা ইমাম কুরতুবী রঃ কুফরী ও দ্বীনত্যাগ বলে মনে করেন নি। অতএব, উপরের উদ্ধৃতিতে “মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সাহায্য করে” ইমাম কুরতুবীর এ কথাটি যে কোনো প্রকার ও যে কোনো অবস্থানে সাহায্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এর স্পষ্ট অর্থ হলো, ইমাম কুরতুবী মুসলিমদের বিপক্ষে কাফিরদের সাহায্য করা সর্বাবস্থায় কুফরী হবে এটা মনে করেন না। এখানে বড় জোর এতটুকু প্রমাণিত হয় যে, তিনি মুসলিমদের বিপরীতে কাফিরদের সহযোগিতা করা কোনো কোনো অবস্থায় কুফরী হতে পারে এমন মনে করেন। মুসলিম গোয়েন্দার ব্যাপারে তার মতামত স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, অন্য সকল ওলামায়ে কিরামের মতো ইমাম কুরতুবীও আল্লাহর দ্বীন ত্যাগের উদ্দেশ্য ছাড়াই এবং কাফিরদের দ্বীনকে পছন্দ না করেই কেবলমাত্র মুসলিমদের বিপরীতে কাফিরদের সহায়তা করা কুফরী মনে করেন না। অতএব, “মুসলিমদের বিপরীতে কাফিরদের যে কোনো প্রকার সহায়তা করা কুফরী মনে করেন না। অতএব, “মুসলিমদের বিপরীতে কাফিরদের যে কোনো প্রকার সহায়তা প্রদান করা কুফরী” এ মতের স্বপক্ষে ইমাম কুরতুবীর এই কথাটি উপস্থাপন করা স্পষ্ট জুলুম ও অজ্ঞতা ছাড়া কিছু নয়। একজন আলেমের স্পষ্ট বক্তব্য পরিত্যাগ করে তার অস্পষ্ট ও ব্যাখ্যা স্বাপেক্ষ্য মতামতের মাধ্যমে কোনো বিষয় প্রমান করার চেষ্টা কখনই সুবিবেচনা বলে গণ্য হতে পারে না।

এ বিষয়ে ইমাম বাগাবীর যে কথাটি উল্লেখ করা হয় সেটিও অনুরুপ। সূরা ইমরানের ২৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন,

“যে কেউ এমন করে” অর্থাৎ যে কেউ মুসলিমদের গোপন খবর কাফিরদের নিকট পাচার করার মাধ্যমে কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব করে। “তার সাথে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক নেই” অর্থাৎ তার সাথে আল্লাহর দ্বীনের কোনো সম্পর্ক নেই। (তাফসীরে বাগাবী)

তারা বলেন, ইমাম বাগাবী রঃ বলেছেন, তার সাথে আল্লাহর দ্বীনের কোনো সম্পর্ক নেই অর্থাৎ সে মুরতাদ। এখানে দুটি মারাত্মক ভ্রান্তি রয়েছে। প্রথমত আল্লাহর দ্বীনের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই এর অর্থ সে কাফির হয়ে গেছে এমন মনে করা সঠিক নয়। এধরণের বাক্য সাধারণত কঠোরতা উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। রাসুলুল্লাহ সাঃ খারেজীদের সম্পর্কে বলেছেন, যেভাবে তীর ধনুক থেকে বের হয়ে যায় তারা আল্লাহর দ্বীন থেকে সেভাবে বের হয়ে যাবে। এ সত্ত্বেও বেশিরভাগ ওলামায়ে কিরাম খারেজীদের কাফির বলেন নি। সুতরাং ইমাম বাগাবী রঃ বলেছেন, যে মুসলিমদের গোপন খবর কাফিরদের নিকট পাচার করে তার সাথে আল্লাহর দ্বীনের কোনো সম্পর্ক নেই অতএব তিনি গোয়েন্দাকে কাফির বলছেন এমন মন্তব্য করা ভীষণ অসচেতনতা হিসেবে গণ্য। এর চেয়েও বেশি অসতর্কতা ও অসচেতনতা হলো, গোয়েন্দা সম্পর্কে ইমাম বাগাবীর স্পষ্ট ফতোয়াকে পরিত্যাগ করা। তিনি গোয়েন্দার বিধান সম্পর্কে স্পষ্ট বলেন,

জিম্মী কাফিরদের মধ্যে যে কেউ কাফিরদের পক্ষ হয়ে গোয়েন্দাগিরী করে তার সাথে চুক্তি ভঙ্গ হবে না (তাকে হত্যা করা হবে না)। যদি কোনো মুসলিম এটা করে তবে তাকে হত্যা করা বৈধ হবে না বরং অন্য কোনো শাস্তি দেওয়া হবে। (শারহুস সুন্নাহ)

সুতরাং শাফেঈ মাযহাবের অন্যান্য আলেমদের মতো ইমাম বাগাবীও মুসলিম গোয়েন্দাকে হত্যা করা বৈধ মনে করেন না। এই স্পষ্ট ফতোয়াটি পরিত্যাগ করে উপরোক্ত কথাটির মাধ্যমে ইমাম বাগাবী মুসলিম গোয়েন্দাকে মুরতাদ মনে করেন এমন দাবী করা কিভাবে সুবিচার হতে পারে!

এ বিষয়ে ইবনে জারীর তাবারী রঃ হতে যে কথাটি বর্ণনা করা হয় তা আরো স্পষ্ট। সূরা আলে ইমরানের আয়াতটির ব্যাখ্যায় তিনি বলেন,

আয়াতটির অর্থ হলো, হে মুমিনরা, তোমরা কাফিরদের পৃষ্ঠপোষক ও সাহায্যকারী হিসেবে গ্রহণ করো না যে, তোমরা তাদের দ্বীন মেনে নিয়ে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, মুসলিমদের পরিবর্তে তাদের সহযোগিতা করবে এবং মুসলিমদের গোপন খবর তাদের জানিয়ে দেবে। যে এমন করবে আল্লাহর সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই । এর অর্থ সে কুফরীর মধ্যে প্রবেশ করে আল্লাহর দ্বীন পরিত্যাগ করার কারণে আল্লাহর সাথে সম্পর্কহীন হয়ে যাবে।

এরপর তিনি নিজের কথার স্বপক্ষে ইমাম সুদ্দী থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেছেন, এখানে বন্ধু গ্রহণ করা বলতে বোঝানো হয়েছে, তাদের ধর্মের ব্যাপারে তাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা এবং তাদের নিকট মুসলিমদের গোপন খবর ফাস করে দেওয়া। যে এটা করে সে মুশরিক। সে আল্লাহর সাথে সম্পর্কহীন। (তাফসীরে তাবারী)

এই বর্ণনাটি উল্লেখ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় কাফিরদের নিকট মুসলিমদের গোপন সংবাদ বলে দেওয়া ইবনে জারীর তাবারীর নিকট কুফরী হিসেবে গণ্য। অথচ ইবনে জারীর তাবারী নিজে এবং ইমাম সুদ্দী থেকে যে তাফসীর তিনি উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে মুসলিমদের সংবাদ কাফিরদের জানিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছন। সুতরাং কেবলমাত্র গোয়েন্দা সম্পর্কে তারা এ বিধান দেন নি বরং যে গোয়েন্দা কাফিরদের ধর্মকে মেনে নেয় এবং মুসলিমদের গোপন সংবাদ সম্পর্কে তাদের অবহিত করে ইবনে জারীর তাবারী ও ইমাম সুদ্দী তাদের কাফির হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অতএব, তাদের এ কথার মাধ্যমে উপরেক্ত মূলনীতি প্রমাণিত হয় না।

সূরা মায়েদার আয়াতটি সম্পর্কে ইবনে হিযাম রঃ বলেন, এটা সঠিক যে, আল্লাহর বাণী, “তোমাদের মধ্যে যে কেউ তাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে সে তাদের মধ্যেই অন্তর্ভূক্ত হয়। এই আয়াতটির বাহ্যিক অর্থই গ্রহণ যোগ্য যে সে কাফির হবে। সাধারন ভাবে সে কেবল কাফির হবে। এ বিষয়ে দুজন মুসলিমও দ্বিমত করতে পারে না। (আল-মুহাল্লা)

এই উদ্ধৃতিটি উল্লেখ করে কেউ কেউ দাবী করেন, মুসলিমদের বিপক্ষে কাফিরদের সহযোগিতা করা কুফরী এ ব্যাপারে ইবনে হিযাম রঃ ইজমা উল্লেখ করেছেন। এমন দাবী তাদের নির্বুদ্ধিতার প্রমান বহন করে। ইবনে হিযাম রঃ কি প্রসঙ্গে আলোচনা করছেন এবং কি উদ্দেশ্যে উপরোক্ত কথাটি বলেছেন তারা সেটা লক্ষ্য করেন নি।

রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, ইসলাম গ্রহণ করলে পূর্বের সকল পাপ মাফ হয়ে যায়। (মুসনাদে আহমদ) এ বিষয়ে উম্মতের ওলামায়ে কিরাম একমত পোষণ করেছেন যে, জন্মগত কাফির যদি মুসলিম হয় তবে তার পূর্বের যে কোনো অপরাধ মাফ হয়ে যাবে। এমনকি যদি সে মুশরিক থাকা অবস্থায় কোনো মুসলিমকে হত্যা করার পর মুসলিম হয়ে যায় তবে সে মৃত্যুদন্ড থেকে বেচেঁ যাবে। কিন্তু যদি কোনো মুসলিম এধরণের অপরাধ করে কাফির হয়ে যায় এই মুরতাদ যদি পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয় তবে তার এ অপরাধ ক্ষমা হবে কিনা সে বিষয়ে দ্বিমত আছে। যারা জন্মগত কাফিরের মতোই উক্ত মুরতাদের অপরাধ ক্ষমা হবে এমন মত দিয়েছেন তারানিজেদের স্বপক্ষে উপরোক্ত আয়াতটিকে দলিল হিসেবে উপস্থাপণ করেছেন যেখানে আল্লাহ বলেন, “যে কেউ তাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহন করে সে তাদের মধ্যেই অন্তর্ভূক্ত হবে।” তারা বলেন, যেহেতু ইসলাম পরিত্যাগ করে যে কাফির হয়ে যায় সে কাফির বলেই গণ্য হবে অতএব, একজন জন্মগত কাফির যেমন ইসলাম গ্রহণ করলে তার পূর্বের অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া হয় একইভাবে ইসলাম পরিত্যাগ করে যে কাফির হয়ে যায় তথা মুরতাদ যদি পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করে তবে তার পূর্বের অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।

এই প্রসঙ্গে ইবনে হিযাম উপরোক্ত কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, “সাধারন ভাবে সে কেবল কাফির” অর্থাৎ এ আয়াত প্রমাণ করে যে, ইসলাম ত্যাগ করে যে কাফির হয়ে যায় সেও কাফির কিন্তু সকল ব্যাপারে জন্মগত কাফিরদের সাথে তার বিধান একই হবে এটা সঠিক নয়। এ অর্থে তিনি বলেছেন, “এ ব্যাপারে দুজন মুসলিমও দ্বিমত করতে পারে না।” অর্থাৎ মুরতাদ যে কাফির তার ব্যাপারে দুজন মুসলিমও দ্বিমত করতে পারে না।

যারা মনে করে, “মুসলিমদের বিপরীতে কাফিরদের সহযোগিতা করা কুফরী” এ ব্যাপারে ইবনে হিযাম রঃ কেউ দ্বীমত করতে পারে না একথা বলেছেন এটা তাদের অন্যান্য অজ্ঞতার মধ্যে একটি বাড়তি সংযোজন ছাড়া কিছু নয়। তবে এ বিষয়ে ইবনে হিযাম রঃ থেকে আরেকটি ফতোয়া আছে। যে মুসলিম ইসলামী রাষ্ট্র পরিত্যাগ করে কাফিরদের রাষ্ট্রে চলে যায় সে কি মুরতাদ হবে? এই শিরোনামে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, “যে মুসলিম মুশরিকদের এলাকায় বসবাস করে তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই” (আবু দাউদ)[এই হাদীসটি সহীহ এর সনদ সম্পর্কে বিস্তারিত কথা পূর্বে গত হয়েছে এই হাদীসটি উল্লেখ করে তিনি (ইবনে হিযাম) বলেন,

এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, যে ব্যক্তি কাফিরদের এলাকায় বসবাস করে এবং আশেপাশের মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় সে এই কাজের মাধ্যমে মুরতাদে পরিনত হয়। মুরতাদের যাবতীয় বিধান তার উপর প্রযোজ্য হয়। তাকে পাকড়াও করতে সক্ষম হলে হত্যা করা ওয়াজিব হয়, তার সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া বৈধ হয়। তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয় ইত্যাদি। যেহেতু রাসুল্লাহ সাঃ যার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন সে মুসলিম হতে পারে না। (আল-মুহাল্লাহ)

তিনি আরো বলেন, যদি সে সেখানে (কাফিরদের রাষ্ট্রে) অবস্থান করে মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এবং কাফিরদের সেবা-যত্ন বা লেখালেখির মাধ্যমে সহযোগিতা করে তবে সে কাফির হবে। (আল-মুহাল্লা)

এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় যে, ইবনে হিযাম রঃ এ বিষয়ে যে মত বর্ণনা করেছেন সে বিষয়ে ইজমা উল্লেখ করেন নি। শুধু তাই নয়, তিনি এ বিষয়ে অন্য কোনো আলেমের মতও বর্ণনা করেন নি। এর অর্থ উপরোক্ত মতামতটি একান্তই তার নিজস্ব মত।

ইবনে হিযাম রঃ এর পন্থা-পদ্ধতি সম্পর্কে যারা জানেন তারা অবগত আছেন যে, তিনি শরীয়তের ব্যাপারে মতমত বর্ণনার ক্ষেত্রে নিজে যা যঠিক মনে করেন সেটাই ব্যক্ত করেন যদিও তা সমস্ত ফুকাহায়ে কিরামের মতের বিরুদ্ধে হয়। একারণে বহু ক্ষেত্রে তিনি বিরল ও অগ্রহণযোগ্য মতামত ব্যাক্ত করেছন। ইমাম যাহাবী রঃ এ সম্পর্কে বলেন, তাকে বিরল মত গ্রহণ করার দোষে দুষ্ট করা হয়েছে। এরপর তিনি জাহেরীদের মাজহাব গ্রহণ করেন, তাদের মতামত বিন্যাস্ত করেন সেই মতের পক্ষে তর্ক-বিতর্ক করেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এর উপরই টিকে থাকেন। (সিয়ার)

এ সম্পর্কে তিনি (ইবনে হিযাম) নিজেই বলেন, আমার কিছু নির্বোধ প্রতিপক্ষ আমাকে দোষ দিয়ে বলে, আমি যে বিষয় সঠিক মনে করি সে বিষয়ে অন্য কারো মতের দিকে ভ্রুক্ষেপ করি না যদিও সেটা সারা পৃথিবীর লোকের বিপরীতে হয়।

এরপর তিনি বলেন, এটা আমার এমন একটি গুণ যার তুলনা হয় না। যদি এটা আমার মধ্যে না থাকতো – আর আল্লাহর কাছেই আশ্রয় চায় – তবে আমার সৃষ্টিকর্তার নিকট এটি আমি সর্বাধিক গুরুত্বসহকারে প্রার্থনা করতাম। (রাসায়েলে ইবনে হিযাম)

ওলামায়ে কিরামের মতামত থেকে ইবনে হিযামের এই বিমুখীতা সঠিক পন্থা কিনা সে বিষয়ে আলোচনা এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, ইবনে হিযাম রঃ যখন এককভাবে কোন মতামত উল্লেখ করেন তখন তার সমসাময়িক বা তার পূর্বের অন্যান্য ফুকাহায়ে কিরামের পক্ষ থেকে তা বলেন না। সুতরাং মতটিকে তার একক মত হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

এটা জেনে নেওয়ার পর কথা হলো, ইবনে হিযামের উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে “মুসলিমদের বিপক্ষে কাফিরদের যে কোনভাবে সহায়তা প্রদান করা কুফরী” এভাবে বলেন নি। বরং ইসলামী রাষ্ট্র থেকে কাফিরদের রাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়া বা কাফিরদের রাষ্ট্রে অবস্থান করে তাদের সাহায্য করা এসব ব্যাপারে কুফরীর ফতোয়া আরোপ করেছেন। তার আলোচনার শিরোনামও তাই। তিনি যে হাদীস থেকে দলিল পেশ করেছেন সেখানে কাফিরদের রাষ্ট্রে অবস্থানের বিষয়েই আলোচনা এসেছে। এই আলোচনার আগে ও পরে কাফিরদের রাষ্ট্রে অবস্থানের ব্যাপারেই আলোচনা করেছন। সুতরাং তিনি ইসলামী রাষ্ট্র থেকে পালিয়ে যেয়ে বা কাফিরদের রাষ্ট্রে অবস্থান করে কাফিরদের সাহায্য করা কুফরী বলছেন এটা স্পষ্ট কিন্তু কেবল মাত্র মুসলিমদের বিপক্ষে কাফিরদের সাহায্য করা কুফরী কিনা সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছুই বলেন নি। সর্বপরি এ বিষয়ে তিনি যা কিছুই বলেছেন তা তার নিজস্ব মত যা অন্যান্য ওলামায়ে কিরামের মতের বিপরীত। তিনি এ বিষয়ে ইজমা তো নয়ই এমনকি অন্য কোনো আলেমের মতও উল্লেখ করেন নি। কেবল একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন যেখানে রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন “যে মুসলিম কাফিরদের ভুখন্ডে অবস্থান করে তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই”। ইবনে হিযাম বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ যার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন সে মুসলিম হতে পারে না। তার এই দাবীটি কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি তার জাহেরী দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এই হাদীসটি হতে এমন বুঝ গ্রহণ করেছেন। অন্য হাদীসে এসেছে রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,

বিপদে পড়লে যে, মাথার চুল কেটে ফেলে, উচ্চস্বরে চিৎকার করে পোশাক-পরিচ্ছদ ছিড়ে ফেলে তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। (বুখারী ও মুসলিম)

এই হাদীসটিতেও “তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই” এমন কথা বলা হয়েছে, তবে কি ইবনে হিযাম ঐ সকল মেয়ে লোককে কাফির বলবেন, যারা বিপদে পড়ে চিৎকার করে কেঁদে, পোশাক-পরিচ্ছদ ছিড়ে ফেলে বা চুল কামিয়ে শোক প্রকাশ করে?

দেখা যাচ্ছে, ইবনে হিযাম রঃ যে মত দিয়েছেন তা একটি স্বতর্ন্ত ও বিরল মত এবং তিনি যে যুক্তির মাধ্যমে দলিল পেশ করেছেন তা অগ্রহণযোগ্য। চিন্তার বিষয় হলো, যে মূলনীতিটির স্বপক্ষে এই ধরণের অস্পষ্ট ও ব্যাখ্যা স্বাপেক্ষ বিষয়াবলী ছাড়া স্পষ্ট কোনো দলিল-প্রমাণ পাওয়া যায় না, ঈমান-ইসলাম ও কুফর-শিরকের ক্ষেত্রে সেটার উপর নির্ভর করা কিভাবে যৌক্তিক হতে পারে! বিশেষত যখন এর বিপরীতে স্পষ্ট দলিল-প্রমাণ রয়েছে যে সম্পর্কে কিছু আলোচনা পূর্বে গত হয়েছে এবং পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ইনশা-আল্লাহ্।

উপরের আলোচনাতে আমরা, “মুসলিমদের বিপরীতে কাফিরদের যে কোনো ভাবে সহযোগিতা করা কুফরী” এ মূলনীতিটির স্বপক্ষে যেসব দলিল-প্রমাণ পেশ করা হয় সেগুলো খন্ডায়ন করেছি। এখন আমরা এর বিপরীতে স্পষ্ট দলিল-প্রমাণ উল্লেখ করবো।

এ বিষয়ে সর্বাধিক প্রানিধানযোগ্য হাতিব ইবনে আবি বালতায়া রঃ এর ঘটনা। বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত আছে, কুরাইশরা হুদাইবিয়ার সন্ধি ভঙ্গের পর রসুলুল্লাহ সাঃ যখন মক্কার উদ্দেশ্যে অভিযানে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তখন বদরী সাহাবী হাতিব ইবনে আবী বালতায়া রাঃ ওহীর মাধ্যমে বিষয়টি জেনে ফেলেন এবং মক্কায় পৌছানোর পূর্বেই চিঠিটি উদ্ধার করেন। হাতিব ইবনে আবী বালতায়া রঃ কে ডেকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, হে আল্লাহর রসুল সাঃ আপনি আমার ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি কুরাইশদের বহিরাগত ছিলাম তাদের বংশের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ছিলাম না। আপনার সাথে অন্য আর যেসব মহাজির আছে তাদের মক্কাতে আত্মীয় স্বজন রয়েছে যারা মক্কাতে তাদের সম্পদ ও পরিবারকে রক্ষা করে। যেহেতু মক্কাতে আমার কোনো আত্মীয় নেই তাই আমি চেয়েছি মক্কার কাফিরদের সাথে আমার একটি সুসম্পর্ক তৈরী হোক যাতে তারা আমার আত্মীয় স্বজনদের তারা নিরাপত্তা দেয়। আমি এ কাজ কুফরী বা দ্বীন ত্যাগের উদ্দেশ্যে করিনি, ইসলামের পর কুফরীকে পছন্দ করার কারণেও নয়।

উমর রঃ বললেন, হে আল্লাহর রসুল আমাকে আদেশ দিন আমি এই মুনাফিককে হত্যা করি।

রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, সে তো বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে আর তুমি কি জানো না যে, হয়তো আল্লাহ বদরে অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, তোমরা যা খুশি আমল করো কারণ আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছে। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফির মুশরিকদের যে কোনোভাবে সাহায্য সহযোগীতা করে কুফরী মনে করেন এ হাদীস তাদের বিপক্ষে স্পষ্ট দলীল। যেহেতু হাতিব রঃ মুশরিকদের সহযোগিতার উদ্দেশ্যে তাদের রাসুলুল্লাহ সাঃ এর অভিযানের খবর জানিয়ে পত্র লিখেছিলেন কিন্তু তাকে কাফির বলা হয় নি। হাতিব ইবনে আবি বালতায়া রঃ নিজেই বলেন, “আমি এ কাজ কুফরী বা দ্বীন ত্যাগের উদ্দেশ্যে করিনি, ইসলামের পর কুফরীকে পছন্দ করার কারণেও নয়”। রাসুলুল্লাহ সাঃ এই কথা সত্যায়ন করে বলেন, “সে সত্যই বলেছে” (সহীহ্ মুসলিম) এই স্পষ্ট বর্ণনার কারণে সকল ওলামায়ে কিরাম ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, হাতিব রাঃ যে কাজ করেছেন তথা মুসলিমদের গোপন খবর কাফিরদের নিকট পৌছে দেওয়া কুফরী নয়। এর উপর নির্ভর করে তারা মুসলিম গোয়েন্দা সম্পর্কে একমত হয়েছেন যে, সে কাফির নয়। ইমাম আন নাব্বী রঃ বলেন, এই হাদীস দলীল যে, গোয়েন্দা ও এধরণের কবীরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তি কাফির হবে না তবে এধরণের কাজ নিশ্চয় কবীরা গোনাহ কবে। (শারহে মসলিম)

পরে তিনি বলেন, ইমাম শাফেঈ এবং অন্য একদলের মত হলো মুসলিম গোয়েন্দাকে তাজীর হিসাবে শাস্তি দেওয়া হবে তাকে হত্যা করা বৈধ হবে না মালেকী মাজহাবের কেউ কেউ বলেছেন তাওবা না করলে তাকে হত্যা করা হবে কেউ কেউ বলেছেন তওবা করলেও হত্যা করা হবে। ইমাম মালিক বলেছেন তার ব্যাপারে ইমাম ইজতিহাদ করবে। (শারহে মুসলিম)

মুসলিম গোয়েন্দাকে হত্যা করা হবে কিনা সে সম্পর্কে ইমাম শাফেঈকে প্রশ্ন করা হলে তিনি হত্যা করা যাবে না এমন মত দেন এবং একটি হাদীস উল্লেখ করেন যেখানে বলা হয়েছে, বিয়ের পর জেনা করা, কোনো মুসলিমকে হত্যা করা এবং স্পষ্ট কুফরীতে লিপ্ত হওয়া ছাড়া কোনো মুসলিমকে হত্যা করা যাবে না। এর পর তিনি বলেন, মুসলিমদের গোপন খবর কাফিরদের জানিয়ে দেওয়া, কাফিরদের সাহায্য করা যেমন, মুসলিমরা কাফিরদের উপর গোপন আক্রমণ করতে চাইলে কাফিরদের সতর্ক হওয়ার জন্য বা মুসলিমদের বিপরীতে লড়াইয়ে রওয়ানা হওয়ার জন্য সে খবর জানিয়ে দেওয়ার স্পষ্ট কুফরী নয়।

তখন একজন বলল, “এ বিষয়ে কি কোনো দলিল আছে না কি আপনি কিয়াস করে বলছেন?”

এর জবাবে ইমাম শাফেঈ বলেন, এ বিষয়ে আমার নিকট এমন দলিল রয়েছে যার বিরুদ্ধাচারণ করা কোনো মুসলিমের পক্ষে সম্ভব নয়। এরপর তিনি হাতিব ইবনে আবি বালতায়ার ঘটনাটি বর্ণনা করেন। (আল-উম্ম)

ইমাম শাফেঈ ঠিকই বলেছেন, যেহেতু কেউই এই দলিলটিকে অগ্রাহ্য করতে পারেন নি বিধায় গোয়েন্দাগিরী কুফরী নয় এ ব্যাপারে সকল আলেম ঐক্যমত পোষণ করেছেন। যদিও বর্তমান সময়ের কিছু ব্যক্তি এর বিপরীত মত পোষণ করার সাহসিকতা প্রদর্শন করেছে।

কাজী ইবনুল আরাবী রঃ বলেন, যে ব্যক্তি বারবার মুসলিমদের গোপন বিষয় কাফিরদের নিকট ফাঁস করে সে একাজের মাধ্যমে কাফির হবে না যদি তার এ কাজ দুনিয়াবী কোনো উদ্দেশ্যে হয় এবং তার আকীদা সঠিক থাকে। যেমনটি হাতিব রাঃ করেছেন যেহেতু তিনি তার আত্মীয় স্বজনদের নিরাপত্তার জন্য একাজ করেছিলেন দ্বীন ত্যাগের উদ্দেশ্যে নয়। (আহকামুল কুরআন)

ইমাম কুরতুবী রঃ তার তাফসীরে হুবহু একই কথা বলেছেন যেমনটি আমরা পূর্বে বর্ণনা করেছি। হাতিব ইবনে আবি বালতায়া রাঃ এর ঘটনা প্রসঙ্গে ইবনে হাযার আসকালানী রঃ বলেন, এই হাদীস তাদের বিপক্ষে দলীল যারা কোনো পাপে লিপ্ত হলেই মুসলিমকে কাফির ও চিরস্থায়ী জাহান্নামবাসী বলে। (ফাতহুল বারী)

অর্থাৎ তিনি মুসলিম গোয়েন্দাকে কাফির বলা খারেজী সম্প্রদায়ের ভ্রান্ত মতবাদের মধ্যে গণ্য করেছন, যারা পাপকাজে লিপ্ত মুসলিমকে কাফির বলতো।

তিনি আরও বলেন, ইমাম তাহাবী মুসলিম গোয়েন্দার রক্ত হালাল না হওয়ার ব্যাপারে ইজমা উল্লেখ করেছেন। ইমাম শাফেঈ ও বেশিরভাগ আলেম বলেছেন তাকে তাজীর (লঘু শাস্তি) দেওয়া হবে আর যদি মুসলিমদের মাঝে সম্মানী ব্যক্তি হয় (অর্থাৎ তার পূর্ব আমল ভাল হয়) তবে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (ফতহুল বারী)

বুখারী শরীফের ব্যাখ্যায় ইবনে বাত্তাল রঃ বলেন, যিনি গোয়েন্দাকে হত্যা করার মত দিয়েছেন তার মত এই দাহীস ও পূর্ববর্তী আলেমদের মতের বিপক্ষে ফলে তার মত গ্রহনযোগ্য নয়। (শারহে ইবনে বাত্তাল)

ইমাম ইবনে তাইমিয়া রঃ বলেন, কোনো কোনো ব্যক্তি কখনও কখনও কাফিরদের সাথে আত্মীয়তার কারণে বা অন্য কোনো স্বার্থের কারণে এমন সম্পর্ক গড়ে তোলে যাতে তার ঈমানে কমতি ঘটার মতো অপরাধ হয় তবে সে এর মাধ্যমে কাফির হয় না। যেমন হাতিব ইবনে আবি বালতায়া রাঃ এর সাথে মুশরিকদের ঘটেছে। যেহেতু তিনি রসুলুল্লাহ্ সাঃ এর কিছু গোপন খবর মুশরিকদের চিঠির মাধ্যমে জানানোর চেষ্টা করেছিলেন। (মাজমুয়ায়ে ফতাওয়া)

এখানে লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, ওলামায়ে কিরাম গোয়েন্দাবৃত্তিকে সর্বসম্মতিক্রমে হারাম হিসেবে গণ্য করেছেন। এটা যে কুফরী নয় সে বিষয়ে তারা দ্বিমত করেন নি। তবে যে গোয়েন্দাবৃত্তি করে তাকে হত্যা করা হবে কিনা সে বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে।  সে ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ওলামায়ে দ্বীনের মতে তাকে হত্যা করা হবে না তবে বিশেষত মালেকী মাযহাবের কোনো আলেম বলেছেন তাকে হত্যা করা হবে। তাদের সংখ্যা এতই কম যে, ইমাম তাহাবী রঃ গোয়েন্দাকে হত্যা না করার ব্যাপারে ইজমা উল্লেখ করেছেন এবং ইবনে বাস্তাল রঃ গোয়েন্দাকে হত্যা করার মতটিকে পূর্ববর্তী ওলামায়ে কিরামের মতামতের বিপরীতে হওয়ার কারণে অগ্রহণযোগ্য সাব্যস্ত করেছেন। যেখানে গোয়েন্দাকে হত্যা করার মতটিকেই এভাবে তিরস্কার করা হয়েছে সেখানে তাকে কাফির সাব্যস্ত করার বিষয়টি কেমন হতে পারে! পূর্ববর্তী ওলামায়ে কিরামের কেউ গোয়েন্দাবৃত্তির অপরাধে কোনো মুসলিমকে কাফির বলেছেন এটা প্রমাণিত নয়। বর্তমান যুগের অনেকে অবশ্য পূর্ববর্তী সকল ওলামায়ে কিরামের মত অগ্রাহ্য করে গোয়েন্দাবৃত্তিকে কুফরী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ ক্ষেত্রে তারা পূর্বে বর্ণিত কল্পিত মূলনীতিটির উপর নির্ভর করেছেন। তারা বলেছেন, যেহেতু যে কোনো প্রকারে মুসলিমদের বিপরীতে কাফিরদের সহায়তা করা কুফরী অতএব মুসলিমদের গোপন খবর কাফিরদের পৌছে দেওয়াও কুফরী হবে। এই মূলনীতিটির স্বরুপ সম্পর্কে আমরা পূর্বে কথা বলেছি। আমরা প্রমাণ করেছি, এর স্বপক্ষে কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই। মুসলিম গোয়েন্দা যে কাফির নয় এ বিষয়ে আলেমদের ঐক্যমত সেই একই কথা প্রমাণ করে। কেউ কেউ বহু তল্লাশী করে কিছু কিছু আলেম-ওলামার বক্তব্য থেকে গোয়েন্দাবৃত্তি কুফরী হওয়ার প্রমাণ উত্থাপনের চেষ্টা করেছেন। দুঃখের বিষয় হলো, এ ক্ষেত্রে তারা যেসব দলিল-প্রমাণ হাজির করেছেন তা পূর্বের মতোই দুর্বল ও অস্পষ্ট।

তাহির ইবনে আশুর রঃ গোয়েন্দা সম্পর্কে মালেকী মাজহাবের দুজন প্রখ্যাত ইমাম ইবনে ওয়াহাব এবং ইবনে কাসিমের মত বর্ণনা করে বলেন, ইবনে কাসিম বলেছেন, “এটা যানদাকা (ধর্মদ্রোহিতা) তার কোনো তাওবা নেই”। এর অর্থ তার বিধান যিনদিকের (ধর্মদ্রোহী) মতো। তাকে তাওবা করতে না বলেই হত্যা করা হবে। যিনদিক হলো সে যে প্রমাশ্যে ইসলামের কথা বলে, কিন্তু অন্তরে কুফরী গোপন রাখে। যখন তার ভিতরের কুফরী সম্পর্কে অবগত হওয়া সম্ভব হয়। (তখন তাকে তওবার সুযোগ না দিয়েই হত্যা করা হয়; এটা ইমাম মালিকের মত)। ইবনে ওয়াহাব বলেছেন, এটা ধর্ম ত্যাগ বলে গণ্য হবে তাকে হত্যা করার পূর্বে তওবা করতে বলা হবে। তবে চিন্তা করলে দেখা যাবে এ দুটি মত দূর্বল। (আত-তাহরীর ওয়াত-তানবীর)

ইবনে ওয়াহাব এবং ইবনে কাসিম মালেকী মাযহাবের প্রথম যুগের ওলামায়ে কিরামের মধ্যে গণ্য। উপরোক্ত বর্ণনাটিতে তাদের যে মত উল্লেখিত হয়েছে তার উপর নির্ভর করে কেউ কেউ প্রমাণ করার চেষ্টা করেন মুসিলম গোয়েন্দা কাফির নয় এ বিষয়ে আলেমরা একমত নন বরং তাদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। দুটি দৃষ্টি কোন থেকে এর উত্তর দেওয়া যায়।

প্রথমতঃ ইবনে কাসিম বা ইবনে ওয়াহাব মালেকী মাযহাবের প্রথম যুগের ওলামায়ে কিরামের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত। তাদের মতামত ও চিন্তাধারা বিশেষকরে মালেকী মাযহাবের আলেমদের নিকট এবং সাধারণভাবে সকল ওলামায়ে কিরামের নিকট ব্যাপক গুরুত্ববহ। মালেকী মাযহাবের গ্রন্থসমূহতে বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামত গুরুত্বসহকারে আলোচনা করা হয়েছে। গোয়েন্দা সম্পর্কে মালেকী মাযহাবের পূর্ববর্তী ওলামায়ে কিরাম এবং অন্যান্য মাযহাবের বরেণ্য ওলামায়ে কিরাম তাদের মতামত বর্ণনা প্রসঙ্গে কেবল হত্যা করার বিষয়টিই উল্লেখ করেছেন। ইবনে বাত্তাল রঃ ও বদরুদ্দীন আইনী রঃ বুখারীর ব্যাখ্যায় গোয়েন্দা সম্পর্কে তাদের মত বর্ণনা করেছেন। সেখানে কেবল গোয়েন্দাকে হত্যা করার বিষয়টিই বর্ণিত আছে। তারা যে বিষয়টিকে কুফরী মনে করেন এটা কোথাও উল্লেখ নেই। প্রায় বারো শতাব্দী পর জন্মগ্রহণকারী একজন আলেম তাহির ইবনে আশুর এটা বর্ণনা করেছেন। একটি বর্ণনা দূর্বল হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। বর্ণনাকারী তাহির ইবনে আশুর নিজেও ইবনে কাসিম ও ইবনে ওয়াহাবের মত বর্ণনার পর বলেছেন, চিন্তা-ভাবনা করলে দেখা যাবে এ দুটি মত দূর্বল।

দ্বিতিয়তঃ যদি ধরেও নিই দুজন আলেম গোয়েন্দাগিরীকে কুফরী বলেছেন তবে সমস্ত ওলামায়ে কিরামে মতের বিপরীতে দুজন আলেমের মত কি শায বা বিরল মত হিসেবে গণ্য হবে না? তাছাড়া যদি কোনো বিষয়ে প্রথম যুগের দু’একজন আলেমের দ্বিমত থাকে কিন্তু তাদের পরবর্তী যুগের ওলামায়ে কিরাম উক্ত দ্বিমত পরিত্যাগ করে ঐক্যমত পোষণ করেন তবে প্রথম যুগের মতপার্থক্য অনুসরণ করার সুযোগ থাকে না। যেমন, তামাত্তু হজ্জ সম্পর্কে উমর রাঃ এর বক্তব্য, মুতা বিবাহ সম্পর্কে ইবনে আব্বাস রাঃ এর বক্তব্য, তাইয়াম্মুম সম্পর্কে উমর রাঃ ও ইবনে মাসউদ রঃ এর বক্তব্য, সম্পদ জমা করা সম্পর্কে আবু হানীফার বক্তব্য ইত্যাদি। সুতরাং যদি ধরেও নিই ইমাম মালিকের দুই ছাত্র ইবনে কসিম এবং ইবনে ওহাব গোয়েন্দাকে কাফির বলেছেন, সেক্ষেত্রে গোয়েন্দা কাফির নয় এ ব্যাপারে হয়তো ইজমা প্রমাণিত হবে না কিন্তু গোয়েন্দা যে কাফির এটা মনে করার কোনো সুযোগ থাকবে কি? বিশেষ করে শিরক-কুফরের ক্ষেত্রে সকল ওলামায়ে কিরামের বিপরীতে দু’একজন আলেমের মতামতের উপর নির্ভর করা সঠিক হতে পারে না। আলেমরা তো সামান্য দ্বিমত থাকলেই সে বিষয়ের উপর নির্ভর করে কোনো মুসলিমকে কাফির বলার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারী করেছেন যেমনটি আমরা বহু বার বর্ণা করেছি। তাহলে সকল ওলামায়ে কিরামের বিপরীতে দু’একজন আলেমের মত অনুসরণ করে একজন মুসলিমকে কাফির সাব্যস্ত করার বিষয়টি কেমন হতে পারে! সর্বপরি যদি এই দু’একজন আলেমের মতের উপর নির্ভর করে বলা হয়-কাফিরদের যে কোনোভাবে সহযোগিতা করা কুফরী এ ব্যাপারে আলেমরা ইজমা করেছেন তবে সেটা কোন পর্যায়ের মিথাচার বলে গণ্য হবে?

মালেকী মাযহাবের কোনো কোনো আলেম গোয়েন্দার বিধান বর্ণনা প্রসঙ্গে বলে থাকেন, “তার বিধান ‍যিনদিকের (ধর্মদ্রোহী) মতো” এর উপর নির্ভর করে অনেকে বলতে চান মালেকী মাযহাবের আলেমরা গোয়েন্দাকে যিনদিক তথা ধর্মদ্রোহী বলে ফতোয়া দিয়েছেন। ফিকাহর গ্রন্থ সমূহ যথাসামান্য পড়া –শুনা করার অভ্যাস যার আছে এমন ব্যক্তি এধরণের কথা বলতে পারেন না। যেহেতু ঐ সকল আলেমরা গোয়েন্দাকে কাফির বলেন না বরং গোয়েন্দাকে পাকড়াও করার পর হত্যা করতে হবে তওবা করার সুযোগ দেওয়া হবে না যেভাবে ইমাম মালিকের মতে যিনদিককে পাকড়াও করার পর তওবা করার সুযোগ না দিয়ে হত্যা করা হয় এই অর্থ তারা গোয়েন্দাকে যিনদিকের সাথে তুলনা করেন কুফরীর দিক থেকে নয়। তারা এই অর্থেই কথাটি বলে থাকেন এবং অন্যান্য ওলামায়ে কিরাম তাদের কথার এই অর্থই অনুধাবন করে থাকেন। তদের কথা মনযোগ দিয়ে পাঠ করলে যে কারো নিকট এই অর্থটিই স্পষ্ট হবে। তবে যাদের অন্তরে বক্রতা আছে তাদের কথা ভিন্ন।

হাম্বলী মাযহাবের কাজি আবু ইয়া’লা থেকে আব্দুর রহমান আল-জাওজী বর্ণনা করেন, হাতিব ইবনে আবি বালতায়ার ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই ঘটনা প্রমাণ করে, নিজের জীবন সম্পর্কে ভয় থাকলে কুফরী কথা বলা যেমন বৈধ হয় নিজের সম্পদ বা সন্তানের উপর ভয় থাকলে কুফরী কথা বলা বৈধ হয় না। এটা আরো স্পষ্ট হয় যেহেতু আল্লাহ্ হিজরত করা ফরজ করেছেন কিন্তু সম্পদ ও সন্তান হারানোর ভয়ে হিজরত করা হতে বিরত হওয়া বৈধ করেন নি। (যাদুল মুইয়াসসার)

হাতিব রাঃ এর ঘটনাটি হতে কাজি আবু ইয়া’লা সন্তান ও সম্পদের ভয়ে কুফরী করা বৈধ নয় এটা প্রমাণ করেছেন। এ থেকে কেউ কেউ মনে করেছেন তাহলে নিশ্চয় তিনি হাতিব রাঃ এর কাজ তথা কাফিরদের নিকট মুসলিমদের গোপন খবর জানিয়ে দেওয়া কুফরী হিসেবে গণ্য করেছেন। যারা এমন মনে করে তারা আসলে আলেমদের বক্তব্য যথাযোগ্যভাবে অনুধাবনে সক্ষম নয়। এখানে মূল ঘটনা হলো, নিজের জীবন হারানোর ভয়ে হারাম বা কুফরীতে লিপ্ত হওয়া বৈধ এ বিষয়ে আলেমদের ইজমা সম্পাদিত হয়েছে কিন্তু নিজের সন্তান বা সম্পত্তি হারানোর ভয়ে তা করা যাবে কিনা সেটা নিয়ে দ্বিমত আছে। কাফিরদের পক্ষে গোয়েন্দাগিরী করা একটি হারাম কাজ। এ কারণে হাতিব ইবনে আবি বালতায়াকে তিরস্কার করে পরিত্র কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে। তবে তিনি বদরী সাহাবা হওয়ার কারণে তার এ পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। নেক আমলের কারণে শিরক-কুফর ছাড়া অন্য যে কোন পাপ ক্ষমা করা যেতে পারে এ বিষয়ে সকল আলেম এক মত। হাতিব ইবনে আবি বালতায়ার সন্তান ও সম্পদের ক্ষতি হতে পারে এই আশঙ্কায় এ কাজ করেছিলেন। তবু তাকে ওযর দেওয়া হয়নি বরং তিরস্কার করা হয়েছে। তাকে যতটুকু ওযর দেওয়া হয়েছে তার বদরী সাহাবা হওয়ার করণে, সন্তান-সম্পদের ক্ষতির আশঙ্কার কারণে নয়। এটা প্রমাণ করে সন্তান বা সম্পদের ক্ষতির আশঙ্কায় হারাম কাজ করা বৈধ নয়। অতএব, এ আশঙ্কায় যে কুফরী করা যাবে না সেটিও প্রমাণিত হয়। এ অর্থে কাজি আবু ইয়া’লা হাতিব রাঃ এর ঘটনা থেকে সন্তান সম্পদের ক্ষতির আশঙ্কায় কুফরী করা যাবে না এ বিধান বর্ণনা করেছেন। হাতিব রাঃ এর কাজটি কুফরী ছিল এটা বোঝানোর জন্য নয়। এ বিষয়ে স্পষ্ট প্রমাণ হলো তিনি হাতিব রাঃ এর ঘটনার পাশাপাশি সন্তান-সম্পদের ক্ষতির আশঙ্ক থাকলেও হিজরত করা ফরজ এই বিধানটি উল্লেখ করেছেন এবং নিজের মতের স্বপক্ষে তথা সন্তান-সম্পদের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলেও কুফরী করা যাবে না এ বিষয়ে উক্ত ঘটনাকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এর অর্থ কিন্তু এই নয় যে, সন্তান বা সম্পদের ক্ষতি হবে এই ভয়ে হিজরত না করা তিনি কুফরী মনে করেন। হিজরত না করার কারণে কোনো মুসলিমকে কাফির বলা যেতে পারে না যেহেতু আল্লাহ নিজেই তাকে মুমিন হিসেবে গন্য করেছেন।

আল্লাহ আয়ালা বলেন, “যারা ঈমান এনেছে কিন্তু হিজরত করে নি তাদের সাথে তোমাদের কোনো সম্পর্ক নেই যতক্ষণ না তার হিজরত করে চলে আসে। তবে যদি তারা দ্বীনের খাতিরে তোমাদের সহযোগিতা চায় তবে তাদের সহযোগিতা করা তোমাদের দায়িত্ব”। (আনফল-৭২)

এ আয়াতে যারা হিজরত করেনি তাদের তিরস্কার করা সত্ত্বে  মুমিন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং মুসলিমদের নিকট দ্বীনের খাতিরে সাহায্য প্রার্থনা করার অধিকার তাদের আছে এটা উল্লেখ করা হয়েছে।

রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, “যে মুসলিম মুশরিকদের এলাকায় বসবাস করে তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই”। (আবু দাউদ) কিন্তু এই সম্পর্কহীনতা ঐ সকল ব্যক্তিদের কুফরী প্রমাণ করে না। একারণে তিনি তাদের মুসলিম হিসেবে স্বীকার করেছেন।

অতএব, কাজি আবু ইয়া’লা যারা হিজরত করেনি তাদের কাফির বলতে পারেন না। তিনি সেটা উদ্দেশ্যও করেন নি। একইভাবে মুসলিমদের গোপন খবর কাফিরদের নিকট পৌছে দেওয়া তিনি কুফরী মনে করেন না। এ বিষয়ে তার স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। ইবনে তাইমিয়া রঃ মুসলিম গোয়েন্দার বিধান সম্পর্কে বলেন,

ইমাম আহমদ তাকে হত্যা করার ব্যাপারে নিরবতা অবলম্বন করেছেন। ইমাম মালিক ও হাম্বালী মাযহাবের কোনো কোনো আলেম যেমন ইবনে আকীল তাকে হত্যা করা বৈধ বলেছেন। হানাফী ও শাফেঈ মাযহাবের ওলামায়ে কিরাম এবং হাম্বালী মাযহাবের কেউ কেউ যেমন কাজি আবু ইয়ালা গোয়েন্দাকে হত্যা করা হতে নিষেধ করেছেন।(মাজমুয়ায়ৈ ফাতাওয়া)

সুতরাং কাজি আবু ইয়া’লা গোয়েন্দাকে হত্যা করাই বৈধ মনে করেননি কাফির মনে করা তো সুদূর পরাহত।

কাজি আবু ই’লার মতো হানাফী মাযহাবের ইমাম আবু বকর আল জাসসাসও হাতিব ইবনে আবি বালতায়ার ঘটনা হতে সন্তান-সম্পদের ক্ষতি হতে পারে এই আশঙ্কায় কুফরী করা বৈধ নয় এটা প্রমাণ করেছেন। তার কথার উদ্দেশ্যও তাই যা আমরা কাজি আবু ইয়া’লার কথা সম্পর্কে বর্ণনা করেছি। যেহেতু হানাফী মাযহাবের কেউই গোয়েন্দাকে কাফির বলেন না হত্যাও করতে বলেন না।

কেউ কেউ আবার সরাসারি হাতিব রাঃ এর ঘটনা হতেই মুসলিমদের খবর মুশরিকদের নিকট পৌছে দেওয়াকে কুফরী প্রমাণের চেষ্টা করেন। তাদের যুক্তি হলো, উমর রাঃ বললেন, হে আল্লাহর রসুল আমাকে নির্দেশ দিন আমি এই মুনাফিকের গর্দানে আঘাত করি। তারা বলেন, উমর রাঃ এর মতে হাতিব রাঃ যা করেছে তা কুফরী ছিল বলেই তিনি তাকে মুনাফিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এটা প্রমাণ করে সাহাবায়ে কিরাম এধরণের কাজকে কুফরী মনে করতেন। যার হাতে কড়ি থাকে না কেবল সেই কানা কড়ি নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করে। উমর রাঃ এর এই কথাটি হতে দলিল পেশ করাও অনুরুপ। প্রথমত সাহাবয়ে কিরাম কারো মধ্যে নিষিদ্ধ বা এমনকি অপছন্দনীয় কিছু দেখলেই তার ব্যাপারে মুনাফিক শব্দ প্রয়োগ করতেন। এর মাধ্যমে তারা উক্ত ব্যক্তি কাফির এটা উদ্দেশ্য করতেন না। এ বিষয়ে প্রচুর উদাহরণ পেশ করা যায়:

সহীহ হাদীসে এসেছে, একদিন মুয়াজ রাঃ ঈশার সলাতে ইমাম হিসেবে সূরা ফাতিহার পর সূরা বাকারা শুরু করলেন। একজন ব্যক্তি অধিক লম্বা কিরায়াতে সবর করতে না পেরে জামাত পরিত্যাগ করে মসজিদে একাকী সলাত আদায় করে। পরবর্তীতে লোকে তাকে ঘিরে ধরে এবং বলে, তুমি কি মুনাাফিক হয়ে গেছো? (মুসলিম) এমনকি মুয়াজ রাঃ নিজেও ঐ ব্যক্তিকে মুনাফিক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পরে ঐ ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাঃ এর নিকট এসে সব ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, মুয়াজ আমাকে মুনাফিক বলেছে। রাসুলুল্লাহ সাঃ এটা শুনে মুয়াজ রাঃ কে তিরস্কার করে বলেন, “হে মুয়াজ তুমি কি ফিতনা সৃষ্টি করতে চাও?” (সহীহ বুখারী)

এরপর তিনি জামাতে সলাত আদায়ের সময় লম্বা কিরাত পড়তে নিশেধ করেন। এখন যদি কেউ বলে যেহেতু মুয়াজ ইবনে জাবাল রাঃ এবং অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম এই ব্যক্তিকে জামাতে সলাত পরিত্যাগ করার কারণে মুনাফিক বলে আখ্যায়িত করেছে এর অর্থ যে ব্যক্তি জামাতে সলাত পড়েনা সাহাবায়ে কিরাম তাকে কাফির মনে করতেন তবে কেমন হবে?

হানজালা রাঃ একবার রাসুলুল্লাহ সাঃ এর দরবারে এসে নিজেকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “হে আল্লাহর রাসুল, হানজালা মুনাফিক হয়ে গেছে” রাসুলুল্লাহ সাঃ করণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসুল সাঃ যখন আমরা আপনার নিকট থাকি তখন জান্নাত জাহান্নাম যেন আমাদের চোখের সামনে থাকে কিন্তু যখন আমরা আপনার নিকট থেকে ফিরে যায় এবং ক্ষেত খামার ও স্ত্রী সন্তানদের সাথে অবস্থান করি তখন আখিরাতকে ভুলে যায়।

রাসুলুল্লাহ সাঃ এটা শুনে শান্তনা দিয়ে বলেন, আমার নিকট তোমরা যেমন থাকো যদি সর্বদা তেমন থাকতে তবে ফেরেশতারা তোমাদের সাথে রাস্তা-ঘাটে দেখা করে মোসাফা করতো। হে হানজালা সব সময় সমান অবস্থা থাকে না। (মুসলিম)

এই হাদীসের অর্থও এটা নয় যে, সাহাবায়ে কিরাম সামান্য সময়ের জন্যও আখিরাতকে ভুলে থাকাটা কুফরী মনে করতেন।

আয়েশা রাঃ এর অপবাদের ঘটনা প্রসঙ্গে একবার সা’দ ইবনে উবাদা আব্দুল্লাহ্ ইবনে উবাই এর পক্ষে কিছু কথা বললে, উসাইদ ইবনে খুদাইর বলেন, “তুমি নিজে মুনাফিক এবং অন্য একজন মুনাফিকের পক্ষে তর্ক করছো”। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

এই ঘটনাতেও সা’দ রাঃ কে কাফির বলা উদ্দেশ্য নয়।

এমন বহু উদাহরণ রয়েছে। সুতরাং উমর রাঃ হাতিব রাঃ কে মুনাফিক বলেছেন অতএব তিনি গোয়েন্দাগিরীকে কুফরী মনে করেন এই দলিল অজ্ঞতাপ্রসূত। অন্য আরেকটি বর্ণনাতে অবশ্য মুনাফিক শব্দের পরিবর্তে “সে কুফরী করেছে” এমন বর্ণিত আছে। কিন্তু এখানে ঘটনা একটিই অতএব উমর রাঃ যে কোনো একটি শব্দ ব্যাবহার করেছেন। তিনি হয়তো মুনাফিক বলেছেন নয়তো সে কুফরী করেছে এটা বলেছেন। যদি সনদের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয় তবে নিঃসন্দেহে মুনাফিক বলার সম্ভাবনাটিই প্রাধান্য পাবে। যেহেতু এটিই অধিক সংখ্যক বর্ণনাতে এসেছে এবং শাব্দিকভাবে বুখারী ও মুসলিমে উল্লেখিত রয়েছে। তাছাড়া যদি ধরেও নিই উমর রাঃ “সে কুফরী করেছে” একথা বলেছেন তবু তার মাধ্যমে প্রকৃত অর্থেই হাতিব রাঃ কে কাফির বলতে চেয়েছেন এটা প্রমাণিত হয় না। যেহেতু কুফরী শব্দটি বিভিন্ন হাদীসে এবং সাহাবায়ে কিরামে বক্তব্যে অনেক সময় অধিক কঠোরতা অর্থে ব্যাবহৃত হয় প্রকৃত কুফরী অর্থে নয় যেমনটি আমরা পূর্বে লক্ষ্য করেছি। সর্বপরি যদি এটাও মেনে নিই যে, উমর রাঃ হাতিব ইবনে আবি বালতায়া কাফির হয়ে গেছে এটিই বলতে চেয়েছেন তার পরও কিভাবে এটা বলা যায় যে, রাসুলুল্লাহ সাঃ এর কথা পরিত্যাগ করে উমর রাঃ এর কথা অনুসরণ করতে হবে? উমর রাঃ যে অর্থেই মুনাফিক বা কাফির শব্দ প্ররেয়াগ করে থাকুন রাসুলুল্লাহ সাঃ সে কারণে তাকে ধমক দিয়েছেন এবং বলেছেন, সে তো বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, (হে উমর) তুমি কি জানো না যে, হয়তো আল্লাহ বদরে অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, তোমরা যা খুশি আমল করো কারণ আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

সহীহ্ বুখারীতে এসেছে, একথা শুনে উমর রাঃ কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, আল্লাহ্ ও তার রাসূলই ভাল জানেন। (সহীহ বুখারী) তাছাড়া হাতিব ইবনে আবি বালতায়া রাঃ যখন বললেন, আমি তো কুফরী করি নি আমি তো দ্বীন ত্যাগ করি নি তখন রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, সে সত্য বলেছে।

সুতরাং যে মত স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাঃ ভ্রান্ত সাব্যস্ত করেছেন এবং উক্ত মতের প্রবক্তা নিজেই সেটা পরিত্যাগ করেছেন সেটা অনুসরণ করা কি ধরণের ইলম চর্চা হবে তা আমাদের নিকট বোধগম্য নয়।

উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে এটা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, মুসলিমদের গোপন খবর কাফিরদের জানিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে একজন মুসলিম কাফিরে পরিনত হয় না। হাতিব ইবনে আবি বালতায়ার ঘটনা এ বিষয়ে সুস্পষ্ট দলিল। যেহেতু তিনি মুসলিমদের গোপন খবর সম্পর্কে কাফিরদের অবহিত করে চিঠি লেখা সত্ত্বেও স্পষ্ট দাবী করেন, আমি তো কুফরী করি নি, আমি তো দ্বীন ত্যাগ করি নি। রাসুলুল্লাহ সাঃ তার এই দাবীর সত্যতা স্বীকার করেন। পরবর্তীতে সকল ওলামায়ে কিরাম হাতিব রাঃ এর ঘটনাটিকে মুসলিম গোয়েন্দা কাফির না হওয়ার ব্যাপারে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তারা কেউই হাতিব রাঃ এর এই কাজটিকে কুফরী হিসেবে মনে করেন নি এবং অন্য যে কোন মুসলিমই কাফিরদের নিকট মুসলিমদের গোপন সংবাদ পাচার করে তারা তাদের কাফির বলেন নি। এই বিষয়টি “মুসলিমদের বিপক্ষে কাফিরদের যে কোনো ভাবে সাহায্য করা কুফরী” এই মূলনীতি বাতিল প্রমাণ করে। এ পর্যায়ে উক্ত মূলনীতিটিকে রক্ষার নিমিত্তে সমসাময়িক কিছু ব্যক্তি একটি হাস্যকর পন্থা অবলম্বন করেছেন।

তারা বলেন, পূর্ববর্তী ওলামায়ে কিরাম যে গোয়েন্দা সম্পর্কে কাফির নয় এমন মন্তব্য করেছেন বর্তমান গোয়েন্দাদের উপর সেই একই বিধান প্রযোজ্য হবে না। যেহেতু বর্তমানে গোয়েন্দারা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যাবহার করে এবং আগের চেয়ে বহুগুণ বেশি ক্ষতি সাধন করে। এরা মুজাহিদদের অবস্থান ও কার্য্ক্রম সম্পর্কে লম্বা লম্বা রিপোর্ট লেখে, মাসিক বেতন পায় ইত্যাদি।

ব্যাপারটা যেন এমন যে, আগের চোররা ছুরি, চাকু, দা ইত্যাদি হাতিয়ার ব্যাবহার করে চুরি করতো আর বর্তমানের চোর-ডাকাতরা পিস্তল, রাইফেল, বোমা ইত্যাদি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবহার করে অতএব বর্তমান সময়ের চোররা কাফির। এ ধরণের যুক্তি প্রমাণের উপর লম্বা আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। কেবল এতটুকু বলব, বর্তমানে গোয়েন্দারা কিকি কাজ করে সেটা এখানে মূল বিষয় নয়। এখানে মূল বিষয় হলো, মুসলিমদের গোপন খবর কাফিরদের নিকট পৌছে দেওয়ার মাধ্যমে তাদের সাহায্য করা কুফরী নয়। যে ব্যক্তি এ কাজ করে সে কাফির নয়। যদি এমন প্রমাণ করা সম্ভব হয় যে, ঐ ব্যক্তির মধ্যে অন্য কোনো কুফরী রয়েছে তবে সে কাফির হবে। কিন্তু সে কাফির হবে তার গোয়েন্দাবৃত্তির কারণে নয় বরং তার মধ্যে অন্য যে কুফরীটি রয়েছে সে কারণে। অতএব, বর্তমানে গোয়েন্দারা নতুন যা কিছুই সংযোজন করুক গোয়েন্দাবৃত্তি যে কুফরী নয় এ বিধান অপরিবর্তীত থেকে যাবে। যেভাবে চুরি, যাকাতি, খুন, ধর্ষন ইত্যাদি সকল অপরাধ কিয়ামত পর্য্ন্ত অপরাধ হিসেবেই গণ্য হবে কুফরী নয়। আধুনিক যুগে চোর-ডাকাত বা ধর্ষকরা কি পন্থা পদ্ধতি অবলম্বন করছে এর উপর ভিত্তি করে চুরি করা বা ডাকাতি করা কুফরী প্রমাণিত হবে না। যদি চোরের মধ্যে অন্য কোনো কুফরী পাওয়া যায় তবে সে কাফির হবে কিন্তু সে ক্ষেত্রেও চুরি করা কুফরী এমন বলা যাবে না বরং সে অন্য যে কুফরীটি করেছে সেটি উল্লেখ করে তাকে কাফির বলতে হবে চুরি করার কারণে নয়।

গোয়েন্দা সম্পর্কে ওলামায়ে কিরামের মতামতের বিপরীতে “মুসলিমদের বিপক্ষে কাফিরদের যে কোনো ভাবে সহায়তা করা কুফরী” এই মূলনীতিটি অক্ষত রাখতে আরো একটি হাস্যকর পন্থা অবলম্বন করা হয়। কেউ কেউ বলে, আসলে কাফিরদের হয়ে মুসলিমদের বিপক্ষে গোয়েন্দাগিরী করা তথা মুসলিমদের গোপন খবর কাফিরদের নিকট পৌছে দেওয়া তাদের সাহায্য করা হিসেবে গণ্য নয়। নিজের মত প্রতিষ্ঠা করার জন্য মানুষ কতটা আবেগপ্রবন হতে পারে এই কথাটি তার সুস্পষ্ট উদাহরণ। যুদ্ধের ময়দানে শত্রু পক্ষের সংখ্যা, অবস্থান তাদের চিন্তা-ভাবনা, প্লান-পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ের খবর সংগ্রহ করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা স্বাভাবিক বুদ্ধির যে কেউই অনুধাবনে সক্ষম। এটা বললে, অতিরঞ্জন হবে না যে, শত্রু পক্ষের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারা যুদ্ধে বিজয় অর্জনের প্রধান শর্ত। এর বিপরীতে শত্রুপক্ষকে নিজেদের সম্পর্কে যতটা কম তথ্য দেওয়া যায় বিজয় অর্জনের সম্ভাবনা ততটাই প্রকট হয়। রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, “যুদ্ধ হচ্ছে ধোকা” (বুখারী ও মুসলিম) নিজেদের আক্রমণের খবর গোপন রেখে হঠাৎ আক্রমণ করে বা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শত্রু পক্ষের দূর্বল স্থান চিহিৃত করে সেখানে আঘাত হানতে সক্ষম হলে শত্রুকে ধোঁকায় ফেলে সহজে বিজয় অর্জন সম্ভব। তাছাড়া শত্রুর মোকাবিলায় কি পন্থা-পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলেও শত্রুর অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে জানা প্রয়োজন। এসব কারণে যুদ্ধের ময়দানে সসস্ত্র সৈনিকের পূর্বে গোয়েন্দাদের গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ সত্ত্বেও যদি কেউ মনে করে মুসলিমদের খবর কাীফরদের জানিয়ে দেওয়া কোনো প্রকার সহযোগিতা নয় এবং এই বোকামীর মাধ্যমে একটি কল্পিত মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তবে আমাদের কিছুই বলার নেই।

সবিশেষে পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বলবো, কাফিরদের কুফরীর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে বা ইসলামকে অপছন্দ করে নয় বরং দুনিয়াবী কোনো স্বার্থে বা অন্য কোনো আবেগ অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়ে মুসলিমদের বিপরীতে কাফিরদের সহযোগিতা করা মারাত্মক অপরাধ তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু কুফরী নয়। এই সহযোগিতা গোয়েন্দাগীরির মাধ্যমে হোক বা সরাসরি কাফিরদের পক্ষাবলম্বন করে যুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে হোক। এটিই ওলামায়ে কিরামের কিনট গৃহীত মূলনীতি।

হানাফী মাযহাবের তৃতীয় ইমাম মুহাম্মাদ আশ-শাইবানী রঃ বলেন, যদি কেউ মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরদের পক্ষাবলম্বন করে যুদ্ধ করছিল এমন কোনো মুসলিমকে হত্যা করে তবে উক্ত মুসলিমের সম্পদ যে হত্যা করলো সে (গনিমত হিসেবে) পাবে না। কেননা (কাফিরদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ গ্রহণের কারণে) এই ব্যক্তির হত্যা করা যদিও বৈধ কিন্তু তার সম্পদ গতিমত নয়। যেহেতু এটা মুসলিমের সম্পদ আর মুসলিমের সম্পদ কখনও গনিমত হতে পারে না যেমন খলীফার বিরুদ্ধে যেসব মুসলিম বিদ্রোহ করে তাদের সম্পদ গনিমত হয় না। (শারহে সিয়ারে কাবীর)

অর্থাৎ ইমাম মুহাম্মদ রঃ কাফিরদের পক্ষে অংশগ্রহণকারী মুসলিমকে কাফির হিসেবে গণ্য করেন নি।

মালেকী মাযহাবের প্রখ্যাত ফকীহ্ আল-কয়রাওয়ানী অনুরুপ ফতোয়া উল্লেখ করেছেন। যারা কাফিরদের নেতৃত্বে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তিনি তাদের বিদ্রোহী মুসলিম হিসেবে গণ্য করেছেন। এবং তাদের সম্পদ সম্পর্কে বলেন, “বিদ্রোহী মুসলিমদের কোনো সম্পদ গ্রহণ করা হবে না। (নাওয়াদির ওয়া ঝিয়াদাত)

 বিভিন্ন ওলামায়ে কিরাম থেকে এর স্বপক্ষে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে এবং এর বিপরীতে কোনো আলেম হতে স্পষ্ট মন্তব্য বর্ণিত নেই।

অতএব, যারা খবর পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে কাফিরদের সহযোগিতা করা আর সরাসরি কাফিরদের পক্ষাবলম্বন করে মুসলিমদের বিপক্ষে যুদ্ধ করার মধ্যে পার্থক্য করতেই চাই এবং এই পন্থায় “মুসলিমদের বিপক্ষে কাফিরদের যে কোনো প্রকারে সহযোগিতা করা কুফরী” এই মূলনীতিটি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে তাদের এই চেষ্টা একইসাথে অযৌক্তিক এবং অসম্পূর্ণ।

উপরোক্ত আলোচনার উপর নির্ভর করে নিম্মোক্ত সিদ্ধান্তগুলো নিশ্চিতভাবে গ্রহণ করা যায়।

ক। “মুসলিমদের বিপক্ষে কাফিরদের যে কোনো ভাবে সহযোগিতা করা কুফরী” এই মূলনীতিটি পূর্ববর্তী কোনো আলেম স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন নি। তারা যা কিছু বর্ণনা করেছেন সেগুলোর ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে এবং তার সাথে অন্য শর্ত যুক্ত আছে যেমন, কাফিরদের ধর্ম মেনে নিয়ে তাদের সহযোগিতা করা, তাদের ধর্মের কারণে তাদের ভালবাসা, কুফরীর বিজয় কামনা করা ইত্যাদি।

খ. যারা এই মূলনীতির পক্ষে কথা বলেন, তারা কিছু আলেমের দূর্বল ও অস্পষ্ট বক্তব্যের উপর নির্ভর করেছেন। যদি ধরেও নিই সেগুলো সঠিক তবু বলতে হয় উপরোক্ত মূলনীতিটির উপর ইজমা সম্পাদিত হয়েছে এ দাবী করা স্পষ্ট মিথ্যাচার ছাড়া কিছু নয়। আর যেহেতু অস্পষ্ট ও মতপার্থক্যপূর্ণ বিষয়াবলীর উপর বির্ভর করে মুসলিমদের কাফির বলা উচিৎ নয়- এটিই ওলামায়ে কিরামের নিকট সর্বস্বীকৃতি মূলনীতি অতএব, দু একজন আলেমের মত পেয়ে গেলেই সমস্ত ওলামায়ে কিরামের মতের বিপক্ষে সেটি গ্রহণ করে কোনো মুসলিমকে কাফির বলা সঠিক পন্থা হতে পারে না।

গ। কাফিরদের মুসলিমদের বিপক্ষে সাহায্য করা আমরা কুফরী বলছি না এর অর্থ এই নয় যে, আমরা এ ভয়াবহ অপরাধটিকে তুচ্ছ জ্ঞান করছি। একটি মারাত্মক অপরাধ তাতে সন্দেহ নেই। এমন কি বিষয়টি ক্ষেত্র বিশেষে কুফরী পর্য্ন্ত পৌছাতে পারে। যদি বোঝা যায় উক্ত ব্যক্তি ইসলামের ধ্বংস এবং কুফরীর বিজয় কামনা করেই কাফিরদের সহায়তা করছে। সেক্ষেত্রে তার বাহ্যিক আমল-আখলাকের মাধ্যমে অন্তরের বিষয়টি অনুধাবনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। কেবলমাত্র মুসলিমদের বিপরীতে কাফিরদের সাহায্য করলেই তাকে কাফির বলা যাবে না বরং তার সাথে এমন কোনো কার্য্কারণ থাকতে হবে যা প্রমাণ করে সে কুফরীকে পছন্দ করে। আল্লাহ আমাদের সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। আমীন।

যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর এর প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে আপনার বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করতে ভুলবেন না।

ট্যাগ: যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান যুদ্ধে কাফিরদের সহযোগিতা করার বিধান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *