বিদয়াতের ভয়াবহতা – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনির
বিদয়াতের ভয়াবহতা – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনির এর দ্বলালা আলা বিদয়াতে দ্বলালা গ্রন্থের পাঠ
আল্লাহ বলেন, আমি জিন ও মানুষকে কেবলমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি। (সুরা যারিয়াত-৫৬)
ইবাদত অর্থ হলো দাসত্ব করা বা আনুগত্য করা, নিজের ইচ্ছা ও পছন্দ-অপছন্দকে বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর পছন্দ-অপছন্দের সামনে মথা নত করা এবং তার আদেশ-নিশেধ মেনে চলার নামই হলো ইবাদত। বিপরীত দিকে আল্লাহর দেওয়া বিধি-বিধান পরিত্যাগ করে নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো কোনো বিধি-বিধানকে আল্লাহর বিধান হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার নামই হলো বিদয়াত। দ্বীনের ভিতরে বিদয়াত সৃষ্টি করা মারত্বক অপরাধ। আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন,
তোমরা নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো বলো না এটা হালাল আর এটা হারাম। এতে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করা হয়। আর যারা আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে তারা কখনও সফল হয় না। (সুরা নাহল-১১৬)
আপনি বলুন তোমরা কি লক্ষ্য করেছো! আল্লাহ তোমাদের যে রিজিক দিয়েছেন তোমরা নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো তার কিছু অংশকে বলছো হালাল আর কিছু অংশকে বলছো হারাম। আপনি বলুন, আল্লাহ কি তোমাদের এমন করার অনুমতি প্রদান করেছেন? নাকি তোমরা আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করছো? যারা আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে তারা কি ভাবে না কিয়ামতের দিন তাদের কি অবস্থা হবে! (সুরা ইউনুস-৫৯-৬০)
এছাড়া অন্যান্য আয়াতে আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা কথা আরোপ করার ভয়াবহতা বর্ণনা করা হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, আপনি দেখুন তারা কিভাবে আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যারোপ করে। মারাত্ত্বক অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট। (সুরা নিসা-৫০)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, তার চেয়ে মহাপাপী আর কে হতে পারে যে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে বা বলে, আমার উপর ওহী হয়েছে অথচ তার উপর কিছুই ওহী হয়নি। একইভাবে যে ব্যক্তি বলে আল্লাহ যা নাজিল করেছেন আমি সেরকম কিছু নাজিল করতে পারি। আপনি যদি দেখতেন এই সকল পাপী লোকদের মৃত্যু যন্ত্রণা শুরু হলে ফেরেশতারা বলবে তোমাদের প্রাণ বাহির করো। আজ তোমাদের অপমানকর শাস্তি দেওয়া হবে। আল্লাহর ব্যাপারে তোমরা যে মিথ্যা বলতে এবং আল্লাহর আয়াতকে অগ্রাহ্য করতে তার বিনিময়ে। (সুরা আনয়াম-৯২)
এই আয়াতে বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় হলো, আল্লাহ তায়ালা নিজের খেয়াল খুশি মতো কোনো বিধি-বিধানকে আল্লাহর দ্বীন হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার অপরাধকে মিথ্যা নবুওত দাবি করা বা আল্লাহর আয়াতের মতো আয়াত নাজিল করতে পারার দাবী করার ন্যায় মারাত্নক অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছেন। এর মাধ্যমে বিদয়াতের ভয়াবহতা প্রমাণিত হয়। যেহেতু বিদয়াতী নিজের মনগড়া নিয়ম-কানুনকে আল্লাহর দ্বীন হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করে।
রসুলুল্লাহ সাঃ এ বিষয়ে সতর্ক করে বলেন, সর্বোত্তম পন্থা হলো মুহাম্মদ সাঃ এর পন্থা এবং সর্ব নিকৃষ্ট বিষয় হলো নতুন সৃষ্ট বিষয়। আর প্রতিটি বিদয়াতই হলো পথভ্রষ্টতা। (সহীহ মুসলিম)
আবু দাউদ শরীফের একটি বর্ণনাতে এসেছে, রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, তোমরা নতুন সৃষ্ট বিষয়াবলী থেকে সতর্ক থাকো কেননা প্রতিটি নতুন সৃষ্ট বিষয় বিদয়াত, প্রতিটি বিদয়াত পথভ্রষ্টতা।
নাসাঈর বর্ণনাতে এই হাদিসটির শেষে অতিরিক্ত এসেছে, এবং প্রতিটি পথভ্রষ্টতা জাহান্নাম।
যে কেউ আমার এই দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু নতুন কিছু সৃষ্টি করে যা এর মধ্যে নেই তবে তা পরিত্যক্ত। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
তিনি আরও বলেন, যে কেউ এমন কোনো আমল করে যে ব্যাপারে আমার নির্দেশ নেই তা গ্রহণীয় নয়। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
আবু দাউদ শরীফের একটি রেওয়ায়েতে এসেছে, যে কেউ আমার নির্দেশের বাইরে কোনো কাজ করে তা পরিত্যক্ত। এছাড়া সাধারনভাবে রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, আমার উপর মিথ্যারোপ করা অন্য কারও উপর মিথ্যারোপ করার মতো নয়। যে কেউ আমার উপর মিথ্যারোপ করে তার স্থান জাহান্নামে। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
অন্য একটি হাদিসে এসেছে,
যে কেউ কোনো বিদয়াতীকে সম্মান করে সে দ্বীন ধ্বংসে সাহায্য করে। (বাইহাক্বী শোয়াবুল ঈমান)
মুহাদ্দীসীনে কিরাম এই হাদিসটিকে দূর্বল বলেছেন। কেউ কেউ বলেছেন মাওজু। তবে হাদিসটির মূলভাব অন্যান্য হাদিসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। যেহেতু বিদয়াত বলতে বোঝায় শরিয়তের বিপরীত বিষয়কে শরিয়তের নামে চালু করা। সংক্ষেপে বলা যায় বিদয়াত হলো নকল শরিয়ত। বিদয়াত চলতে থাকলে নকল শরিয়তের ভিড়ে আসল শরিয়ত চিনে নেওয়া যে কষ্টকর বা ক্ষেত্র বিশেষে অসম্ভব হয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। এভাবে বিদয়াতের মাধ্যমে শরিয়ত ধ্বংস প্রাপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। যে বিদয়াত সৃষ্টি করে প্রকারান্তরে সে দ্বীন ধ্বংসের প্রয়াস চালায় আর যে তাকে সম্মান করে সে তাকে দ্বীন ধ্বংসের কাজে সহযোগিতা করেছে বলে গণ্য হয়।
মোল্লাহ আলী কারী রঃ এই হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা তিবী রঃ থেকে উল্লেখ করেছেন, তিনি বলেন,
যদি বিদয়াতীকে সম্মান করার বিষয়টি এমন হয় তবে যে নিজেই বিদয়াতী তার অবস্থা কি? (মিরকাত)
আরেকটি হাদিসে এসেছে, রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,
যে কেউ এমন কাউকে আশ্রয় দেয় যে নতুন কিছু করে তার উপর আল্লাহর অভিশাপ। (সহীহ মুসলিম)
এই হাদীসে মুহদিস শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ ‘যে নতুন কিছু করে।’ মূলত এই হাদীসে নতুন কিছু করা বলতে শরীয়তে শাস্তিযোগ্য কোনো অপরাধে লিপ্ত হওয়া বোঝানো হয়েছে। তবে হাদীসের ব্যাখ্যাকাররা এখানে বিদয়াতীকেও এই হাদীসের অর্থের মধ্যে শামিল করেছেন। ইবনে আছীর আন-নিহায়াতে দুটি ব্যাখ্যাই উল্লেখ করেছেন।
ইবনে মাযা বর্ণিত একটি রেওয়ায়েতে এসেছে, রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,
একজন বিদয়াতী যতক্ষণ না তওবা করবে ততক্ষণ তার কোনো আমল আল্লাহ কবুল করবেন না। এই হাদীসটির সনদ দূর্বল তবে মুসলিম শরীফে বর্ণিত একটি হাদীস এই হাদীসের সাথে সামর্থপূর্ণ। সেখানে ক্বদরিয়াদের সম্পর্কে ইবনে উমর রাঃ আল্লাহর কসম করে বলেন,
যদি তারা উহুদ পরিমাণ স্বর্ণ দান করে আল্লাহ তা কবুল করবেন না যতক্ষণ না তারা তাকদীরে বিশ্বাস স্থাপন করে। (সহীহ মুসলিম)
ইমাম নাব্বী রঃ শারহে মুসলিমে বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাঃ এর এই কথার দুরকম অর্থ হতে পারে। হতে পারে তিনি এই সকল কাদরিয়াদের কাফির বলে আখ্যায়িত করেছেন একারণে তাদের কোনো আমল কবুল হবে না এমন মন্তব্য করেছেন। আবার এমনও হতে পারে যে তিনি আসলে তারা কাফির এমন উদ্দেশ্য করেন নি বরং দ্বীনের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার অপরাধে তাদের আমল কবুল হবে না এমন মন্তব্য করেছেন।
শেষের অর্থটি গ্রহণ করলে তার কথার মধ্যে বিদয়াতীর আমল কবুল না হওয়ার স্বপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়।
মোট কথা, যে আমলে বিদয়াত সংঘটিত হচ্ছে সেটা কবুল না হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। যেহেতু রসুলুল্লাহ সাঃ স্পষ্টভাবে বলেছেন, যে কেউ এমন কোনো আমল করে যে ব্যাপারে আমার নির্দেশ নেই তা পরিত্যক্ত। উদাহরণস্বরুপ যদি কেউ ভর দুপুরে রোদে দাড়িয়ে থাকলে সওয়াব হয় এমন মনে করে সারাটা দুপুর রোদে দাড়িয়ে থাকে তবে তার এই কষ্ট-ক্লেশ আল্লাহর দরবারে ভাল আমল হিসেবে গণ্য নয়। যেহেতু এ বিষয়ে আল্লাহ বা তার রাসুল কোনো নির্দেশনা প্রদান করেন নি। এই ব্যক্তির রোদে দাড়িয়ে থাকাটা যে কোনো আমল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয় সে ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন নেই। উপরন্তু সে বিদয়াতী হিসেবে গণ্য হবে এবং তার পাপ হবে। এমনকি তার অন্যান্য আমল কবুল হবে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। যেমনটি আমরা উপরে বর্ণনা করেছি।
ইমাম তিরমিযী রঃ বর্ণনা করেন,
যে কেউ আমার পর আমার কোনো মৃত সুন্নাতকে জীবিত করবে তার পর যত লোক ঐ সুন্নাতের উপর আমল করবে সে তাদের সমান সওয়াব প্রাপ্ত হবে যদিও তাদের সওয়াবে সামান্যও কমতি হবে না। আর যে কেউ এমন কোনো বিদয়াত সৃষ্টি করে যা পথভ্রষ্টতা হিসেবে গণ্য এবং আল্লাহ ও রাসুলের নিকট অপছন্দনীয় তার পর যত লোক ঐ বিষয়ের উপর আমল করবে তাদের সবার সমান পাপ তার জন্য লেখা হবে। যদিও অন্যদের পাপে সামান্যও কমতি হবে না।
হাদীসটি বর্ণনা করার পর ইমাম তিরমিযী বলেন, “হাদিসটি হাসান সহীহ”।
সহীহ বুখারী ও মুসলিমের একটি বর্ণনাতে এসেছে, রসুল্লুল্লাহ সাঃ যখন তার উম্মতকে হাওজে কাওছারের পানি পান করাবেন তখন একদল লোক তার নিকট আগমণ করবেন। তিনি তাদের চিনতে পারবেন এবং তাদের পানি খাওয়ানোর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন। হঠাৎ একটি পর্দা এসে তাদের আড়াল করে দেবে। রসুলুল্লাহ সাঃ বলবেন, এরা তো আমার লোক। তাকে বলা হবে, আপনি তো জানেন না আপনার পরে এরা নতুন কি করেছিল। অন্য বর্ণনায় এসেছে, “আপনি তো জানেন না আপনার পরে এরা কি পরিবর্তন করেছিল।” এটা শুনে রসুলুল্লাহ সাঃ বলবেন, “আমার পর যারা পরিবর্তন করেছিলে তারা দূর হও”।
ইমাম নাব্বী রঃ শারহে মুসলিমে এই হাদিসের ব্যাখ্যায় আলেমদের বিভিন্ন মত উল্লেখ করেছেন। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, এখানে মুনাফিক ও মুরতাদদের কথা বলা হচ্ছে যারা রসুলু্ল্লাহ সাঃ এর মৃত্যুর পর দ্বীন ইসলাম পরিত্যাগ করেছিল। কেউ কেউ বলেছেন, এরা হলো বিদয়াতীরা যারা ইসলামের উপর টিকে থাকার দাবী করতো কিন্তু ইসলামী বিধি-বিধানে পরিবর্তন সাধন করেছিল। ইবনে বাত্তাল রঃ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যায় বলেন, সকল প্রকারের বিদয়াতী ও অপরাধীরা এই হাদীসের আওতাভুক্ত।
এর উপর ভিত্তি করে বলা যায়, যে কেউ রসুলুল্লাহ সাঃ এর সুন্নাত পরিত্যাগ করে বিদয়াতের অনুসরণ করবে কিয়ামতের দিন তাকে হওজে কাউছারের পানি পান করতে দেওয়া হবে না। আল্লাহর নিকট আমরা এ ধরনের পরিণতি থেকে আশ্রয় চাই। বিদয়াতের ভয়াবহতা সম্পর্কে এধরণের অনেক বর্ণনা রয়েছে যা এখানে সবিস্তারে উল্লেখ করা সম্ভব নয়।
বিদয়াতের ভয়াবহতা বিদয়াতের ভয়াবহতা বিদয়াতের ভয়াবহতা বিদয়াতের ভয়াবহতা বিদয়াতের ভয়াবহতা
ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন…..
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে এখানে ক্লিক করুন……
সুন্দর পোস্ট ما شاء الله