ইসলামে মানবতাবাদের বিধান – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর

ইসলামে মানবতাবাদের বিধান – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর এর তাওহীদ বই হতে সংকলিত প্রবন্ধটি পড়ুন এবং শেয়ার করুন

মানবতাবাদ এমন একটি স্লোগান, সাধারনভাবে যে কোনো মানুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়। খেটে খাওয়া ও খুটে খাওয়া মানুষের প্রতি মায়া-মমতা প্রদর্শন, শোকাহত ও ব্যাথিত মানুষের পাশে দাড়ানো, অভূক্ত বা অর্ধভূক্ত মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়া, সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণে মনে প্রাণে কাজ করে যাওয়া ইত্যাদি সুন্দর-সুন্দর স্লোগানের খোলসে মানবতাবাদ প্রচার করা হয়। এই সকল মধুর বাণীর আড়ালে কি শিরক-কুফর লুকিয়ে আছে তা অনুধাবনে ব্যার্থ হওয়ার কারণে সাধারন মানুষ বিষেশত যুবকরা এই মতবাদে প্রভাবিত হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমান সময়ের মানবতাবাদ মানুষকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করা বা কমপক্ষে মানুষের ধর্মীয় পরিচয়ের তুলনায় মানুষ পরিচয়কে অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি উপস্থাপন করে। আক্বীদা-বিশ্বাস, আমল-আখলাক ইত্যাদি ধর্মীয় মূলনীতিকে বিসর্জন দিয়ে কেবলমাত্র মানুষ হিসেবে প্রতিটি ধর্মের লোককে নিজের ভাই হিসেবে মনে করা এবং সকল ধর্মের মানুষকে সমান দৃষ্টিতে বিচার করার নামই হলো মানবতাবাদ। তাছাড়া ধর্মকে শুধুমাত্র মানুষের দুনিয়াবী কল্যাণে ব্যাবহার করা এবং ধর্মের যেসব বিধি-বিধানে মানুষের উপর কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে বা মানুষের স্বাধীনতা হরন করা হয়েছে সেগুলো বর্জন করা এবং ধর্মের যেসব নিয়ম-নীতি মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে হাসিমুখে সেসব বিধি-বিধান ও নিয়ম-নীতি পরিত্যাগ করার নামই মানবতাবাদ।

এই মূলনীতির আলোকে তারা ইসলামের দাসপ্রথা, পর্দা প্রথা, জেনা-ব্যাভিচারের শাস্তি, চোরের শাস্তি, তালাকের পদ্ধতি, উত্তরাধিকার আইন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে আপত্তি-অভিযোগ উত্থাপন করে থাকে। তাওহীদের প্রচার-প্রসার ও শিরক-কুফরের বিনাশের উদ্দেশ্যে জিহাদ করার বিষয়টিকেও তারা তীব্রভাবে নিন্দা জানায়। ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে মানুষকে মুমিন ও কাফির দুটি শ্রেনীতে বিভক্ত করাও মানবতার প্রতি অবমাননা হিসেবে গণ্য করা হয়।

মানবতাবাদ দ্ব্যার্থহীনভাবে ঘোষনা করে, “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।” অর্থাৎ ধর্ম বিশ্বাস ও কর্ম-কাজের উর্দ্ধে একজন মানুষের মানুষ পরিচয়ই প্রধান। মুসলিম, হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধ ইত্যাদি সকল ধর্মের লোকেরা এক ও অভিন্ন। তারা সকলেই মানুষ। “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই” এই কথাটির অর্থ এও যে, মানুষের উপর অন্য কোনো অতিপ্রাকৃতিক শক্তির ক্ষমতা বলবৎ নেই। আসমান থেকে কেউ কোনো বিধান অবতীর্ণ করবে আর মানুষ সেটা মেনে চলবে এটা হতে পারে না। এরা বলে, “মানুষ এনেছে কিতাব, কিতাব আনে নি মানুষ কোনো”। অর্থাৎ পবিত্র কুরআন বা অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ কোনো ঐশী শক্তির নিকট হতে আসে নি বরং মানুষ এগুলো তৈরী করেছে অতএব, এগুলো মানুষের তুলনায় বেশি মর্যাদার অধিকারী নয়। সুতরাং যে কোনো মূল্যে এসব গ্রন্থের বিধানাবলী মেনে চলতে হবে এমন নয়। এই অর্থে এরা এমনও বলে, “মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়।”

এই সকল মূলনীতির প্রতিটিই স্পষ্ট কুফরী হিসেবে গণ্য। যেহেতু ইসলাম আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ জীবন-বিধান। যিনি সকল মানুষের সৃষ্টিকর্তা, তাদের রিযিকদাতা এবং পালনকর্তা। সকল মানুষ তার গোলাম এবং তিনি তাদের অবিভাক। নিঃসন্দেহে চাকরের খেয়াল-খুশি ও স্বাধীনতার তুলনায় অবিভাবকের নির্দেশ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে চাকর অবিভাবকের নির্দেশ মানে না সে অবাধ্য বলে বিবেচিত হবে এবং শাস্তির যোগ্য হবে আর যে অবিভাবকের নির্দেশ মেনে চলে সে পুরস্কৃত হবে এটাই স্বাভাবিক। এই দুজন কখনও সমান হতে পারে না। মনিবের নির্দেশের বিরুদ্ধে অবাধ্য এবং বাধ্য উভয় চাকর যদি পরস্পরকে ভাই-ভাই মনে করে তবে উভয়ে যে চাকুরী হারাবে তাতে সন্দেহ নেই। সকল মানুষ আল্লাহর গোলাম। যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে এবং আল্লাহর দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করে তারা মুমিন ও মুসলিম আর যারা ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম বা কোনো কুফরী মতবাদ মেনে চলে তারা কাফির। মুসলিমের স্থান জান্নাত আর কাফিরের স্থান জাহান্নাম। মুসলিম আল্লাহর নিকট সম্মানিত আর কাফির আল্লাহর নিকট অপমানিত। মুসলিম এবং কাফির কখনও সমান হতে পারে না। যারা মুসলিম পরিচয়ের তুলনায় মানুষ পরিচয়কে প্রাধান্য দেয় এবং কাফির-মুশরিক সকলকে নিজের ভাই মনে করে আল্লাহর নিকট তারা ঐ সকল কাফির-মুশরিকদের মতোই কাফির হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, হে ঈমানদাররা তোমরা ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে কেউ তাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে সে তাদের মধ্যেই অন্তর্ভূক্ত হয়। (সুরা মায়েদা-৫১)

ইয়াহুদী খৃষ্টানদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা বলতে সাধারনভাবে তাদের সাথে কোনো সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা নয় বরং তাদের দ্বীনকে মেনে নেওয়া বা নিজের দ্বীনকে বিসর্জন দিয়ে তাদের সাথে সদ্ভাব গড়ে তোলাকে বোঝায়। এ বিষয়ে আমরা পূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। যারা নিজেদের মুসলিম পরিচয়ের তুলনায় মানুষ পরিচয়কে অধিক গুরুত্ব প্রদান করে তারা আল্লাহর দ্বীন পরিত্যাগ করে মানবতাবাদের ধর্ম গ্রহণ করার কারণে কাফিরে পরিনত হয়।

শান্তিপ্রতিষ্ঠা বা সহিষ্ণুতার নামে নিজের দ্বীন ঈমান বিসর্জন দিয়ে কাফিরদের সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, তাদের ধর্মকে স্বীকৃতি দেওয়া বা তাদের ধর্মীয় উৎসব ও রীতি-নীতিকে সম্মান প্রদর্শন করা ইত্যাদি বিষয়াবলী স্পষ্ট কুফরী হিসেবে গণ্য। একইভাবে মানবতা বা স্বাধীনতার কথা বলে, ইসলামের কিছু বিধি-বিধান যেমন, দাসপ্রথা, পর্দাপ্রথা, ইত্যাদি বিষয়কে অস্বীকার করাও কুফরী কর্মকান্ড হিসেবে গণ্য। এই ধারণের মানবতায় যারা বিশ্বাসী তারা নিজেরাই মানুষ নয় বরং জন্তু-জানোয়ার বা তদাপেক্ষা অধম।

ওরা চতুষ্পদ জন্তুর মতো বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট। (সুরা আরাফ-১৭৯)

কবিতার ভাষায়,

যে বলে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।

তাকে বলি, মানুষ কে কি তার পরিচয়?

যদি সদা বংশ গুনে হয় মানবতা,

তবে সাধু আর অসৎ জনে কি অসমতা?

আর যদি কর্ম মানো তবে নিশ্চিত জেনো ধর্ম তারে কয়।

বিশ্বাসে হয় মানুষের মাঝে বিভেদ নির্ণয়।

সটিক যার কর্ম হয় সঠিক বিশ্বাসে,

সার্থক জনম তার শেষ নিশ্বাসে।

অন্তর তার, দুখীর দুঃখে করে হাহাকার।

সেবক সেজন দিয়ে দেহ-মন সমগ্র মানবতার।

বিশ্বাস যার বাতিল অসার আল্লাহকে ডরে না মোটে।

মধুর যতই ছড়াক বুলি কর্মে নাহি তা খাটে।

দু-হাতে তার ঘটে বারবার মানুষের গঞ্জনা।

মানুষ যদি সে, অমানুষ কে? কোথাও পাবে না।

তাই, সত্য ধর্ম সবার উপরে, সবার পরিচয়।

ইসলাম সে, মুসলিম যে মানুষ সেই হয়।

ইসলামে মানবতাবাদের বিধান ইসলামে মানবতাবাদের বিধান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *