তাবিজ তুমারের বিধান – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মূনীর
তাবিজ তুমারের বিধান – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মূনীর প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে অবশ্যই শেয়ার করবেন।
এ বিষয়টিও তাবাররুক ও তাওয়াসসুলের বিধানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। যেহেতু এখানে কুরআনের আয়াত বা অন্য কোনো উত্তম যিকিরের ওসীলায় রোগ হতে মুক্তি লাভের চেষ্টা করা হয়। এর তিনটি পদ্ধতি রায়েছে।
১। দোয়া-কালাম পাঠ করে রোগীকে ঝাড়-ফুঁক করা।
২। দোয়া পড়ে পানিতে ফুঁ দেওয়া এবং সেই পানি রোগীকে পান করানো বা রোগীর শরীরে মাখিয়ে দেওয়া।
৩। দোয়া-কালাম লেখা কাগজ তাবীজে ভরে রোগীর শরীরে লটকিয়ে দেওয়া।
নিম্নে এই সকল বিষয় সম্পর্কে পৃথকভাবে আলোচনা করা হলো।
দোয়া-কালাম পাঠ করে রোগীকে ঝাড়-ফুঁক করা।
রসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, “ঝাড়-ফুঁক, জাদু-টোনা ও তাবীজ-তুমার শিরক” (আবু দাউদ রঃ বর্ণনা করেছেন। শায়েখ আলবানী সহীহ বলেছেন। সহীহা-২৯৭২)
অন্য হাদীসে এসেছে, রসূলুল্লাহ্ সাঃ বলেন,
তোমরা ঝাড়-ফুঁকের সময় যেসব মন্ত্র পাঠ করো তা আমাকে পড়ে শোনাও যদি তার মধ্যে কোনো শিরক না থাকে তবে সমস্যা নেই। (সহীহ্ মুসলিম)
এছাড়া রসূলুল্লাহ সাঃ এর উপর এক ইয়াহুদী জাদু করলে জিব্রাঈল আঃ নিজে তাকে ঝাড়-ফুঁক করেন। তিনি বলেন, আমি তার জন্য আপনাকে আল্লাহর নামে ঝাড়-ফুঁক করছি। আপনার মধ্যে যা কিছু রোগ আছে আল্লাহ তা থেকে মুক্ত করবেন। (সহীহ্ মুসলিম)
রসুলুল্লাহ এর একজন সাহাবী একবার কোনো একজন ব্যক্তিকে সূরা ফাতিহা পড়ে ফুঁ দিলে তার রোগ সেরে যায়। এবং এর বিনিময়ে তাকে ১০০ ছাগল উপহার দেয়। রসূল্লাহ সাঃ এটা শুনে খুশি হয়ে বলেন, সে কিভাবে জানলো যে সূরা ফাতিহার মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক করা যায়! তোমরা ছাগলগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নাও আমার জন্যে একটি অংশ রেখো। (মুসলিম)
এই সকল হাদীসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে ওলামায়ে কিরাম বলেছেন, যে হাদীসে ঝাড়-ফুঁককে শিরক বলা হয়েছে সেখানে সকল প্রকার ঝাড়-ফুঁক উদ্দেশ্য নয় বরং যেসব ঝাঁড়-ফুঁকের মধ্যে শিরক কুফর রয়েছে কেবল সেগুলো উদ্দেশ্য। যেহেতু অন্য হাদীসে বলা হয়েছে। “ঝাঁড়ফুকে কোনো সমস্যা নেই যদি তাতে শিরক না থাকে”। একারণে ওলামায়ে কিরাম শর্ত স্বাপেক্ষ ঝাড়-ফুঁককে বৈধ বলেছেন।
ইবনে হাযার আসক্বলানী রঃ বলেন,
উলামায়ে কিরাম ইজমা করেছেন যে, তিনটি শর্তের উপর ভিত্তি করে ঝাড়-ফুঁক করা বৈধ। (ক) সেটা আল্লাহর কালাম, তার নাম ও গুনাবলীর মাধ্যমে হতে হবে। (খ) আরবী ভাষায় হতে হবে বা এমন ভাষায় হতে হবে যার অর্থ বোধগম্য। (গ) এমন বিশ্বাস বিদ্যমান থাকতে হবে যে, ঝাড়-ফুঁক স্বয়ংক্রীয়ভাবে কোনো কিছু করার ক্ষমতা রাখে না বরং আল্লাহর ইচ্ছায় তা কাজ করে। (ফাতহুল বারী)
উপরে বর্ণিত হাদীস সমূহের মূলভাব এবং ওলামায়ে কিরামের বক্তব্যের বিষয়বস্তু থেকে এটা অনুধাবন করা যায় যে, কেবল মাত্র কুরআনের আয়াত বা হাদীসে প্রমাণিত দোয়াই নয় বরং যে কোন ভাষায় আল্লাহর নাম গুনাবলী বা প্রসংশা সম্বলিত দোয়ার মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক করা যেতে পারে। যেহেতু রসুলুল্লাহ সাঃ স্পষ্ট বলেন, “শিরক নয় এমন যে কোন কিছুর মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক করতে দোষ নেই।” (মুসলিম)
তাছাড়া ওলামায়ে কিরামের বোধগম্য যে কোনো উত্তম কথা দ্বারা ঝাড়-ফুঁক করা বৈধ মনে করেছেন। ঐ হাদীসের মধ্যেও এ বিষয়ে প্রমাণ রয়েছে যেখানে একজন সাহাবী নিজে থেকেই সূরা ফাতিহা পাঠ করে ঝাড়-ফুঁক করেন এবং তার ঝাড়-ফুঁকে রোগী সুস্থ হয়। পরে রসুল্লাহ সাঃ বলেন,
সে কিভাবে জানলো যে সূরা ফাতিহার মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক করা যায়! তোমরা ছাগলগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নাও আমার জন্য একটি অংশ রেখো। (মুসলিম)
এটা প্রমাণ করে যে, রসুলুল্লাহ সাঃ উক্ত ব্যক্তিকে এটা শিক্ষা দেন নি। অন্য বর্ণনাতে আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। রসুলুল্লাহ সাঃ এর এই প্রশ্নে উক্ত ব্যক্তি বলেন,
হে আল্লাহর রসুল এটা আমার অন্তরে জাগ্রত হয়েছিল। (দারে কুতনী)
এটা প্রমাণ করে যে, নিজের চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে যে কোনো আয়াত বা দোয়াকে ঝাড়-ফুঁকের জন্য বাছায় করা য়ায়। আমরা এ বিষয়টি উল্লেখ করলাম কারণ কেউ কেউ এ বিষয়ে কড়াকড়ি করে বলে থাকে কুরআন বা হাদীসে বর্ণিত নেই এমন কিছুর মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক করা যাবে না।
দোয়া পড়ে পনিতে ফুঁ দিয়ে বা কুরআনের আয়াত লিখে পানিতে ভিজিয়ে সেই পানি রোগীকে পান করানো বা রোগীর শরীরে মাখিয়ে দেওয়া।
আবু দাউদ শরীফের একটি হাদীসে এমন বর্ণিত আছে যে রসূলুল্লাহ সাঃ দোয়া পাঠ করে মাটি ও পানিতে ফুঁ দিয়ে তা ছবিতে ইবনে কায়েসের শরীরে ঢেলে দেন। শায়েখ আলবানী বলেছেন হাদীসটি দুর্বল।
জাবির ইবনে আব্দিল্লাহ বর্ণনা করেন রসুলুল্লাহ সাঃ কে নাশরা (জ্বিনের আছর থেকে বা অন্য কোনো রোগ থেকে মুক্ত করার জন্য মন্ত্র পাঠ করা পানি দ্বারা রোগীর শরীর ধৌত করা) সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে। তিনি বলেন, “এটা তো শয়তানী কর্মকান্ড” (আবু দাউদ) (শায়েখ আলবানী হাদীসটিকে সহিহ্ বলেছেন)
ইমাম কুরতুবী রঃ বলেন, “নুশরা” বৈধ কিনা সে বিষয়ে আলেমরা মতপার্থক্য করেছেন। আর তা হলো আল্লাহর নাম বা কুরআন পাঠ করে সেটা পানি দ্বারা ধৌত করে উক্ত পানি রোগীকে পান করানো বা রোগীর শরীরে মাখানো। সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব এটাকে বৈধ বলেছেন। তাকে বলা হলো একজন ব্যক্তির উপর জাদু করার ফলে সে স্ত্রীর সাথে মিলিত হতে পারে না তার জন্য কি “নুশরা’’ বৈধ হবে? তিনি বললেন এতে কোন সমস্যা নেই। উপকারী কোনো বিষয় হতে নিষেধ করা হবে না। তবে মুজাহিদ কুরআনের আয়াত লিপিবদ্ধ করে সেটা ধৌত করা পানি রোগীকে পান করোনো পছন্দ করেন নি। আয়েশা রাঃ সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করে পানি ভর্তি পাত্রে ফুঁ দিয়ে তা রোগাগ্রস্তের উপর ঢেলে দিতেন।
তিনি আরো বলেন,
হাসান ও ইব্রাহীম আন-নাখঈ রঃ এটাকে নিষেধ বলেছেন। তিনি বলেছেন আমার তো মনে হয় এমন করলে রোগ আরো বেশি হবে। সম্ভবত তিনি মনে করেছেন যেহেতু এখানে কুরআন (পানি দ্বারা) মুছে ফেলা হচ্ছে তাই (এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে) রোগ মুক্তি হওয়ার পরিবর্তে রোগ বৃদ্ধি হওয়ার সম্ভবনায় বেশি। (তাফসীরে কুরতুবী)
ইবনে মুফলিহ্ রঃ বর্ণনা করেন, ইমাম আহম্দ ইবনে হাম্বলকে প্রশ্ন করা হলো, কোনো ব্যক্তি যদি একটি পাত্রে কুরআনের আয়াত লিখে পরে তাতে পানি ঢেলে রোগীকে পান করায় তবে এটা কেমন হবে? তিনি বলেন কোনো সমস্যা নেই। তাকে আবার প্রশ্ন করা হলো, যদি সে ঐ পানি দিয়ে গোসল করে তবে কেমন হবে। তিনি বললেন এ বিষয়ে আমি কিছু শুনি নি।
আল-খাল্লাল বলেন, উক্ত পানি দ্বারা গোসল করা অপছন্দনীয় হওয়ার কারণ হলো গোসলের সময় শরীরের বিভিন্ন স্থানে পানি প্রবেশ করে যেখানে কুরআন পাঠ করা পানি পৌছানো উচিৎ নয়।
তবে উক্ত পানি দ্বারা হাত মুখ ধৌত করা বৈধ হওয়ার ব্যাপারে আহমদ ইবনে হাম্বল রঃ থেকে বর্ণনা রয়েছে।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের ছেলে সালিহ্ বলেন,
কখনও কখনও আমি অসুস্থ হলে আমার পিতা একটি পাত্রে পানি নিয়ে তাতে কিছু পাঠ করতেন। তারপর আমাকে বলতেন এটা পান করো এবং এটা দ্বারা হাত-মুখ ধৌত কর। (আল-আদাব আশ-শারইয়্যাহ্, ইবনে মুফলিহ্)
ইউসুফ ইবনে মুসা রঃ বর্ণনা করেছেন,
মসজিদে আবু আব্দিল্লাহ্ (ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল) এর নিকট পানির পাত্র আনা হতো আর নিতি তাতে দোয়া পড়ে দিতেন।
এসব ঘটনা ইবনে মুফলিহ্ রঃ তার গ্রন্থ আল-আদাব আশ-শারই্যাতে বর্ণনা করেছেন।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রঃ বলেন,
রোগাগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য কুরআনের কিছু অংশ পবিত্র কালি দ্বারা লিখে তা ধৌত করে তাকে খাওয়ানো বৈধ। ইমাম আহমদ ও অন্যান্য ওলামায়ে কিরাম এ বিষয়ে স্পষ্ট অভিমত দিয়েছেন। (মাজমুয়ায়ে ফাতাওয়া)
ইবনে কায়্যিম রঃ নিজে শারীরিক সমস্যার কারণে সূরা ফাতিহা পাঠ করে পানিতে ফুঁ দিয়ে তা পান করতেন। তিনি বলেন, আমি এক বাটি জমজম কুপের পানি নিয়ে তাতে কয়েকবার সূরা ফাতিহা পাঠ করে তা পান করতাম। এতে আমি এত উপকার পেয়েছি যে অন্য কোন ঔষধে তা পায় নি। (মাদারিজুস সালিকীন)
মোট কথা দোয়া-কালাম পাঠ করা পানি গায়ে মাখা বা পান করাতে কোনো দোষ নেই। যদি সেটা আল্লাহর কিতাব বা তার গুনাবলী সম্বলিত দোয়া-কালামের মাধ্যমে হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ওলামায়ে কিরামের এটাই মত। তবে লক্ষ্য রাখা উচিৎ যাতে শরীরের আপত্তিকর স্থানে এ পানি না পৌছায়।
কুরআনের আয়াত বা দোয়া লেখা কাগজ তাবিজে ভরে তা গলায় বা হতে লটকানো।
এই বিষয়ে সাহাবায়ে কিরামের যুগ থেকেই মতপার্থক্য চলে আসছে। রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,
“ঝাড়-ফুঁক, জাদু-টোনা ও তামীজ-তুমার শিরক” (আবু দাউদ)
অন্য হাদীসে এসেছে, রসুলুল্লাহ্ সাঃ বলেছেন, “যে কেউ মাদুলি ঝুলায় সে শিরক করে” (ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেছেন। আল-হাইছামী বলেন, “ইমাম আহমাদ এর বর্ণনার রাবীরা বিশ্বস্ত”
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
যে কেউ মাদুলি ঝুলায় আল্লাহ যেনো তার উদ্দেশ্য সফল না করেন। ( হাকিম তার মুস্তাদরাকে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন বুখারী মুসলিমের শর্তে সহীহ। আজ-জাওহাবীও হাদীসটিকে সহীহ্ বলেছেন)
হাদীসটি আবু দাউদ ও তিরমিযী বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী বলেছেন, হাসান গরীব।
হযরত আয়েশা রাঃ থেকে সহীহ্ সনদে বর্ণিত আছে,
যেটা রোগাক্রান্ত হওয়ার পর ঝুলানো হয় সেটা নিষিদ্ধ মাদুলি নয় বরং নিষিদ্ধ মাদুলী হলো তাই যা রোগাক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই ঝুলানো হয়। (মুস্তাদরাকে হাকিম, ইমাম আজ-জাহাবী সহীহ বলেছেন)
ইমাম কুরতুবী ইমাম মালিক ও অন্যান্য কিছু সংখ্যক আলেম থেকে অনুরুপ মত উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, তাদের মতে সুস্থ অবস্থায় মানুষের দৃষ্টির ক্ষতি হতে বাঁচার জন্য তাবীজ ঝুলানো যাবে না। তবে সমস্যায় পতিত হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা এর নাম বা তার কিতাবের কিছু অংশ রোগমুক্তির আশায় ঝুলালে হাদীসে বর্ণিত দোয়ার মাধ্যমে দৃষ্টি লাগা বা অন্য যে কোনো রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঝাড়-ফুঁক করার বিধানের মতো এটা বৈধ। (তাফসীরে কুরতুবী)
যারা দৃষ্টি লাগাতে পারে এ ভয়ে কুরআনের তাবীজ ব্যবহার করেছেন এর কারণ সম্ভবত এই যে, মানুষের দৃষ্টি পতিত হয় সুন্দর জিনিসের তাই দৃষ্টিকে প্রতিরোধ করার জন্য অসুন্দর বস্তু ব্যবহার করা হয়। যেমন ক্ষেত-খামারে ভাঙ্গা হাড়ি বা গরুর মাথার খুলি ব্যবহার করা হয়। এ স্থলে কুরআনের তাবিজ ব্যবহার করা বেমানান হয়। এর উত্তরে বলা যায় ভাঙ্গা-হাড়ি বা গরুর খুলি যখন ব্যবহার করা হয় তখন সেগুলোর অসৌন্দর্যের কারণেই এটা করা হয় কিন্তু এক্ষেত্রে কুরআনের আয়াত যখন ব্যবহার করা হয় তখন এমন উদ্দেশ্য থাকে না বরং আল্লাহর কিতাবের বরকতে মানুষের দৃষ্টি কোনো ক্ষতি করতে পারবে না এমনটাই মনে করা হয়। যেমন রসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
আমি আল্লাহর বাণীর মাধ্যমে আশ্রয় চাচ্ছি প্রতিটি বিষাক্ত প্রাণী হতে এবং ক্ষতিকর দৃষ্টি হতে। (সহীহ বুখারী)
অনেকে মনে করেছেন যেহেতু কেবল রোগে আক্রান্ত হলেই ঔষধ সেবন করা হয় তার পূর্বে নয় তাই তাবীজ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম অনুসরণ করা উচিৎ অর্থাৎ রোগাক্রান্ত হওয়ার পূর্বে তাবীজ ব্যবহার না করা উচিৎ। কিন্তু এটা জানা কথা যে, আল্লাহর কালামের বরকতে যেমন রোগ মুক্তি ঘটতে পারে একইভাবে রোগে আক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই তা প্রতিহত হতে পারে।
এসকল কারণে বেশিরভাগ ওলামায়ে কিরাম রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগে বা পরে দৃষ্টি লাগার কারণে বা অন্য কোন কারণে কুরআনের আয়াত লেখা তাবীজের ব্যবহারে দোষ মনে করেন নি।
ইবনে বাত্তাল রঃ বলেন,
দোয়া-কালাম লিখিত তাবিজ ঝুলানো বা আল্লাহর কিতাব দ্বারা ঝাড়-ফুঁক করা সকল ওলামায়ে কিরামের মতেই বৈধ কেননা এটা মূলত আল্লাহর নাম দ্বারা আশ্রয় গ্রহণ করা। (শারহে বুখারী)
মালেকী মাযহাবের ফিকাহ্ গ্রন্থ মুখতাসারে খলীল এ বলা হয়েছে, “এমনকি হায়েজগ্রস্থ মহিলাও কোনো কিছুর ভিতরে আটকিয়ে (কুরআনের) তাবীজ ব্যবহার করতে পারবে।” এর ব্যাখ্যায় আল-খারাশী রঃ বলেন,
এ ধরণের তাবীজ যে কোন নাবালেগ বা প্রাপ্ত বয়স্ক, মুসলিম বা কাফির, সুস্থ বা অসুস্থ, গর্ভবতী, হায়েজগ্রস্থ বা নিফাসে আক্রান্ত মহিলা বা জুনুবী ব্যক্তির শরীরে লটকানো যাবে। একইভাবে চতুষ্পদ জন্তুর উপর দৃষ্টি পতিত হলে বা হওয়ার আশঙ্কা থাকলে তাদের শরীরে এটা লটকানো যাবে যদি এটা কোনো কিছুর অভ্যন্তরে আটকানো থাকে ফলে কোনোভাবে এটার অবমাননা না হয়।
মালেকী মাযহাবের আরেকজন ফকীহ্ আল-কয়রাওয়ানী রঃ বলেন,
কুরআন লেখা তাবীজ ঝুলাতে দোষ নেই। (রিসালাতুল কয়রাওয়ানী)
আবুল হাসান আল মালেকী রঃ এই অংশের ব্যাখ্যায় বলেন,
তাবীজ ঝুলানোতে কোনো সমস্যা নেই। আর তা হলো কোনো কিছুর মধ্যে কুরআনের আয়াত প্রবেশ করিয়ে তা গলায় ঝুলানো। সুস্থ, অসুস্থ, জুনুবী, হায়েজগ্রস্থ, নিফাস গ্রস্থ ইত্যাদি সকলের ক্ষেত্রে এটা ব্যবহার করা বৈধ। জন্তুর ক্ষেত্রেও এটা ব্যবহার করা যাবে। (কিফাইয়াতুত্ ত্বলিব)
হানাফী ফকীহ্ ইবনে আবেদীন রঃ বলেন,
আমি মুজতাবাতে যা দেখেছি তা হলো, অপচ্ছনীয় মাদুলী হচ্ছে কুরআনের তাবীজ ছাড়া অন্য কোনো তাবীজ। (হাশিয়াতু রদ্দিল মুহতার)
শাফেঈ মাযহাবের প্রশিদ্ধ ফিকাহ্ গ্রন্থ আল-মাজমু তে ইমাম আন-নাব্বী রঃ বলেন,
বাইহাক্বী সহীহ্ সনদের সাঈদ ইবনে মুসায়্যাব থেকে বর্ণনা করেন, তিনি তাবীজ হিসেবে কুরআনের আয়াত ঝুলাতে আদেশ করতেন। তিনি বলেছেন এতে কোন সমস্যা নেই। বাইহাক্বী বলেন, পূর্বে ঝাড়-ফুঁক সম্পর্কে আমরা যা বলেছি এ বিষয়ে সে কথাই প্রযোজ্য। অর্থাৎ যদি যে অবোধগম্য ভাষা ব্যবহার করে বা জাহেলী যুগের লোকদের মতো সরাসরি ঝাড়-ফুঁকেই আরোগ্য হয় এমন মনে করে তবে এটা বৈধ হবে না। আর যদি ঝাড়-ফুঁক করা হয় আর রোগ মুক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকেই হবে এমন মনে করা হয় তবে তাতে কোনো সমস্যা নেই। আর আল্লাহই ভাল জানেন।
ইবনে হাযার আল-হাইতামী রঃ তুহফাতুল মুহতাজে বলেন,
পড়ার উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে কুরআনের আয়াত লেখা হলে তা ওযু ছাড়া স্পর্শ বা বহন করা নিষিদ্ধ নয়। যেমন তাবীজ-আর তা হলো, একটি কাগজে কুরআনের কিছু অংশ লিখে তা বরকতের উদ্দেশ্যে মাথা বা অন্য কোন স্থানে ঝুলানো-অথবা কুরআনের আয়াত লেখা কাপড় বা দিরহাম। আর কুরআনের কিছু অংশ লিখে তা ঝুলানো অপছন্দনীয়। তবে যদি তাবীজের মুখে মোম বা অন্য কিছু দিয়ে আটকিয়ে দেয় তাহলে সমস্যা নেই।
ইবনে হাযার আল-আসক্বলানী রঃ বলেন,
যেসব তাবীজের মধ্যে আল্লাহর যিকির থাকে তা নিষিদ্ধ নয়। কেননা এটা ঝুলানো হয় তাবাররুকের উদ্দেশ্যে এবং আল্লাহর নাম ও তার যিকিরের মাধ্যমে আশ্রয় প্রার্থনা করার উদ্দেশ্যে। একইভাবে কেবলমাত্র সাজ-সজ্জার উদ্দেশ্যে এসব ঝুলানো হলে তাতেও সমস্যা নেই যদি না এর মাধ্যমে অহংকার ও অপচয় করা হয়। (ফাতহুল বারী)
হাম্বালী মাযহাবের ফকীহ্ ইবনে মুফলিহ রঃ উল্লেখ করেন,
মাদুলি ঝুলানো অপছন্দনীয় তবে কুরআন বা অন্য কিছু লেখে ঝুলানো বৈধ। (ইমাম আহমাদ) এ বিষয়ে স্পষ্ট অভিমত দিয়েছেন। (আল-ফুরু)
ইবনুল কায়্যিম রঃ তার শায়েখ ইমাম ইবনে তাইমিয়া থেকে বর্ণনা করেন,
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রঃ তার কপালে এই আয়াত লিখতেন, “বলা হলো হে মাটি তুমি তোমার পানি শুষে নাও এবং হে আকাশ তুমি বৃষ্টি বর্ষন বন্ধ করো। তখন পানি কমে গেল এবং সব কিছু শেষ হয়ে গেল” (সুরা হুদ-৪৪)। আমি তাকে বলতে শুনেছি আমি এটা বহু লোককে লিখে দিয়েছি ফলে তাদের রোগ মুক্তি হয়েছে। (আত-তিব্ব আন-নাব্বী)
উপরোক্ত উদ্ধৃতির আলোকে এটা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, দোয়া-কালাম লিখিত তাবীজ ঝুলানো দোষের কিছু নয়। যে সকল হাদীসের মাধ্যমে সকলপ্রকার তাবীজকে নিষিদ্ধ প্রমাণিত করার চেষ্ট করা হয় সেগুলোর মাধ্যমে কুরআনের তাবীজ উদ্দেশ্য নয় বরং ঐ সকল তাবীজ উদ্দেশ্য যাতে শিরকী কালাম রয়েছে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে বিষয়টি প্রমাণ করা যায়। যেমন,
ক. রসুলুল্লাহ্ যে সময় এবং যাদের উদ্দেশ্যে উপোরক্ত নিষেধাজ্ঞাগুলো বর্ণনা করেছেন তখন কুরআনের তাবীজের প্রচলন ছিল না বরং জাহিলী ধ্যান ধারনার বশবর্তী হয়ে কিছু পুতি বা কড়ির মাঝে ছিদ্র করে তাতে সুতা ভরে তা গলায় পরিধান করা হতো বা কুফরী কালাম গলায় ঝুলানো হতো এবং উক্ত বস্তুসমূহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোগ প্রতিরোধ করে এমন করা হতো। আরবী অভিধানসমূহতে হাদীসে ব্যবহৃত ‘তামীমা’ শদ্বের এই ব্যাখ্যায় দেওয়া হয়েছে।
লিসানুল আরবে বলা হয়েছে,
আল-মাতরাজী রঃ বলেন,
কেউ কেউ মনে করে হাদীসে তামিমা বলতে তাবীজকেই বোঝানো হয়েছে, এটা সঠিক নয়। বরং নিষিদ্ধ তামিমা হলো পুতি বা কড়ি। কুরআন বা আল্লাহর গুনাবলী সম্বলিত তাবীজে দোষের কিছু নেই। (আল-মাগরিব)
ইবনে আছীর রঃ বলেন,
তামাইম হলো তামিমা শব্দের বহু বচন আর এগুলো হলো পুতি যা আরবরা তাদের সন্তানদের শরীরে ঝুলিয়ে দিতো। তাদের বিশ্বাস ছিল এর মাধ্যমে দৃষ্টির ক্ষতি থেকে বাঁচা যাবে। পরে ইসলাম এটাকে নিষিদ্ধ সাব্যস্ত করে। (আন-নিহায়া)
এর পর তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, “যে কেউ তামিম ঝুলায় আল্লাহ যেনো তার উদ্দেশ্যকে তামিম (পূর্ণ) না করেন। এথেকে এমন মনে হয় যে, তারা তামীমার মাধ্যমে পরিপূর্ণ আরোগ্য হয় বলে মনে করতো। এটাকে শিরক বলা হয়েছে কারণ তারা এগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর তাকদীরকে রদ করতে ছেয়েছিল এবং গয়রুল্লাহর নিকট বিপদ আপদ থেকে রক্ষা প্রার্থনা করেছিল। (আন-নিহায়া)
সুতরাং এই সকল হাদীস জহেলী ধ্যান ধারনা বশত কুফরী কালাম বা আল্লাহর সাথে সম্পর্কহীন কিছু পাথর, পতি ও অন্যান্য ধাতব পদার্থকে রোগ আরোগ্য করার স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী মনে করে যা কিছু ঝুলানো হয় সেগুলো উদ্দেশ্য করা হয়েছে। আল্লাহর নাম ও তার কালাম লেখা তাজীজের উপর এই বিধান প্রয়োগ করা মোটেও সুবিবেচনা হতে পারে না।
খ. হাদীসে তাবীজ-তুমারের মতো ঝাড়-ফুঁককেও শিরক বলা হয়েছে। অন্যান্য হাদীসে আবার আল্লাহর কালাম দ্বারা ঝাড়-ফুঁক করা বৈধ বলা হয়েছে। উভয় বর্ণনার মাঝে সমন্বয় সাধন করে ওলামায়ে কিরাম মত দিয়েছেন যেখানে ঝাড়-ফুঁককেও শিরক বলা হয়েছে। অন্যান্য হাদীসে আবার আল্লাহর কালাম দ্বারা ঝাড়-ফুঁক করা বৈধ বলা হয়েছে। উভয় বর্ণনার মাঝে সমন্বয় সাধন করে ওলামায়ে কিরাম মত দিয়েছেন যেখানে ঝাড়-ফুঁককে শিরক বলা হয়েছে সেখানে জাহেলী যুগের শিরকী ঝাড়-ফুঁক উদ্দেশ্য দোয়া কালামের মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক করা নয়। একই কথা তাবীজ-তুমারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ যে হাদীসে তাবীজকে শিরক বলা হয়েছে সেখানে জাহেলী যুগের তাবীজ উদ্দেশ্য। দোয়া কালাম লিখিত তাবীজ নয়। যেহেতু শিরক হলো গয়রুল্লাহর প্রতি স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে ভরসা করা আর আল্লাহর নাম বা তার কালাম লেখা তাবীজ মূলত তারই প্রতি নির্ভর করা, ভিন্ন কিছু নয়। তাই এটাকে কিছুতেই শিরক বলা যেতে পারে না।
ইমাম কুরতুবী রঃ হাদীসটিতে কুরআনের তাবীজ উদ্দেশ্য নয় এটা বলার পর বলেন, “কেননা কুরআনের মাধ্যমে রোগ মুক্তি লাভ করার চেষ্টা করা শিরক হতে পারে না তা ঝুলিয়ে হোক বা অন্যভাবে হোক। (তাফসীরে কুরতুবী)
এরপর তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, “একজন ব্যক্তি যা ঝুলায় তার দায়-দায়িত্ব তার উপরই ছেড়ে দেওয়া হয়” (তিরমিযি) হাদীসটির সনদে আবু লাইলা নামক যে রাবী রয়েছে মুহাদ্দসীনে কিরাম তাকে সমালোচনা করেছেন।
অতএব যে ব্যক্তি কুরআনের তাবীজ ঝুলায় আল্লাহ তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কেননা কুরআনের মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করার চেষ্টা করা হলে তাতে মূলত আল্লাহর উপরই ভরসা করা হয় এবং তার নিকটই প্রার্থনা করা হয়। (তাফসীরে কুরতুবী)
মোট কথা, জাহেলী যুগের ঝাড়-ফুঁকের মতোই তাদের তাবীজ-তুমারও নিষিদ্ধ কিন্তু দোয়া কালাম পাঠ করে ঝাড়-ফুঁক করার মতোই দোয়া কালাম লেখা তাবীজ পরিধান করা বৈধ। দোয়া কালাম লেখা তাবীজ কখনও জাহেলী যুগের কুফরী কালাম লেখা তাবীজের মতো হতে পারে না।
আমরা এ মতই পোষণ করি। যারা এটা মেনে নিতে প্রস্তুত নন তাদের বলব, কমপক্ষে এতটুকু তো স্বরণ রাখতে হবে যে, এ বিষয়ে ওলামায়ে কিরামের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে ফলে এর উপর ভিত্তি করে কঠোরতা করা উচিৎ নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় কেউ কেউ তাওহীদ সম্পর্কে আলোচনা শুরু করলে কেবল এই সব ইখতিলাফী মাসয়ালাই আলোচনা করেন। যেন মনে হয় তাবাররুক, তাওয়অসসুল, কবর জিয়ারত, তাবীজ ইত্যাদি ছাড়া তওহীদ পরিপূর্ণ হয় না। তারা এ বিষয়ে ব্যাপক কঠোরতা করে থাকে এবং এর উপর ভিত্তি করে মানুষকে অপমান অপদস্ত করা এমনকি আক্রমণ পর্য্ন্ত করে বসে। তারা এ কঠোরতার ব্যাপারে যুক্তি প্রদর্শন করে বলে,
“যদি আমরা কুরআনের তাবীজের অনুমতি দিই তবে অন্যান্য নিষিদ্ধ তাবীজের জন্য পথ খুলে দেওয়া হবে এবং শিরক কুফরের উদ্ভব ঘটবে। তাই এ পথ বন্ধ করার জন্য কুরআনের তাবীজও নিষিদ্ধ বলা উচিৎ।”
এ বিষয়ে আমাদের কথা হলো, পূর্ববর্তী ওলামায়ে কিরাম এ ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। কিসের মাধ্যমে কোন জিনিসের পথ খুলে যায় তা তারা বিলক্ষণ জানতেন। তাই সে পথ বন্ধ করে দিয়ে বাকি পথ গুলো খুলে দিয়েছেন। আর যারা কোনটা কিসের পথ সে সম্পর্কে কিছুই জানে না তারা সকল পথ বন্ধ করে মানুষের জীবন যাত্রা অতিষ্ট করে তোলার চেষ্ট করেন। নিষিদ্ধ তাবীজ হলো তাই যার মধ্যে শিরকী কালাম লিখিত আছে।
আমরা উপরে দেখেছি যে, ওলামায়ে কিরাম দোয়া-কালাম লিখিত তাবীজ বৈধ বলেছেন এবং শিরকী তাবীজ নিষিদ্ধ বলেছেন। একইসাথে শিরক-কুফর থাকতে পারে এই আশঙ্কায় তারা দোয়া কালাম ছাড়াই শুধুমাত্র কিছু পাথর ও অন্যান্য ধাতব পদার্থ শরীরে ঝুলানো নিষিদ্ধ বলেছেন। এসবই তারা করেছেন শিরকী তাবীজ-তুমারের পথ বন্ধ করার জন্য। একইভাবে তারা শিরকী কালামের মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক হতে পারে এ আশঙ্কায় অবোধগম্য ভাষায় ঝাড়-ফুঁক করা নিষিদ্ধ বলেছেন। সেই সাথে এও শর্ত করেছেন যে, রোগের শিফা আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে ঝাড়-ফুঁক বা তাবীজ-তুমার থেকে নয় এটা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতে হবে। তারা ঝাড়-ফুঁক ও তাবীজের ক্ষেত্রে একই পন্থা অবলম্বন করেছেন এবং একই শর্ত আরোপ করেছেন। যদি এসব শর্তের আলোকে দোয়া-কালাম পাঠ করে ঝাড়-ফুঁক করা শিরকের পথ খুলে না দেয় তবে ঐ একই শর্তের অধীনে তাবীজ ঝুলানোর বৈধতা স্বীকার করলে শিরক-কুফরের পথ খুলে দেওয়া হয় কিভাবে!
এখানে আরো একটি বিষয় স্বরণ রাখতে হবে। আর তা হলো, “শিরক কুফরের পথ” বলতে কেবল সেই সব বিষয়কে বোঝাবে যা থেকে নিশ্চিতভাবে বা কমপক্ষে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিরকের উদ্ভব ঘটে। তা না হলে যে কোন বিষয়কেই শিরকের পথ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। উদাহরণস্বরুপ একশ্রেণীর নাস্তিক আছে যারা মনে করে ডাক্তারের চিকিৎসাই রোগীকে আরোগ্য করে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নয়। এর অর্থ এই নয় যে গোটা চিকিৎসা বিজ্ঞানকে “শিরক-কুফরের পথ” হিসেবে আখ্যায়িত করে পরিত্যাগ করতে হবে। বর্তমান সমাজে গুটিকয়েক লোকের মাঝে তাবীজ-তুমার বা ঝাড়-ফুক সম্পর্কে শিরকী আক্বীদা বিশ্বাস রয়েছে এতটুকুর উপর নির্ভর করে সামগ্রিকভাবে এগুলোকে শিরকের পথ হিসেবে আখ্যায়িত করে পরিত্যাগ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
তারা বলে, শিরক কুফরের পথ বন্ধ করার জন্য আমরা তাজীজের ব্যাপারে কঠোরতা করে থাকি। কিন্তু তারা এটা লক্ষ্য করে না যে, এ পথ বন্ধ করতে যেয়ে সীমালঙ্ঘন করার কারণে তারা বহু সংখ্যক অনিষ্টের পথ খুলে দিয়েছে। যেমন,
তাবীজের মতো একটি মতপার্থক্যপূর্ণ বিষয়ের উপর নির্ভর করে সাধারন মুসলিমদের বিদায়াতী বা ক্ষেত্র বিশেষে মুশরিক হিসেবে আখ্যায়িত করে মুসলিমদের মাঝে বিতর্ক ও বিভেদ সৃষ্টি করা।
শায়েখ আব্দুল্লাহ্ আজ্জাম সূরা তাওবার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সৌদি আরবের বিভিন্ন যুবকের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। যারা আফগানিস্থানে জিহাদ করা ও সেখানে সম্পদ ব্যয় করার জন্য আগমন করেছিল কিন্তু আফগান মুজাহিদদের হাতে তাবীজ ঝুলতে দেখে তারা বলে, “এরা তো মুশরিক এদের তোমরা যাকাত দিয়ো না” তারা তাদের সাথে থেকে যুদ্ধ করতেও অস্বীকার করে। তারা বলে, এটা মুশরিকদের পক্ষ নিয়ে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা।
এছাড়া এদের কেউ যখন শোনে বহু সংখ্যক পূর্ববর্তী বরেণ্য ওলামায়ে কিরাম তাবীজ বৈধ বলেছেন এরা তাদের নিন্দা করে। সৌদি আরবের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন সালিহ্ আল-ফাওজান ইমাম শাওকানীর তাওহীদ সম্পর্কিত রিসালাটির দারস শুরু করলে কিছু যুবক বলে, শিরক কুফরের দিকে যারা আহ্বান করে তাদের বইয়ের দারস আমরা শুনবো না।
শায়েখ আব্দুল্লাহ আজ্জাম তার তাফসীরে উল্লেখ করেন, সৌদি আরবে একবার ইমাম নাব্বীর শারহে মুসলিম বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। পরবর্তীতে কিছু লোক সেটা ফেরত দিতে আসে। তারা বলে এই ব্যক্তির আক্বীদা খারাপ।
এরা ইখতিলাফী বিষয়াবলীতে নিজেদের মতামত ছাড়া অন্য কারো মতকে সম্মান প্রদর্শন করেনা। নিজেদের মতের বিপক্ষে কারো মত পেলেই তাকে বিদয়াতী, ফাসেক বা কাফির পর্য্ন্ত আখ্যায়িত করে বসে। সে যেই হোক না কেন।
অথচ রসূলুল্লাহ সাঃ থেকে স্পষ্ট সুন্নত বিদ্যামান রয়েছে যে, কোনো ব্যাপারে দ্বিমত সৃষ্টি হলে সে বিষয়ে কাউকে তিরস্কার না করা। ইমাম বুখারী বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ সাঃ খন্দকের যুদ্ধের পর তার সাহাবাদের উদ্দেশ্যে বলেন,
তোমাদের মধ্যে কেউ যেন বনু কুরাইজায় না গিয়ে আসরের সলাত আদায় না করে। কিন্তু পথের মধ্যে আসরের সলাত ফওত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হলে সাহাবায়ে কিরাম দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে একদল বলেন, রসূলুল্লাহ সাঃ যা বলেছেন আমরা তাই করবো। আমরা বনু কুরাইজায় গিয়েই সলাত আদায় করবো। ফলে তারা সূর্য্ ডুবে যাওয়ার পর বনু কুরাইজায় পৌছে সলাত আদায় করেন। অন্য একদল বলেন, রসুলুল্লাহ সাঃ এর উদ্দেশ্য এমন নয় বরং উদ্দেশ্য হলো দ্রুত যাওয়া যাতে আসরের সময় শেষ হওয়ার পূর্বেই বনু কুরাইজায় পৌছে যেতে পারো। ফলে তারা রাস্তার মধ্যেই আসরের সালাত আদায় করে নেন। হাদীসের শেষে বলা হয়েছে,
পরে রসুলূল্লাহ সাঃ কে একথা বলা হলে তিনি কাউকে তিরস্কার করেন নি। (সহীহ্ বুখারী)
একারণে সকল মাযহাবের ওলামায়ে কিরাম মতপার্থক্যপূর্ণ বিষয়াবলীতে একে অপরকে তিরস্কার করা অবৈধ বলেছেন। ইমাম নাব্বী রঃ বলেন,
আলেমরাও কেবলমাত্র যেসব বিষয়ে ইজমা হয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে মানুষকে নিষেধ করবে কিন্তু যেসব বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে সেসব বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা চলে না। (শারহে মুসলিম)
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রঃ বলেন,
একজন ফকীহর উচিৎ নয় সকলকে তার মত মানতে বাধ্য করা। (মাজমুয়ায়ে ফাতাওয়া)
মতপার্থক্যপূর্ণ বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে এই স্পষ্ট নির্দেশনা বিদ্যামান থাকা সত্ত্বেও বর্তমান যুগে কাউকে কাউকে দেখা যায় এই সীমানা লঙ্ঘন করে এসব বিষয়ে কড়াকড়ি করে থাকেন। আর গর্বভরে দাবী করেন আমরা শিরক-কুফরের রাস্তা বন্ধ করছি। এদের উদ্দেশ্যে আমাদের কথা হলো, শিরক কুফরের রাস্তা কোনগুলো আগে সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। খেয়ালখুশি মতো যে কোন বিষয়কে শিরক-কুফরের রাস্তা হিসেবে আখ্যায়িত করে তা বন্ধ করার চেষ্টা করলে আরো বেশি অনিষ্টের দরজা খুলে যেতে পারে তা স্বরণ রাখতে হবে। কেবল শিরক-কুফরের রাস্তা বন্ধ করার চিন্তায় চৈতন্য হারালে হবে না। যে বিষয় শিরক-কুফর নয় সেটার ব্যাপারে বাড়াবাড়িও যে এক প্রকার বিদয়াত সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। একইভাবে মুসলিমদের কাফির বলাও যে হাদীসের ভাষায় একপ্রকার কুফরী সেটাও স্বরণ রাখতে হবে।
অনেকে বলেন, কুরআনের আয়াত লিখিত তাবীজ ঝুলানো হলে কখনও কখনও কুরআনের অবমাননা হয়ে যেতে পারে যেমন স্ত্রী সহবাসের সময় বা প্রসাব-পায়খানার সময় তা সাথে রাখা। এ বিষয়ে কথা হলো, ওলামায়ে কিরাম বিষয়টির সমাধান দিয়েছেন। পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি, ওলামায়ে কিরাম বলেছেন, কুরআনের আয়াত লিখে সেটি তাবীজে ভরে তাবিজের মুখ মোম বা অন্য কিছু দ্বারা ভালভাবে আটকে দিতে হবে। এভাবে আবদ্ধ করার পর সেটা পরিধান করে প্রসাব-পায়খানায় প্রবেশ করতে বা স্ত্রী সহবাস করাতে তারা দোষ মনে করেন নি। যেভাবে হাফিজের অন্তরে কুরআন সংরক্ষিত থাকে তবু সে পায়খানায় প্রবেশ করতে পারে এবং স্ত্রী সহবাস করতে পারে। একইভাবে বর্তমানে মোবাইলের মেমোরীতে লিখিত বা অডিও কুরআন ভরে রাখা হয়। কিন্তু তাতে মোবাইল সাথে করে পায়খানায় প্রবেশ করা নিষিদ্ধ হয় না।
তাবিজ তুমারের বিধান প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।
তাবিজ তুমারের বিধান প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে আপনার মতামত জানান।