বিদয়াত সম্পর্কে বাড়াবাড়ি – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনির

বিদয়াত সম্পর্কে বাড়াবাড়ি প্রবন্ধটি বিদয়াতে দ্বালালাহ গ্রন্থ হতে নেয়া হয়েছে।

উপরোক্ত দলের বিপরীতে এমন একদল লোক রয়েছে যারা বিদয়াতের ব্যাপারে মাত্রাতিরিক্ত কড়াকড়ি করে থাকে। তারা এমনকি বৈধ বা উত্তম কার্যকলাপকেও অনেক সময় বিদয়াত হিসেবে আখ্যায়িত করে তার বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে থাকে। সুর করে দরুদ শরীফ পাঠ করা, একত্রিত হয়ে আল্লাহর যিকির করা, পাঁচ ওয়াক্ত সলাতের শেষে সম্মিলিতভাবে মোনাজাত করা ইত্যাদি বিভিন্ন কাজকে বিদয়াত হিসেবে আখ্যায়িত করে সেসব কাজে লিপ্ত সাধারন মুসলিমদের কঠোরভাবে তিরষ্কার করে থাকে। এখানেই শেষ নয় এরা পূর্ববর্তী নেককার ওলামায়ে কিরামকে বিভিন্ন ভাষায় বিদয়াতী হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। যখনই তারা শোনে পূর্ববর্তী কোনো একজন নেককার ব্যক্তি সারারাত সলাত আদায় করতো বা বিষিদ্ধ দিনগুলো ব্যতীত সারা বছর সওম পালন করতো কালবিলম্ব না করে তারা উক্ত ব্যক্তির নিন্দা মন্দ শুরু করে। তারা বলে, যেহেতু রসুলুল্লাহ সাঃ এভাবে ইবাদত করেন নি তাই এটা করা বিদয়াত। যারা একইরাত্রে একবার বা কয়েকবার পবিত্র কুরআন খতম দিয়েছেন বলে বর্ণিত আছে তাদের ব্যাপারেও এই সকল লোকেরা একই মন্তব্য করে। এদের প্রচার প্রসারে বিভ্রান্ত হয়ে সাধারন মুসলিমরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। উপরে বর্ণিত দলটির তুলনায় এই দলটির কার্যকলাপ অধিক ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। যেহেতু তারা মানুষকে ভাল কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টায় প্রাণান্তকর সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। এই সকল অজ্ঞ লোকেরা বিদয়াতের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার তুলনায় নিরব থাকলেই অধিক কল্যাণ হতো। ইমাম শাতেবী আল-ই’তিসামের ভূমিকাতে ইমাম মালিক হতে একটি শিক্ষনীয় উক্তি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ইবনে ফররুখ নামে একজন ব্যক্তি তার নিজ এলাকায় বিদয়াতীদের উৎপাত লক্ষ্য করে তাদের বিরুদ্ধে একটি বই লেখেন। বইটি প্রকাশের পূর্বে তিনি ইমাম মালিকের নিকট এ বিষয়ে অনুমতি চেয়ে পত্র লিখলে ইমাম মালিক তাকে লিখে পাঠান,

“তুমি যদি এমন কিছু করতে চাও তবে আমার আশঙ্কা হচ্ছে তুমি পথ হারা হয়ে ধ্বংস হবে। বিদয়াতীদের বিপরীতে কেবল এমন ব্যক্তির দাড়ানো উচিৎ  যে নিজে কি বলছে সে সম্পর্কে পুরোপুরি সজাগ। (অর্থাৎ যা বলবে জেনে-শুনে বলবে। অজ্ঞতার কারণে বা অতিরিক্ত আবেগী হয়ে ভুল কিছু বলে বসবে না। যেটা বিদয়াত নয় সেটাকে বিদয়াত হিসেবে আখ্যায়িত করে তার বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হবে না) এবং এমনভাবে তাদের প্রতিবাদ করবে যাতে তারা লা জওয়াব হয়ে যায় (তার বিরুদ্ধে বিদয়াতীরা যেনো কোনরুপ যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করতে না পারে।) এভাবে করতে পারলে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যার এমন যোগ্যতা নেই তার ব্যাপারে আমার ভয় হয়, সে হয়তো তাদের প্রতিবাদ করতে যেয়ে নিজেই ভুল কথা বলবে, (যেটা বিদয়াত নয় সেটাকে বিদয়াত বলে বসবে) আর তারা তার কথার উপর ভিত্তি করে সেই ভুলকেই ঠিক হিসেবে গ্রহণ করে তার উপর টিকে থাকবে অথবা (সে হয়তো প্রকৃত বিদয়াতকেই বিদয়াত হিসেবে আখ্যায়িত করছে কিন্তু যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপণে অদক্ষ হওয়ার কারণে) বিদয়াতীরা তার উপর বিজয়ী হয়ে যাবে ফলে তাদের স্পর্ধা পূর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পাবে।

বর্তমানে আমরা ইমাম মালিকের কথার হুবহু প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। একদল লোক বিদয়াতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার নামে সকল প্রকারের ভাল জিনিসের বিপরীতে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। প্রকৃতই যারা বিদয়াতী এরা তাদের পরিত্যাগ করে সাধারন মুসলিমদের যিকির-আযকার, তসবীহ্ তাহলিল ও দোয়া-দরুদের মধ্যে বিদয়াতের গন্ধ শুকে বেড়াচ্ছে। যে ব্যক্তি নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করে না সেই কিনা মুসলমানদের হানাফী, শাফেই, ইত্যাদি পরিচয়ে পরিচয় দিতে নিষেধ করছে। যে ব্যক্তি পবিত্র বাইবেল পবিত্র গীতা ইত্যাদি নিষিদ্ধ শব্দ উচ্চারণ করে বিধর্মীদের ধর্মীয় গ্রন্ধাবলীকে সম্মান প্রদর্শন করছে সেই কিনা আল্লাহর দেওয়া পবিত্র বিধান জিহাদকে পবিত্র যুদ্ধ বলতে অস্বীকার করছে। যেহেতু কুরআন হাদীসের কোথাও জিহাদকে পবিত্র যুদ্ধ তথা হারবুম মুকাদ্দাস বলা হয়নি। প্রশ্ন হলো, তবে কি পবিত্র কুরআনে পবিত্র বাইবেল কথাটি লেখা আছে? অথবা পবিত্র গীতা! আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। একজন মুসলিম যখন রসুলে আকদাস সাঃ এর ভালবাসায় আবেগপ্রবণ হয়ে মদীনা মুনাওয়ারাতে রওজা মোবারক জিয়ারতে রওয়ানা হয় এই নেক আমল থেকে উক্ত ব্যক্তিকে ফিরানোর জন্য কিছু লোক ফতোয়াবাজী শুরু করে। রসুলে আকদাস সাঃ এর কবর জিয়ারত করাকে বিদয়াত এমনকি শিরক-কুফর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সৌদি আরবের রাজা-মহারাজারা যখন আমেরিকা জিয়ারতে রওয়ানা হয় এবং সেখানে গমণ করে বেগানা নারীদের সাথে নাচা-গাওয়া করে, ক্রুশ পরিধান করে, মদ পান করে তখন এসকল ফতোয়াবাজদের তোয়াজ করা ছাড়া ভিন্ন কোনো কাজ থাকে না। রসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন আরব উপদ্বীপ থেকে ইয়াহুদী-খৃষ্টানদের বহিঃষ্কার করো। সে নির্দেশ অমান্য করে যারা আমেরিকান সৈন্যদের আরব উপদ্বীপে স্থান দিয়েছে, যারা আফগানস্থানের ইসলামী রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করে নিঃশেষ করতে ইয়াহুদী খৃষ্টানদের সহযোগীতা করেছে সেই সব খান্নাস শয়তানদের আমীরুল মুমিনিন ও ওলীউল আমর হিসেবে আখ্যায়িত করতে এই সকল ফতোয়াবাজদের মুখে বাধে না। এরচেয়েও বড় বিদয়াতটি হলো, সৌদি আরবের যুবকদের বলা হচ্ছে ওলিউল আমর তথা আমেরিকার ধ্বজাধারী সৌদি রাজাধিরাজের অনুমতি ছাড়া নাকি আমেরিকার বিরুদ্ধে জিহাদ করা যাবে না। এভাবে অন্যান্য মুসলিম দেশের নাস্তিক-মুরতাদ ও তাদের মদদপুষ্ট রাষ্ট্রপ্রধানদের অনুমতি ছাড়া কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা নাকি ইসলামের দৃষ্টিতে চরম অন্যায়। অনেকটা আব্দুল্লাহ ইবনে উবায়ের অনুমতি নিয়ে কুরাইশ কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করার মতো। নীল আকাশের নীচে এরচেয়ে বেশি বড় বিদয়াত খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সেটা ব্যাপক গবেষণার বিষয়। এই বিদয়াতীরাই আবার আফগান মুজাহিদদের কারো হাতে তাবীজ ঝুলতে দেখলে বা তার মুখে ইয়া রাসুলুল্লাহ সাঃ শুনলে দাত-মুখ খিচিয়ে তাদের মুশরিক মুরতাদ বা কমপক্ষে ঘৃণিত বিদয়াতী হিসেবে আখ্যায়িত করে ভীষণ তিরষ্কার করে থাকে। এরা বিদয়াতের বিরুদ্ধে গলাবাজী করে অথচ নিজেরোই সর্বাপেক্ষা বড় বিদয়াতী। এরা নিজেরা বড় বড় বিদয়াতে লিপ্ত রয়েছে অথচ সাধারন মানুষ দোয়া-দরুদ বা যিকির আযকার করলে তাদের বিদয়াতী হিসেবে আখ্যায়িত করে গাল-মন্দ করে। এদের আজগুবি প্রচার প্রচারনায় অতিষ্ঠ হয়ে কেউ কেউ বিরক্তি প্রকাশ করে বলে ওঠে, দোয়া-মোনাজাত, যিকির-আযকার, এসব যদি বিদয়াত হয় তবে তো বাস ট্রাক, মোবাইল মিসাইল সবই বিদয়াত। তুমিও বিদয়াত তোমার বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষ বিদয়াত। কিন্তু এভাবে বিরক্তি প্রকাশ করলেই এই জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না বরং শরীয়তের নিক্তিতে এসব উক্তির ত্রুটি বিচ্যুতি তুলে ধরতে হবে। সে উদ্দেশেই আমাদের এই সংক্তিপ্ত প্রয়াস।

বিদয়াত সম্পর্কে বাড়াবাড়ি বিদয়াত সম্পর্কে বাড়াবাড়ি

আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দেয়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন….

আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করতে এখানে ক্লিক করুন…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *