ইসলামে জাদুর বিধান – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মুনীর
ইসলামে জাদুর বিধান – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মুনীর ইসলামে জাদুর বিধান নিয়ে #শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মুনীর# এর গবেষণা মূলক প্রবন্ধটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ এজন্য প্রবন্ধটি পড়ুন এবং আপনার বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করুন
আল্লাহ তায়ালা বলেন, সুলাইমান তো কুফরী করেন নি বরং শয়তানরাই কুফরী করেছিল তারা মানুষকে জাদু শিক্ষা দিতো। (সুরা বাকারা-১০২)
একই আয়াতে হারুত ও মারুত দুজন ফেরেশতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা যে কাউকে তা (জাদু) শিক্ষা দেওয়ার পূর্বে বলতো আমরা তো পরীক্ষা মাত্র অতএব কুফরী করো না। কিন্তু তারা তাদের দুজনের নিকট হতে এমন কিছু শিক্ষা করতো যার মাধ্যমে তারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতো। তারা তো আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া ওগুলোর মাধ্যমে ক্ষতি করতে সক্ষম নয়। (সূরা বাকারা-১০২)
এই আয়াতের প্রকাশ্য অর্থ অনুসারে কেউ কেউ জাদুকে সাধারনভাবে কুফরী আখ্যায়িত করেছেন। বর্তমানে এ মতটি ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। যারা শিরক-কুফর ও তাওহীদ সম্পর্কে আলোচনা করেন তাদের বেশিরভাগই এই আয়াতটি উল্লেখ করে জাদুকে কুফরী প্রমাণের চেষ্টা করেন। অথচ এই আয়াত সাধারনভাবে সকল প্রকার জাদুকে কুফরী প্রমান করে না বরং শয়তানরা মানুষকে যে জাদু শিক্ষা দিতো এবং হারুত ও মারুত ফেরেশতাদ্বয় মানুষকে যা শেখাতো এই আয়াতে সেই সব বিষয়কে কুফরী বলা হয়েছে। পৃথিবীতে যত রকম জাদু দেখা যায় বা জাদু বলতে যা কিছু বোঝায় তার সব কিছু এই আয়াতে উদ্দেশ্য নয়। সকল প্রকার জাদুকে কুফরী বলা সম্ভবও নয়। যারা সকল প্রকার জাদুকে কুফরী বলার পক্ষে মত দেন তাদের নিকট প্রশ্ন হলো জাদু বলতে তারা কি বুঝবেন?
সাধারনভাবে জাদু বলতে আমরা বুঝি, তন্ত্র-মন্ত্র পাঠ করে বা কায়দা-কসরতের মাধ্যমে বিভিন্ন বিস্ময়কর ঘটনা প্রদর্শন করা।
আল-আজহারী রঃ বলেন, জাদু হলো, কোনো বিষয়কে তার প্রকৃত রুপ হতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া। যেহেতু জাদুকর একটি জিনিসকে তার প্রকৃত রুপ হতে সরিয়ে নিয়ে যায় এবং সেটা দর্শকের সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করে যা তার আসল রুপ নয় তাই বলা হয় সে উক্ত জিনিসটিকে জাদু করেছে অর্থাৎ তার প্রকৃত রুপ পরিবর্তন করে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছে। (লিসানুল আরব)
আব্দুর রহমান আল জাযাইরী রঃ বলেন, কোনো কোনো ফকীহ বলেছেন জাদু হলো স্বাভাবিক কিছু বিষয়কে ব্যাবহার করে অস্বাভাবিক ও অলৌকিক ঘটনা ঘটানো। (আল-ফিকহু আলাল মাজহিবিল আরবায়া)
সুতরাং সাধারনভাবে জাদুর অর্থ হলো, কোনো একটি স্বাভাবিক বিষয়কে মানুষের সামনে অস্বাভাবিক ও আশ্চর্য্জনকভাবে তুলে ধরা।
কিন্তু আশ্চর্য্জনক যে কোন ঘটনার উপর কুফরী ফতোয়া আরোপ করা যায় না। যেহেতু এধরনের আশ্চর্য্জনক ঘটনা যারা প্রদর্শন করে তারা বিভিন্ন প্রকার পন্থা ও পদ্ধতির উপর নির্ভর করে থাকে। যেমন,
ক। কেউ কেউ দুষ্টু জিন তথা শয়তানের পূজা উপাসনা করার মাধ্যমে তাদের সন্তুষ্ট করে বা শিরক-কুফর সম্বলিত তন্ত্র-মন্ত্র পাঠ করে এধরনের বিস্ময়কর ঘটনা প্রদর্শন করে। এই প্রকৃতির জাদু কুফরী হবে তাতে কেউ সন্দেহ করতে পারে না।
খ। কেউ কেউ সাধারন জিনদের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের মাধ্যমে কিছু ঘটনা প্রদর্শন করে। পূর্বে আমরা বৈধ ভাবে জিনদের কোনো কাজে ব্যাবহার করার পক্ষে ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও অন্যান্য কিছু ওলামায়ে কিরামের মতামত উল্লেখ করেছি। অতএব, যদি কোনো ব্যক্তি জিনদের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে কিছু অস্বাভাবিক ক্রিয়া-কর্ম প্রদর্শন করে যেমন, শূন্যে ভেসে ওঠা, হাতের ইশারায় গাছের ডাল ভেঙ্গে দেওয়া ইত্যাদি তবে তা কোনোভাবেই কুফরী হতে পারে না। একইভাবে, যেসব দোয়া-মন্ত্রে শিরক কুফর নেই এমন কিছু পাঠ করে যদি কেউ কাউকে ক্ষতি করে তবে সে কাফির হয়ে যাবে এমন বলা যায় না। তবে অপরাধ প্রমাণিত হলে, উক্ত ক্ষতির পরিমান অনুযায়ী এই ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান করা যেতে পারে।
গ। আল্লাহ তায়ালা নিজে কারো মাধ্যমে অনেক সময় অতি আশ্চর্য্জনক কিছু ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে এধরনের ঘটনা ভাল লোকের মাধ্যমও ঘটে আবার খারাপ লোকদের মাধ্যমেও ঘটে। ভাল লোকের মাধ্যমে আশ্চর্য্জনক ঘটনা ঘটলে সেটাকে কারামত এবং খারাপ লোকের মাধ্যমে এটা ঘটলে তাকে ইস্তিদরাজ বলা হয়। বিষয়টির নামকরন যায় করা হোক যদি সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে কারো মাধ্যমে আশ্চর্য্জনক কোনো ঘটনা ঘটে তবে তাতে উক্ত ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা যায় না। যেমন কারো দৃষ্টি লেগে কোনো ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়লে বা মারা গেলে উক্ত ব্যক্তিকে আখ্যায়িত করা যাবে না। একইভাবে যদি কারো উপর কেউ বদদোয়া করে আর সাথে-সাথেই ঐ ব্যক্তি মারা যায় তবু যে বদ দোয়া করলো তাকে কাফির বলা হবে না। কারণ, কারো ব্যাপারে বদদোয়া করা কুফরী নয় আবার কাউকে হত্যা করে ফেলাও কুফরী নয়।
ঘ। বর্তমানে যাদের জাদুকর বলা হয় তাদের বেশিরভাগই হাতের কৌশল ব্যবহার করে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার মাধ্যমে বিস্ময়কর ঘটনাবলী প্রদর্শন করে থাকে। বিশেষ কিছু কৌশল ব্যবহার করে তার কিছু সাধারন ঘটনাকে মানুষের সামনে আশ্চর্য্জনকভাবে তুলে ধরে। তারা কোনো মন্ত্রও পাঠ করে না জিনদের সাথেও যোগাযোগ করে না। এই ধরনের কাজকে কুফরী বলা যেতে পারে না।
ঙ। অনেক সময় দেখা যায় জাদুকররা বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। সাধারন মানুষ ঐ সকল প্রযুক্তি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারনে এই সব কাজকে জাদু মনে করে। এই সকল বিষয়ও কুফরী নয়।
এ কারণে বেশিরভাগ ওলামায়ে কিরাম সাধারনভাবে সকল প্রকার জাদুকে কুফরী বলেন নি। তবে কুফরী কথা ও কাজের মাধ্যমে যে জাদু করা হয় তারা সেগুলোকে কুফরী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সকল প্রকার জাদু যে, কুফরী নয় সে বিষয়ে একটি হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
আয়েশা রাঃ হতে বর্ণিত আছে যে তার এক দাসী তাকে জাদু করেছিল তিনি তাকে বললেন, তুমি কি আমাকে জাদু করেছো? সে বলল হ্যা। তিনি বললেন, কেনো? (কোনো কোনো রেওয়ায়েতে আছে জবাবে উক্ত দাসী বলেছিল, আমি মুক্তি পাওয়ার আশায় জাদু করেছি) তিনি বললেন, তুমি কখনই মুক্তি পাবে না তারপর বললেন, আরবের মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট আচরণের মালিকের নিকট একে বিক্রয় করো। (মুস্তাদরাকে হাকিম) [হাকিম তার মুস্তাদরাকে হাদিসটিকে সহীহ্ বলেছেন, এবং আজ-জাহাবী তার তালখীসে বলেছেন। শায়েখ আলবানী ইরওয়াউল গালিলে হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]
যদি সর্বক্ষেত্রেই জাদু কুফরী হতো তবে আয়েশা রাঃ এই দাসীকে হত্যা করতে আদেশ করতেন কিন্তু তিনি তা করেন নি বরং তাকে বিক্রয় করে দিয়েছেন।
কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন, উক্ত দাসী হয়তো নিজে জাদু করেনি বরং অন্য কারো দিয়ে জাদু করিয়েছিল। অতএব, এই হাদীসের মাধ্যমে জাদু কুফরী নয় তা প্রমানিত হয় না। কিন্তু এ যুক্তি সঠিক নয় যেহেতু কুফরী কাজ অন্য কারো দিয়ে করানোও কুফরী যেমনটি আমরা পূর্বে বর্ণনা করেছি।
ইমাম আননাব্বী রঃ বলেন, এ বিষয়ে ইজমা হয়েছে যে জাদু হারাম। কিতাবুল ইমানে গত হয়েছে যে রসুলুল্লাহ সাঃ এটাকে সাতটি ধ্বংসাত্মক বিষয়ের মাধ্যে গণ্য করেছেন। সেখানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তার সংক্ষিপ্ত রুপ এইযে, কখনও কখনও জাদু কুফরী হয় কখনও কখনও কুফরী হয়না বরং কবীরা গোনাহ হয়। যদি জাদুর মধ্যে এমন কোনো কথা বা কাজ থাকে যা কুফরী তবে তা কুফরী হবে আর তা না থাকলে কুফরী হবে না। আর জাদু শেখানো বা শিক্ষা করা হারাম যদি যা শেখা হচ্ছে তার মধ্যে কুফরী থাকে তবে (তা শিক্ষা করা) কুফরী হবে যদি কোনো কুফরী না থাকে তবে কুফরী হবে না। যদি জাদুর মধ্যে কোনো কুফরী না থাকে তবে জাদুকরকে লঘু শাস্তি দেওয়া হবে এবং তাওবা করতে বলা হবে তাকে হত্যা করা হবে না এটাই আমাদের (শাফেঈ মাযহাবের) মত। (শারহে মুসলিম)
শাফেঈ মাযহাবের প্রখ্যাত ফকীহ্ ইবনে হাযার হাইতামী রঃ বলেন, কুফরী কাজ সমূহের মধ্যে একটি হলো, ঐ প্রকৃতির জাদু যার মধ্যে সূর্য্কে পূজা করা বা এই প্রকৃতির কর্মকান্ড থাকে। যদি এসব কিছু না পাওয়া যায় তবে জাদু হারাম হবে কুফরী হবে না। অতএব, জাদু নিজে কুফরী নয় যতক্ষণ না তার মধ্যে কোনো কুফরী পাওয়া যায়।
এরপর তিনি শাফেঈ মাযহাবের অন্য আলেম আল-মাওরুদী থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন, ইমাম শাফেঈর মাজহাব হলো, জাদুর মাধ্যমে কাউকে কাফির বলা হবে না হত্যাও করা হবে না। (আল-ই’লাম বিকওয়াতিইল ইসলাম)
ইমাম আল-কুরতুবী রঃ ইবনে মুনযির থেকে বর্ণনা করেন, যদি কোনো ব্যক্তি স্বীকার করে যে, সে কুফরী বাক্য দ্বারা জাদু করেছে তবে তওবা না করলে তাকে হত্যা করা হবে। একইভাবে যদি স্বাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে একথা প্রমাণিত হয় যে, সে কুফরী কালাম ব্যাবহার করেছে তবে তাকে হত্যা করা হবে আর যদি সে এমন কিছু ব্যবহার করে যা কুফরী নয় তবে তাকে হত্যা করা জায়েজ হবে না। কিন্তু জাদুর মাধ্যমে যদি কোনো ব্যক্তির এমন ক্ষতি করে থাকে যাতে কিসাস আছে তবে কিসাস অনুযায়ী তাকে শাস্তি দেওয়া হবে আর যদি এমন কোনো অপরাধ করে যাতে কিসাস নেই তবে জরিমানা আদায় করা হবে। (তাফসীরে কুরতুবী)
হানাফী মাযহাবের প্রখ্যাত ফকীহ্ ইবনে আবেদীন রঃ উল্লেখ করেন, জাদু বলতে যা কিছু বোঝায় তার সবই কুফরী নয়। যেহেতু জাদুর মাধ্যমে যেসব ক্ষয়-ক্ষতি করা হয় তার উপর কুফরীর ফতোয়া আরোপ করা যায় না বরং তার মধ্যে যেসব কুফরী কথা ও কাজ থাকে তার উপর নির্ভর করে তাকফীর করা হয়। যেমন নক্ষত্ররাজির স্বতন্ত্র ক্ষমতায় বিশ্বাস করা তথা নক্ষত্ররাজিকে রুবুবিয়্যাতের ক্ষমতার ক্ষমতাশালী মনে করা বা কুরআনকে অবমাননা করা বা কোনো কুফরী কথা বলা ইত্যাদি। (রদ্দে মুহতার)
এরপর তিনি বলেন, তবে সে কাফির নয় এর অর্থ এই নয় যে, তাকে কোনো অবস্থাতেই হত্যা করা যাবে না। যেহেতু তার উপর হত্যার বিধান পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার অপরাধে (কুফরীর অপরাধে নয়) যেমনটি আমরা পূর্বে বলেছি। অতএব, যদি প্রমাণিত হয় যে, সে জাদুর মাধ্যমে ক্ষতি সাধন করে তবে এই ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য উক্ত জাদু কুফরী না হলেও তাকে হত্যা করা হবে। যেভাবে ডাকাত ও সন্ত্রাসী প্রকৃতির লোককে হত্যা করা হয়। (রদ্দে মুহতার)
ইবনুল হুমাম রঃ ফাতহুল কাদীরে হানাফী মাযহাবের আলেমরা জাদুকে কুফরী বলেছেন এমন উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইবনে আবেদীন রঃ বলেন, এটা স্পষ্ট যে, ফাতহুল কাদীরে যা বলা হয়েছে সেখানে জাদু বলতে ঐ সকল বিষয় উদ্দেশ্য যা কুফরীর মাধ্যমে করা হয়। (রদ্দে মুহতার)
মোট কথা, জাদু নিজে কুফরী নয় এ বিষয়ে হানাফী ও শাফেঈ মাযহাবের ওলামায়ে কিরামের স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। তবে মালেকী ও হাম্বালী মাযহাবে জাদুকে সাধারভাবে কুফরী বলা হয়েছে। একারণে কেউ কেউ মনে করেছেন মালেকী ও হাম্বালী মাযহাবে সকল জাদুই কুফরী। প্রকৃত অবস্থা এমন নয়। জাদু বলতে আমরা যা কিছু বুঝি তারা সেসবকে ঢালাওভাবে কুফরী হিসেবে আখ্যায়িত করেন এমন নয়। স্বয়ং ইমাম মালিক ও আহমদ ইবনে হাম্বাল থেকে এ বিষয়ে ভিন্নমত বর্ণিত আছে এবং জাদু সম্পর্কে এই দুই ইমামের বক্তব্য নিয়ে তাদের মাজাহাবের ওলামায়ে কিরামের বিভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে।
ইবনে কুদামা রঃ বলেন, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল থেকে এমন বর্ণনাও রয়েছে যাতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি জাদুকরকে কাফির বলেন না।
এরপর তিনি উক্ত বর্ণনাটি উল্লেখ করেন যেখানে আহমাদ ইবনে হাম্বাল জাদুকরকে হত্যা না করে আটকে রাখার বিধান দিয়েছেন। বর্ণনাটি উল্লেখ করে ইবনে কুদামা বলেন, এটা প্রমাণ করে যে, তিনি জাদুকরকে কাফির মনে করেন নি যেহেতু কাফির মনে করলে তিনি তাকে হত্যা করার আদেশ দিতেন। (আল-মুগনী)
আহমাদ ইবনে হাম্বাল থেকে জাদুকর কাফির এমন রেওয়ায়েতও আছে। তবে হাম্বালী মাযহাবের বেশিরভাগ ফোকাহায়ে কিরাম এটা সকল প্রকার জাদুর উপর প্রয়োগ করেন নি।
হাম্বালী মাজহাবের প্রখ্যাত ফকীহ আল-মারদাবী রঃ বলেন, যে জাদুকর ঝাড়-র উপর ভর করে আকাশে উড়ে বেড়ায় বা এই ধরনের জাদু প্রদর্শন করে বা তারকারাজি তার সাথে কথা বলে এমন দাবী করে তবে সে কাফির হবে এটিই আমাদের মাজহাব। পরে তিনি বলেন, আর যে ব্যক্তি জিনদের কাজে লাগায় আর দাবী করে সে জিনদের আদেশ করলে তারা তা পালন করে তবে এটা কুফরী হবে না। তাকে হত্যাও করা হবে না তবে লঘু শাস্তি দেওয়া হবে। এটিই আমাদের মাযহাব। (আল-ইনসাফ)
এই বর্ণনার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় আশ্চর্য্জনক কিছু ঘটলেই সেটাকে ঢালাওভাবে কুফরী বলে আখ্যায়িত করা হাম্বালী মাযহাবের ওলামায়ে কিরামের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এ বিষয়ে তারা বিভিন্নভাবে পার্থক্য করে থাকেন। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ কেউ অন্যান্য ওলামায়ে কিরামের মতো জাদুকরকে কাফির বলার বিষয়টিকে তার আক্বীদা-বিশ্বাসের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
ইবনে মুফলিহ্ রঃ বলেন, ইবনে আকীল জাদুকরকে কাফির বলা সম্পর্কে আহমাদ ইবনে হাম্বালেন মতটি যার আক্বীদার মধ্যে কুফরী রয়েছে তার ব্যাপারে প্রযোজ্য মনে করেছেন। আর আক্বীদার বিকৃতি ছাড়ায় যে জাদু করে তাকে ফাসিক বলা হবে এবং হদ হিসেবে হত্যা করা হবে (কাফির হিসেবে নয়)।[আল-ফুরু]
এ বিষয়ে ইমাম মালিকের মন্তব্য এবং সে আলোকে তার মাযহাবের ওলামায়ে কিরামের মতমত ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও এটা প্রমাণ করে যে, তারা তন্ত্র-মন্ত্রের মাধ্যমে বা অন্য যে কোনোভাবে কোনো আশ্চর্য্জনক বিষয় ঘটানো ঢালাওভাবে কুফরী মনে করেন নি।
ইমাম মালিক হতে বর্ণিত আছে, যে স্ত্রী (জাদুর মাধ্যমে) তার স্বামীকে মিলনের ব্যাপারে অক্ষম করে ফেলে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে, হত্যা করা হবে না। (তাফসীরে কুরতুবী)।
এ থেকে বোঝা যায় তিনি এই প্রকারের জাদুকে কুফরী মনে করেন নি।
ইমাম মালিক থেকে সাধারনভাবে জাদু শিক্ষা করা কুফরী হিসেবে আখ্যায়িত করার মতও বর্ণিত আছে। মালেকী মাযহাবের বিভিন্ন ফুকাহায়ে কিরাম এই মতটিকে অস্পষ্ট ও জটিল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই জটিলতা নিরসনে তারা বিষয়টির গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বর্ণনা করেছেন।
মালেকী মাজহাবের ফকীহ্ আল-আদাবী বলেন, ইমাম মালিক সাধারনভাবে জাদুকরকে কাফির হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তার এই কথাটি ভীষণ অস্পষ্ট আল-কারাফী এমনটিই বলেছেন। তবে যদি ইমাম মালিকের কথার ব্যাখ্যা এভাবে করা হয় যে, জাদু বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, গয়রুল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং সৃষ্টিরাজির নিয়ন্ত্রণে গয়রুল্লাহর সম্পর্ক রয়েছে এমন দাবী করা তবে ইমাম মালিকের কথার মধ্যে কোনো জটিলতা থাকে না। (শারহে কিফাইয়া)
মালেকী মাজহাবের বিভিন্ন ফিকাহ্ গ্রন্থে জাদু সম্পর্কে অনুরুপ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
মালেকী মাজহাবের প্রখ্যাত ফকীহ্ কাজী ইবনুল আরবী রঃ বলেন, জাদুর প্রকৃত মর্মার্থ হলো, এটা এমন কিছু কথার মাধ্যমে করা হয় যাতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো প্রতি সৃষ্টিরাজির কর্তৃত্ব আরোপ করা হয়। (আহকামুল কুরআন)
ইবনে আরবীর এই সঙ্গাটি মালেকী মাযহাবের ওলামায়ে কিরাম অত্যাধিক গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেছেন। তারা যে কোনো আশ্চর্য্ ঘটনাকে কুফরী হিসেবে আখ্যায়িত করেন নি। এ বিষয়ে তাদের বেশ কিছু স্পষ্ট ফতোয়া বিদ্যামান রয়েছে।
মালেকী মাজহাবের বিভিন্ন ফিকাহ গ্রন্থে এসেছে, যদি কেউ অন্য কারো কান কেটে দেয় (এবং পরে তা ভাল করে দেয়) এবং নিজের পেটে ছুড়ি ঢুকিয়ে দেয় যদি এটা জাদু হয় তবে তাকে হত্যা করা হবে আর যদি এটা জাদু না হয় তবে তাকে অন্য কোন শাস্তি দেওয়া হবে। (আত-তাজ ওয়াল ইকলিল)
দেখা যাচ্ছে নিজের পেটের মধ্যে ছুড়ি ঢুকিয়ে দেওয়া বা অন্যের কান কেটে আবার তা ভাল করে দেওয়ার মতো মর্মকান্ডেও মালেকী মাজহাবের ওলামায়ে কিরামের নিকট নিশ্চিত জাদু তথা কুফরী হিসেবে গণ্য নয় বরং তারা বলেছেন দেখতে হবে তা জাদু কিনা। অতএব, বর্তমান সময়ের প্রচলিত সকল প্রকার জাদুর উপর তাদের ফতোয়া আরোপ করা যায় না।
একইভাবে তারা বলেছেন, জাদুকরকে হত্যা করা হবে না যতক্ষণ না এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তায়ালা যে প্রকারের জাদুকে কুফরী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন সে ঐ প্রকারের জাদু করেছে কিনা। যারা জাদু সম্পর্কে অভিজ্ঞ তাদের নিকট প্রশ্ন করে এ বিষয়ে জানতে হবে এবং যে শাসক জাদুকরকে হত্যার রায় দেবেন তার নিকট এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হতে হবে। (শারহে কিফাইয়া)
এই মতটি উল্লেখ করে আল-আদাবী বলেন, এই হিসেবে বলা যায় যদি কেউ কুরআনের কোনো আয়াত যেমন “আমি তাদের মধ্যে শত্রুতা ও ঘৃণা সৃষ্টি করে দিলাম” এই আয়াতটি পাঠ করে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট করে তবে তা কুফরী হবে না। (শারহে কিফাইয়া)
জাদুকরকে হত্যা করার পূর্বে আল্লাহ যে প্রকৃতির জাদুকে কুফরী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন ঐ ব্যক্তি আসলেই ঐ প্রকৃতির জাদু করেছে কিনা সেটা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হওয়ার শর্তটি উল্লেখ করার পর আল-খারাশী রঃ বলেন, যেহেতু এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা হচ্ছে অতএব, অন্যান্য যা কিছুর মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা হয় সেসব ব্যাপারের মতো এ বিষয়েও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হবে। (শারহে মুখতাসারে খলীল)
কাউকে হত্যা করা বা কাফির বলার ক্ষেত্রে এধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা ওলামায়ে কিরামের নিকট সর্বসম্মত মূলনীতি।
ইমাম আল-কুরতুবী রঃ এ বিষয়ে মতপার্থক্যের কথা উল্লেখ করার পর জাদুকরকে হত্যা না করার মতটিকে প্রাধান্য দিয়ে বলেন, আমি বলব, এটাই সঠিক কেননা নিশ্চিত প্রমান না পাওয়া পর্য্ন্ত কোনো মুসলিমের রক্ত ঝরানো বৈধ নয় আর যে ক্ষেত্রে ইখতিলাফ রয়েছে সে ক্ষেত্রে নিশ্চিত প্রমাণের দাবি কিভাবে করা যেতে পারে? (তাফসীরে কুরতুবী)
বর্তমানে যারা সাধারনভাবে সকল প্রকার জাদুকরকে কাফির হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন এবং নিজেদের স্বপক্ষে ইমাম মালিক বা ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বালের মতকে ব্যবহার করেন তারা এই উভয় ইমামের বক্তব্যকে তাদের মতালম্বী বরেণ্য ওলামায়ে কিরামের ব্যাখ্যার মাধ্যমে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেন না। জাদু সম্পর্কে পূর্ববর্তী ওলামায়ে কিরামের মতামতের উপর স্থিরভাবে চিন্তা-গবেষণা করলে দেখা যাবে তারা কেউই সাধারনভাবে জাদু বলতে যা কিছু বোঝায় তার উপর ঢালাওভাবে কুফরী ফতোয়া আরোপ করেন নি। বরং জাদুর বিশেষ কিছু প্রকার ও পদ্ধতিকে তারা কুফরী বলেছেন। এই প্রকার ও পদ্ধতি নির্ধারনে তাদের মধ্যে কিছুটা দ্বিমত রয়েছে তবে বেশিরভাগ ওলামায়ে কিরামের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে যেটা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় তা হলো সাধারনভাবে জাদু কুফরী নয় যতক্ষণ না এর মধ্যে কোনো কুফরী কথা বা কাজ পাওয়া যায়।
আব্দুর রহমান আল-যাঝাইরী এ বিষয়ে চার মাজহাবের ফুকাহায়ে কিরামের মতমত আলোচনা করার পর বলেন, মোট কথা, জাদুর মধ্যে যখন এমন কোনো ইসলাম বিরোধী কথা ও কাজ থাকে যা কুফরী হিসেবে গণ্য তবে জাদু কুফরী হবে। তার মাধ্যমে কি করা হচ্ছে তা দেখা হবে না। আর যদি তার মধ্যে কোনো হারাম কথা ও কাজ থাকে তবে তা হারাম বলে গণ্য হবে। আর যদি বৈধ কাজ-কর্মের মাধ্যমে জাদু করা হয় তবে দেখতে হবে সেটা কি কাজে ব্যাবহার করা হচ্ছে। যদি অবৈধ কাজে ব্যাবহার করা হয় তবে হারাম হবে আর তা না হলে হারাম হবে না।
এরপর তিনি বলেন, ফুকাহায়ে কিরামের নিকট জাদুর বিধান এটাই। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এ বিষয়ে চার মাজহাবের ওলামায়ে কিরামের ইজমা সম্পাদিত হয়েছে। (আল-ফিকহু আলাল মাজাহিব আল আরবায়া)
উপরোক্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা স্পষ্ট অবগত হয়েছি যে, জাদু নিজে কুফরী নয় যদি না তার মধ্যে অন্য কোনো কুফরী থাকে। জাদুর মধ্যে কি ধরনের কুফরী থাকতে পারে তার উপর নির্ভর করে জাদুকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।
ক। স্পষ্ট কুফরী কথা ও কাজের মাধ্যমে যে জাদু করা হয়।
খ। কোনো এর প্রকার জাদু সম্পর্কে যদি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় যে, এই প্রকৃতির জাদু শিরক-কুফরের মাধ্যমে ছাড়া ঘটানো সম্ভন নয় তবে উক্ত জাদুকে কুফরীর প্রতীক বা চিহ্ন হিসেবে গ্রহণ করা হবে এবং উক্ত জাদু যে দেখায় তার মধ্যে অন্য কোনো কুফরীর প্রমাণ না পাওয়া গেলেও তাকে কাফির বলা হবে। তবে অভিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের স্পষ্ট বক্তব্যের আলোকে এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। ইমাম আল-কুরতুবী রঃ বলেন, আলেমদের একটি অংশ বলেছেন, যদি জাদু বিদ্যায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা এটা নিশ্চিত করে বলে যে, কুফরী, ধর্মদ্রোহীতা ও শয়তানকে পূজা করা ছাড়া জাদু প্রদর্শন করা সম্ভব নয় তবে সেক্ষেত্রে জাদু কুফরীর প্রতীক হিসেবে গণ্য হবে (অর্থাৎ তা কুফরী হবে) আর আল্লাহই ভাল জানেন। (তাফসীরে কুরতুবী)
ইমাম কুরতুবীর এই কথাটির উপর সুক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে এখানে একটি মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে। কোনো কিছু যখন কুফরীর স্পষ্ট প্রমাণ ও প্রতীকে পরিনত হয় তখন সেটা নিজেই কুফরী হিসেবে গণ্য হয়। ঈমান ভঙ্গের চতুর্থ মূলনীতি তথা “রিদা বিল কুফরী কুফর” সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা এ বিষয়ে সুবিস্তারে আরোচনা করেছি। জাদুর ক্ষেত্রে এই মূলনীতিটি কেবল তখন প্রয়োগ করা যায় যখন প্রমাণিত হবে জাদু কেবল কুফরীর মাধ্যমেই করা সম্ভব বা স্পষ্ট শিরক-কুফরে লিপ্ত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে জাদু প্রদর্শন করা সম্ভব নয়। জাদু সম্পর্কে উপরে যা কিছু বর্ণনা করা হয়েছে সে আলোকে এটা স্পষ্ট যে, সকল প্রকার জাদুর ব্যাপারে এমন বলা সম্ভব নয়। জাদু বলতে আমরা যা কিছু বুঝি তা কেবল শিরক-কুফরের মাধ্যমে করা হয় বা কেবল কাফির-মুশরিকরাই সেটা প্রদর্শন করে এমন নয় বরং বিভিন্ন মত ও পথের লোকেরা নানা রকম পন্থা ও পদ্ধতিতে জাদু প্রদর্শন করে থাকে। অতএব, সাধারনভাবে সকল প্রকার জাদুকে কুফরীর প্রতীক বা প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। একারণে ওলামায়ে কিরাম জাদুকে সর্বাবস্থায় কুফরী মনে করেন নি। তবে এটা নিশ্চিয় বলা যায় যে, ক্ষেত্র বিশেষে কোনো একটি বিশেষ প্রকারের জাদু কুফরীর প্রমাণ বা প্রতীক হিসেবে গণ্য হতে পারে। উদাহরণস্বরুপ ধরে নিই একজন ব্যক্তি জাদুর মাধ্যমে নিজেকে গাধায় পরিনত করে এবং পুনরায় মানুষ রুপে আবির্ভূত হয়। দুনিয়ার বুকে এই প্রকৃতির জাদু অন্য কেউ প্রদর্শন করে না। ঐ ব্যক্তির নিকট শিক্ষা নিয়ে অন্য অনেকে একইপ্রকার জাদু প্রদর্শন করা শুরু করলো। পরবর্তীতে বিশ্বাসযোগ্য স্বাক্ষ্য-প্রমানের ভিত্তিতে প্রমাণিত হলো ঐ ব্যক্তি উক্ত জাদু প্রদর্শনের সময় কুফরী কালাম উচ্চারণ করে। এর ফলে ঐ ব্যক্তি কাফিরে পরিনত হবে এবং যারা ঐ প্রকৃতির জাদু প্রদর্শন করে তারাও কাফিরে পরিনত হবে। যদিও তারা সকলেই কুফরী কালাম পাঠ করে কিনা সে বিষয়ে পৃথক পৃথকভাবে জানা সম্ভব না হয় । কেননা এক্ষেত্রে একজনের মাধ্যমে বাকীদের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা সৃষ্টি হচ্ছে। যেহেতু তারা একই ব্যক্তির নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেছে এবং একই প্রকৃতির জাদু প্রদর্শন করছে অতএব, তারাও ঐ ব্যক্তির মতোই একই পন্থায় জাদু প্রদর্শন করবে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে তারাও কুফরী কালাম ব্যাবহার করে এটা প্রমাণিত হচ্ছে ফলে তাদের কাফির বলা হবে।
এভাবে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে যখন নিশ্চিত হওয়া যায় যে, কোনো একটি বিশেষ প্রকৃতির জাদু কুফরী কালামের মাধ্যমেই করা হয় তবে উক্ত জাদু যে প্রদর্শন করে তাকে কাফির বলা হবে যদিও সে নিজে কুফরী কালাম ব্যাবহার করেছে এমন প্রমান পাওয়া না যায়। তবে সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং নিশ্চিতভাবে উক্ত প্রকারের জাদু কুফরী কালামের মাধ্যমেই করা হয় তা প্রমাণিত হচ্ছে কিনা লক্ষ্য করতে হবে।
গ। যদি কোনো জাদুকর জাদুর মাধ্যমে গায়েবী বিষয়ের উপর অসীম কর্তৃত্ব দাবী করে তবে সে কাফির হবে। যেহেতু এটা আল্লাহর রুবুবিয়্যাতের ক্ষমতার শরীক করা হিসেবে গণ্য হবে। উদাহরণ স্বরুপ যদি কোনো জাদুকর তার অনুসারীদের উদ্দেশ্যে বলে তোমরা যে যেখানে থাকো আমি জাদুর মাধ্যমে সেটা দেখতে পায় এবং তোমাদের কথা শুনতে পায়। তোমরা আমার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করলে আমি জাদুর মাধ্যমে সাহায্য করতেও সক্ষম। তবে এই ব্যক্তি নিজে এবং তার এই ক্ষমতায় যারা বিশ্বাস করে তারা সকলে কাফিরে পরিনত হবে। আল্লাহর কর্তৃত্বে আংশীদারিত্ব প্রমাণ করে এমন যে কোনো ঔদ্ধত্বপূর্ণ দাবীই কুফরী বলে গণ্য হবে। ওলামায়ে কিরাম এর বিভিন্ন উদাহরণ উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ এক্ষেত্রে মানুষকে গাধা বানিয়ে দেওয়া বা জড় বস্তুতে প্রাণ সৃষ্টি করা এবং প্রাণীকে জড় বস্তুতে পরিনত করা ইত্যাদি বিষয়কে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ইমাম আল-কুরতুবী রঃ বলেন, জাদুর মধ্যে এমন কিছু রয়েছে যা কেউ করলে সে কাফির হবে যেমন যদি কেউ মানুষের আকৃতি পাল্টে দেওয়ার দাবি করে বা তাদের আকৃতি পরিবর্তন করে পশু বানিয়ে ফেলা, এক মাসের রাস্তা এক রাতে অতিক্রম করা, আকাশে উড়া ইত্যাদির দাবি করে। যে এমনটি করে এবং মানুষকে এটা বোঝায় যে সে সত্যবাদি তবে সে কাফির হবে। (তাফসীরে কুরতুবী)
ইমাম কুরতুবী উল্লেখিত উপরোক্ত উদাহরণসমূহের মধ্যে এক মাসের রাস্তা এক রাতে অতিক্রম করা এবং আকাশে ওড়ার বিষয়টি কুফরীর পর্যায়ে পড়তে পারে বলে মনে হয় না। যেহেতু জিনদের সহযোগিতায় এটা ঘটা সম্ভব। তবে মানুষের আকৃতি পাল্টে দেওয়া বা মানুষকে পশু বানিয়ে ফেলার দাবী করা হলে তা কুফরী হিসেবে গণ্য হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট। যেহেতু এটা আল্লাহর ক্ষমতার সাথে ঔদ্ধত্বোপূর্ণ আচরণ বলে গণ্য।
এখানে লক্ষ্যনীয় হলো, যদি কোনো জাদুকর প্রকৃতই মানুষকে গাধাতে পরিনত করা বা জড় বস্তুকে প্রাণীতে পরিনত করার দাবী করে তবে সে উপরোক্ত মতামতের আলোকে কাফির হবে। কিন্তু যে নজরবন্দি করার মাধ্যমে মানুষের নিকট একটি জড় বস্তু প্রাণীতে পরিনত হয়ে গেছে বা মানুষ গাধায় পরিনত হয়েছে এমন ধারনা সৃষ্টি করে এবং সে এটা স্বীকারও করে যে, এটা আসলে দেখার ভুল প্রকৃত ঘটনা নয় তবে সে কাফির হবে না।
আলেমদের কেউ কেউ জাদুর মাধ্যমে নবীদের মুজিযার সমপর্যায়ের ঘটনা প্রদর্শনের দাবী করাও কুফরী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যেহেতু এর মাধ্যমে নবীদের মর্যাদাকে খাটো করা হয়। ইমাম কুরতুবী কিছু কিছু আলেম থেকে এ মত বর্ণনা করেছেন। জাদুকরকে কাফির বলার ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা যেতে পারে। উপরে আমরা দেখেছি আল্লাহর ক্ষমতায় অংশী স্থাপণ করা হয় এমন ঔদ্ধত্বোপূর্ণ দাবী করা কুফরী। একইভাবে নবী-রাসুলদের মু’জিযাকে ছোট করা হয় এমন দাবী করাও কুফরী। যেমন যদি কেউ বলে, আমি (জাদুর মাধ্যমে) চাঁদকে দ্বি-খন্ডিত করতে পারি, জাদুর মাধ্যমে সিদরাতুল মুনতাহা পর্য্ন্ত ভ্রমণ করতে পারি ইত্যাদি। তবে সেক্ষেত্রে সতর্কতার সাথে লক্ষ্য করতে হবে যে, প্রকৃত পক্ষেই সে অসম্ভব ও অসঙ্গতিপূর্ণ দাবী করেছে কিনা।
ট্যাগ: ইসলামে জাদুর বিধান ইসলামে জাদুর বিধান ইসলামে জাদুর বিধান ইসলামে জাদুর বিধান ইসলামে জাদুর বিধান ইসলামে জাদুর বিধান ইসলামে জাদুর বিধান ইসলামে জাদুর বিধান ইসলামে জাদুর বিধান