বিদয়াত সম্পর্কে উদাসীনতা – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনির
বিদয়াত সম্পর্কে উদাসীনতা শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনির এর বিদয়াতে দ্বলালা বই থেকে হুবহু নেয়া হয়েছে।
উপরে বর্ণিত আয়াত ও হাদিস সমূহ স্পষ্টভাবে বিদয়াতের ভয়াবহতা প্রমাণ করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এধরনের সুস্পষ্ট সতর্কবার্তা ও ভয়াবহতা বর্ণিত থাকার পরও দেখা যায় বেশিরভাগ লোক এমনকি যারা স্বনামধন্য ইসলামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত তাদের একটি বিরাট অংশ বিদয়াত সম্পর্কে পুরোপুরি উদাসীনতার পরিচয় দিয়ে থাকে। তারা নিজেরা বিদয়াত থেকে বেঁচে থাকা এবং বিদয়াত সম্পর্কে জানার চেষ্টা তো করেই না উপরন্তু কেউ বিদয়াত সম্পর্কে আলোচনা শুরু করলে তাকে বিভিন্ন জটিল-কুটিল প্রশ্ন করে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। বিদয়াতের কথা শুনলেই তারা বলে ওঠে, তাহলে তো, মাইকে আজান দেওয়া, মোবাইলে কথা বলা, বাস-ট্রেনে ভ্রমণ করা সবই বিদয়াত! তাদের ভাব দেখে মনে হয় বিদয়াত বলে যে আসলে কিছু আছে তা তারা স্বীকার করে না। যদি তারা এটা স্বীকারই করবে তবে বিদয়াতের সঠিক সংজ্ঞা কি এবং বর্তমান যুগে প্রচলিত বিদয়াতগুলো কি সে বিষয়ে আলোচনা করে না কেনো? এটা ঠিক যে বর্তমানে কিছু বিদয়াতকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। এমন অনেক বিষয়কে তারা বিদয়াত বলে আখ্যায়িত করছে যেগুলো শরীয়তে বৈধ বা মুস্তাহাব। কিন্তু কেবলমাত্র ঐ সকল লোকদের সমালোচনা করা এবং তাদের ভুল-ত্রুটিগুলো উপস্থাপন করলেই কি আলেমদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? বিদয়াতের প্রকৃত অর্থ নির্ণয় করা এবং সাধারন মুসলিমদের তার ভয়াবহতা হতে সতর্ক করা কি আলেমদের দায়িত্বের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত নয়? এ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন আলেম খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এই উদাসীনতার কারণে মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে বিদয়াতী কার্যকলাপ ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন বিদয়াতী ফিরকা শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ বিধি-বিধান সম্পর্কে আজগুবী ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রদান করতে শুরু করেছে। একদিকে রয়েছে পীর-ফকীরদের মারেফতী ব্যাখ্যা অন্য দিকে বিজ্ঞানমনা আধুনা চিন্তাবিদদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তার উপর আছে সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর খেয়াল-খুশি মতো ব্যাখ্যা। কেউ বলছে, পীর ধরা ফরজ, যার পীর নেই তার পীর শয়তান ইত্যাদি। সেই সাথে রয়েছে পীর সাহেবদের প্রতি মুরিদানদের অতিভক্তির ক্ষতিকর প্রভাব। বিদয়াতী পীর-ফকীরদের কথা তো বাদ, যারা হাক্কানী পীর হিসেবে পরিচিত তাদের পুস্তাকাদিতেও শিরক-কুফর সহ নানা রকম বিভ্রান্ত চিন্তা-দর্শনের ছড়া-ছড়ি। পীর সাহেব আদেশ করলে এমনকি জায়-নামাজ মদ দিয়ে ভিজিয়ে ফেল, জেনা করতে বললে, জেনা করা, কবিরা গোনাহে লিপ্ত হওয়া ছাড়া অন্য কোনো অপরাধে পীর সাহেবের উপর আপত্তি উত্থাপন না করা এবং কবিরা গোনাহে লিপ্ত হওয়ার পরও কেবলমাত্র যারা মুফতি ও ফকীহ স্তরের তারা ছাড়া অন্য কেউ পীর সাহেবকে সংশোধন করার প্রচেষ্টা না করা ইত্যাদি। আহলে হাদীসরা বলছে, আল্লাহর দেওয়া মুসলিম পরিচয় পরিবর্তন করে হানাফী, শাফেঈ, হাম্বালী ইত্যাদি নামে নিজেকে পরিচয় দেওয়া হারাম। এদের মধ্যে কেউ কেউ এমন কি সুন্নী বা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত নামে পরিচয় দেওয়াও নিষিদ্ধ মনে করে। সাধারন মুসলিমদের জন্য কোনো একটি নির্দিষ্ট মাজহাব মেনে চলা হারাম মনে করে। বিপরীত দিকে মাজহাবী ওলামায়ে কিরামের কেউ কেউ তাকলীদে শাখসী তথা সারাটা জীবন নির্দষ্ট একটি মাযহাবের আনুগত্য করে যাওয়া ফরজ মনে করে। এমনকি যদি কোনো ব্যক্তি কুরআন হাদীসের উপর ব্যাপক গবেষণা করে বুঝতে পারে তার মাজহাবের মতটি সঠিক নয় তার ক্ষেত্রেও মাজহাবের মত পরিত্যাগ করা এক শ্রেনীর আলেম অনুচিত মনে করেন। তাদের মধ্যে নেতৃত্বস্থানীয় ব্যাক্তিরাও অনেক সময় বলে ফেলেন, “এ মাসয়ালায় যদিও শাফেঈ মাজহাবের দলিল-প্রমান অধিক শক্ত তবু যেহেতু আমরা হানাফী মাজহাবের মুকাল্লিদ তাই আমাদের হানাফী মাজহাবের ফতোয়া মেনে চলতে হবে।”
বিজ্ঞানমনা আধুনা ইসলামী চিন্তাবিদরা বলছে, কোনো একটি কিতাব আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে কিনা সেটা বুঝতে হলে বিজ্ঞানের সাথে তা মিলিয়ে দেখতে হবে। যদি বিজ্ঞানের সাথে কিতাবটির হুবহু মিল পাওয়া যায় তাহলে প্রমাণিত হবে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে নতুবা নয়। এভাবে আল্লাহর নাজিল করা কিতাব সত্য কি মিথ্যা সেটা প্রমাণ করার দায়িত্ব তারা মানুষের তৈরী বিজ্ঞানের উপর ছেড়ে দিয়েছে। আল্লাহর কাছে এ ধরনের দূর্মতি থেকে আশ্রয় চাই। এই মতাদর্শের লোকেরা পবিত্র কুরআনকে আল্লাহর কিতাব হিসেবে প্রমাণ করার জন্য এর প্রতিটি আয়াতকে টেনে-হেচড়ে বিজ্ঞানের সাথে মিলানোর চেষ্টা করছেন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ চাঁদকে নুর বলেছেন। তারা বলে ‘নুর’ অর্থ ধার করা আলো অর্থাৎ পবিত্র কুরআন দেড় হাজার বছর আগেই বলে দিয়েছে চাঁদের আলো ধার করা আর বিজ্ঞান এখন সেটা স্বীকার করে নিয়েছে। এই ব্যাখ্যা শুনে শ্রোতারা নিজেদের অজান্তেই বলে ওঠেন ‘সুবহানআল্লাহ’। কিন্তু নুর মানে ধার করা আলো এটা যে বক্তা কোথা থেকে ধার করলো সে প্রশ্ন কেউ করে না। আরবী অভিধানে কি নুর অর্থ ‘ধার করা আলো’ এটা লেখা আছে? কুরআন-হাদিসের কোথাও কি বলা আছে নুর অর্থ ধার করা আলো? তাছাড়া আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনকে নুর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, “তোমাদের নিকট আমি নাজিল করেছি সুস্পষ্ট নুর” (সূরা নূর-১২৪) অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আল্লাহ হলেন আকাশ ও পৃথিবীর নুর।” (সূরা নূর-৩৫) যদি নূর অর্থ ধার করা আলো হয় তবে প্রশ্ন হলো, আল্লাহর কি ধার করা আলো এবং তার কিতাব মহাগ্রন্থ আল কুরআনের আলোও কি ধার করা! আজগুবি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের এটাই হলো সমস্যা, একটু মিলিয়ে দেখতে গেলেই গরমিল হয়ে যায়। বিজ্ঞানের আলোকে পবিত্র কুরআনকে সহীহ্ শুদ্ধ প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে আরও অনেক উদ্ভট ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হাজির করা হয়। সাজদা করলে মাটি থেকে কি পরিমান ইলেকট্রন, প্রটন বা নিউটন মাথার মধ্যে প্রবেশ করে এবং সুস্থাস্থ্য রক্ষায় তা কি পরিমান ভূমিকা রাখে, নামাযের সময় নাভীর নিচে হাত রাখলে তা কীভাবে যৌন শক্তি বৃদ্ধি করে, সওম পালন করলে শরীর স্বাস্থ্যের কি উন্নতি ঘটে সেসব বিষয়ে শুরু হয় পন্ডিত্বপূর্ণ আলোচনা।
“সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই” এই মতবাদে বিশ্বাসী নেতা-নেত্রীবর্গ “তোমার দ্বীন তোমার আমার দ্বীন আমার” এই প্রকৃতির কিছু আয়াত ও হাদিস পেশ করে ঘোষণা করে সকল ধর্মই উত্তম কথা বলে। কোনো ধর্মকে বাতিল ও ভ্রান্ত বলা যাবে না, নিজের ধর্মকেই একমাত্র সঠিক ও অভ্রান্ত বলে দাবী করা যাবে না ইত্যাদি।
ইসলাম সম্পর্কে এই প্রকৃতির ভুল ব্যাখ্যা সাধারন মুসলিমদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল যা বলেন নি তা তাদের নামে চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে যা নেই তা দ্বীনের নামে প্রচার করা হচ্ছে। এই সকল সুস্পষ্ট বিদয়াতের বিপরীতে শক্ত কন্ঠে প্রতিবাদ করার মতো কেউ নেই। সবাই এসব ব্যাপারে উদাসীন।
বিদয়াত সম্পর্কে উদাসীনতা বিদয়াত সম্পর্কে উদাসীনতা বিদয়াত সম্পর্কে উদাসীনতা
আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন…..