অজ্ঞতার ওযরের শর্ত বা তাওহীদ ও রেসালাত ছাড়া অন্যান্য বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে অজ্ঞতা ওযর হিসেবে গণ্য হওয়ার শর্তসমূহ

অজ্ঞতার ওযরের শর্ত বা তাওহীদ ও রেসালাত ছাড়া অন্যান্য বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে অজ্ঞতা ওযর হিসেবে গণ্য হওয়ার শর্তসমূহ শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর

ঈমান ভঙ্গের দ্বিতীয় মূলনীতি সম্পর্কে আলোচনাতে আমরা বলেছি, কুরআন-হাদীসে উল্লেখিত এবং উম্মতের ইজমার মাধ্যমে প্রমাণিত যে কোনো বিষয় অস্বীকার করার মাধ্যমে একজন মুসলিম কাফিরে পরিনত হয়। তবে তাওহীদ ও রেসালাত ছাড়া অন্যান্য বিধানাবলী অস্বীকার করার মাধ্যমে একজন মুসলিমকে কাফির বলার পূর্বে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। লক্ষ্য করতে হবে, উক্ত ব্যক্তি না-জানা বা না বুঝার কারণে ওযরপ্রপ্ত কি না। মোট কথা তাওহীদ ও রেসালাতের উপর বিশ্বাস স্থাপণকারী মুসলিমরা অন্য কোনো বিধি-বিধান অস্বীকার করলে বা অন্য কোনো কুফরীতে লিপ্ত হলে সেখানে অজ্ঞতা শক্ত ওযর হিসেবে গণ্য হয়। এক্ষেত্রে অজ্ঞতা দুরকম হতে পারে।

ক। কোনো একটি বিধান সম্পর্কে না জানা থাকা।

যেমন কেউ হয়তো জানে না যে, আল্লাহ্ পিতার সম্পত্তিতে ছেলেদের মেয়েদের তুলনায় দ্বিগুণ অংশ দিয়েছেন একারণে সে বিষয়টি অস্বীকার করে।

খ। কোনো একটি বিধান সম্পর্কে ভুল বুঝ থাকা। যেমন, কেউ হয়তো জানে যে, আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে ছেলেদের মেয়েদের তুলনায় দ্বিগুণ দিয়েছেন কিন্তু আধুনিকতার সাথে তাল মেলানোর জন্য আয়াতটিকে বিভিন্নরকম ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। সে হয়তো বলে, এখানে ছেলেদের দ্বিগুণ দেওয়া হয়েছে কারণ তখন ছেলেরা সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতো কিন্তু এখন যেহেতু ছেলে মেয়ে উভয়ে সমান দায়িত্ব পালন করে তাই উভয়কে সমান দেওয়া উচিৎ। অর্থাৎ সে আয়াতটিকে সরাসরি অস্বীকার করে না বরং ভুল ব্যাখ্যা করে। এই প্রকারের লোকদের বলা হয় আহলুত তা’বীল অর্থাৎ যারা না জানার কারণে নয় বরং সঠিক অর্থ বুঝতে না পারার কারণে কোনো বিধানের ভুল ব্যাখ্যা করে। এভাবে তারা সঠিক বিধানটি অস্বীকার করে।

এই উভয় প্রকারের অজ্ঞতাই ওযর হিসেবে গণ্য। তবে এগুলো ওযর হিসেবে গণ্য হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু নিয়মনীতি রয়েছে। বিষয়টি ব্যক্তি ও বিষয়ভেদে বিভিন্ন রকম হয়। ইসলামের বিধানাবলীর একটি অংশ সাধারন মুসলিমদের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রশিদ্ধ ও প্রচারিত। যেমন, সলাত, সওম, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ফরজ হওয়া এবং মদ, জিনা, সুদ, ঘুষ ইত্যাদি হারাম হওয়া। এই সকল বিষয় অস্বীকার করলে একজন ব্যক্তি কাফির হিসেবে গণ্য হবে। এ বিষয়ে যদি সে অজ্ঞতার দাবী করে তবে তা মেনে নেওয়া হবে না। অজ্ঞতার কারণে তাকে ছেড়েও দেওয়া হবে ন। এসব ব্যাপারে ভুল ব্যাখ্যা করলেও কেউ ছাড় পাবে না। তবে যদি এমন হয় যে, এই ব্যক্তি কিছু দিন পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছে বা মুসলিমদের সাথে মেলা-মেশা করার সুযোগ কম পেয়েছে ফলে এসব বিধান সম্পর্কে সে অজ্ঞ থাকতে পারে তাহলে তাকে ছাড় দেওয়া হবে। মোট কথা কেউ অজ্ঞতার দাবী করলেই তা মেনে নেওয়া হবে না বরং পারিপার্শ্বিকতার উপর চিন্তা-গবেষণা করে বিষয়টির সত্যতা যাচায় করে দেখতে হবে। ইমাম নাব্বী রঃ বলেন,

ইসলামের যে সকল বিষয়ে উম্মতের ইজমা সম্পাদিত হয়েছে এবং সেগুলোর ব্যাপারে যথেষ্ট প্রচার প্রসার রয়েছে ঐ সকল বিধি-বিধান যে অস্বীকার করে সে কাফির হবে। যেমন, পাঁচ ওয়াক্ত সলাত আদায় করা, রমজান মাসে রোজা রাখা, জানাবাত অবস্থায় গোসল ফরজ হওয়া, সুদ, মদ, নিকট আত্মীয় মহিলাদের বিবাহ করা হারাম হওয়া ইত্যাদি। তবে যদি উক্ত ব্যক্তি কিছু দিন পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করার কারণে ইসলামের বিধি-বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার ফলে এসব বিধি-বিধানের কিছু অংশ অস্বীকার করে তবে সে কাফির হবে না। (শারহে মুসলিম)

এরপর তিনি ঐ সকল বিষয় উল্লেখ করেছেন যেগুলোর ব্যাপারে উম্মতের ইজমা সম্পাদিত হয়েছে কিন্তু সেগুলোর প্রচার-প্রসার নেই। তিনি বলেন, কিন্তু যে বিষয়ে ইজমা রয়েছে তবে তা কেবল বিশিষ্ট আলেমরা জানেন যেমন, কোনো মহিলা এবং তার ফুফুকে বা খালাকে একত্রে বিবাহ করা হারাম হওয়া, পিতাকে হত্যাকারী সন্তান পিতার ওয়ারিশ না হওয়া, দাদি (মায়ের অনুপস্থিতিতে) নাতির সম্পতিতে এক ষষ্টমাংশ পায় ইত্যাদি বিধি-বিধান। যে কেউ এগুলো অস্বীকার করে তাকে অজ্ঞতার কারণে ওযর দেওয়া হবে যেহেতু সাধারন লোকদের মধ্যে এসব বিষয়ের যথেষ্ট প্রচার-প্রসার নেই। (শারহে মুসলিম)

হানাফী মাযহাবের ফকীহ্ ইবনে আবেদীন রঃ বলেন, সত্য কথা হলো যেসব বিষয়ে উম্মতের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেগুলো কখনও কখনও ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় যেমন, পাঁচ ওয়াক্ত সলাত। আবার কখনও তা হয় না। প্রথম প্রকারের বিধান যে অস্বীকার করে সে কাফির হয়। (রদ্দে মুহতার)

যে ব্যক্তি সলাত ফরজ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে তার সম্পর্কে হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফকীহ ইবনে কুদামা রঃ বলেন, যদি কেউ সলাত ফরজ এটা অস্বীকার করে তবে লক্ষ্য করতে হবে যে, ঐ ব্যক্তির জন্য এ বিষয়ে অজ্ঞ থাকা স্বাভাবিক কিনা। যেমন হয়তো কয়েকদিন পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছে, বা জ্ঞান-বিদ্যা বিবর্জিত গ্রাম্য এলাকাতে বসবাস করে। আর যদি এমন হয় যে, উক্ত ব্যক্তির নিকট বিষয়টি গোপন থাকার কথা নয় যেমন মুসলিমদের মাঝে বসবাস করে এমন ব্যক্তি তবে তাকে ওযর দেওয়া হবে না। কেননা সলাত ফরজ হওয়ার বিষয়টি কুরআন-হাদীসে স্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছে এবং মুসলিমরা সদা-সর্বদা সলাত আদায় করে থাকে অতএব, মুসলিমদের সাথে বসবাস করছে এমন একজন ব্যক্তি এ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতে পারে না। (আল-মুগনী)

মোট কথা, অজ্ঞতা কেবল ওযর হিসেবে গণ্য হবে যখন পারিপার্শ্বিক অবস্থা তার কথার স্বপক্ষে প্রমাণ বহন করে। কি ধরনের ব্যক্তি কোন ধরনের বিধান অস্বীকার করছে তার উপর নির্ভর করে উক্ত ব্যক্তি অজ্ঞতার কারণে ওযরপ্রাপ্ত কিনা।

বিঃদ্রঃ আলেমদের কেউ কেউ সাধারনভাবে অজ্ঞতাকে ওযর হিসেবে গণ্য না করার পক্ষে মত দিয়েছেন। মালেকী মাজহাবের ফকীহ্ কাজি ইয়াদ রঃ বলেন, “কুফরীর ক্ষেত্রে কাউকে অজ্ঞতার কারণে ছাড় দেওয়া হবে না।” (আশ-শিফা) মালেকী মাজহাবের ফিকাহ্ গ্রন্থ মুখতাসারে খলীল ও শারহে কাবীরে অনুরুপ কথা বলা হয়েছে। হানাফী মাজহাবের কোনো কোনো ফকীহ্ অনুরুপ বলেছেন। ফাতাওয়ায়ে কাদী খানে এ বিষয়ে হানাফী ওলামায়ে কিরাম দ্বিমত করেছেন বলে বর্ণিত আছে। মোল্লাহ আলী কারী আল-হানাফী বলেন, কেউ কেউ বলেছে, অজ্ঞতার কারণে ছাড় দেওয়া হবে অন্যেরা বলেছে অজ্ঞতার কারণে ছাড় দেওয়া হবে না। আমি মনে করি, প্রথম মতটিই অধিক সঠিক। তবে যদি এমন কোনো বিধান অস্বীকার করে যা অকাট্য ও সুস্পষ্টভাবে জানা গেছে তবে তাকে কাফির বলা হবে। এক্ষেত্রে অজ্ঞতার কারণে ছাড় দেওয়া হবে না। (শারহে শিফা)

যেসব বিধি-বিধানের উপর উম্মতের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সেগুলোর যথেষ্ট প্রচার-প্রসার রয়েছে এই সব বিধান সম্পর্কে কেউ অজ্ঞ থাকলে বা অজ্ঞতার দাবী করলে সেটা ওযর হিসেবে গণ্য হবে না এ বিষয়ে সকল আলেম একমত হয়েছেন। কিন্তু যেসব বিধান অকাট্যভাবে প্রমাণিত নয় বা সাধারন মুসলিমদের নিকট পরিচিত নয় সেগুলোর ব্যাপারে অজ্ঞতা ওযর হিসেবে গণ্য হওয়ার ব্যাপারে বেশিরভাগ আলেম মত দিয়েছেন। যারা অজ্ঞতার কারণে ছাড় দেওয়া হবে না বলেছেন তারাও সম্ভবত প্রথম প্রকারের বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে ছাড় না দেওয়ার কথা বলেছেন। যেহেতু তারা নিজেরাই বিদয়াতী ফিরকাহ্ সমূহকে কাফির মনে করেন নি এবং সাধারনভাবে মুসলিমদের তাকফীর করার ক্ষেত্রে অত্যাধিক সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব, তাদের কথাকে সাধারন মুসলিমদের ব্যাপকভাবে কাফির ঘোষণার স্বপক্ষে ব্যবহার করা সঠিক নয়। আর আল্লাহই ভাল জানেন।

অজ্ঞতার ওযরের শর্ত অজ্ঞতার ওযরের শর্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *