কুফরী মনেকরে কোনো কাজে লিপ্ত হওয়া – অথচ তা কুফরী না – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মূনীল

কুফরী মনেকরে কোনো কাজে লিপ্ত হওয়া – অথচ তা কুফরী না – #শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মূনীর# এর গবেষণা মূলক প্রবন্ধটি পড়ুন এবং আপনার বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করুন।

উপরে আমরা দেখেছি কুফরী কাজে লিপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা বা কুফরী কাজে লিপ্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করাও কুফরী যদিও সে আসলে কুফরীতে লিপ্ত না হয়। এ হিসেবে বলা যায় যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বিষয়কে কুফরী মনে করে যা আসলে কুফরী নয় বা সেটা কুফরী কিনা তা নিয়ে দ্বিমত আছে কিন্তু সে উক্ত কাজে লিপ্ত হয় তবে উক্ত ব্যক্তি কাফির হবে। উদাহরণ স্বরুপ, খারেজীরা মনে করে যে কোনো কবীরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তি কাফির। এখন যদি তারা কবীরা গোনাহে লিপ্ত হয় তবে তাদের কাফির বলা উচিৎ। যদিও সে যাতে লিপ্ত হয়েছে তা কুফরী নয়। যেহেতু সে বিষয়টিকে কুফরী মনে করার পরও স্বোচ্ছায় তাতে লিপ্ত হয়েছে। এর মাধ্যমে সে কুফরীতে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও সন্তুষ্ট হয়েছে। যদি কেউ মনে করে সলাত পরিত্যাগ করলে নিশ্চিত কাফির হয়ে যায় কিন্তু সে সলাত পরিত্যাগ করে তার ব্যাপারেও একই বিধান প্রযোজ্য হবে।

যদি কেউ বলে, আমি যদি চুরি করে থাকি তবে আমি ইয়াহুদী বা খৃষ্টান অথচ সে আসলে চুরি করেছে তবে সে কাফির হবে কিনা সে বিষয়ে মতপার্থক্য উল্লেখ করার পর হানাফী মাজহাবের ফিকাহ্ গ্রন্থে বলা হয়েছে। যদি সে মনে করে এমন করলে সে কাফির হয়ে যাবে তবে সে আসলেই কাফির হয়ে যাবে। কারণ, সে যে বিষয়কে কুফরী মনে করে তাতে লিপ্ত হয়েছে অতএব, সে কুফরীতে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। (আল-মাবসুত, বাহরুর রায়েক)

যে কোনো বিষয় কুফরী মনে করার পরও তাতে লিপ্ত হওয়া মূলত কুফরী কাজ কারার সিদ্ধান্ত ও সংকল্প করা হিসেবে গণ্য হওয়ার কারণে এটা কুফরী হওয়ার বিষয়টিই সঠিক। তবে শর্ত হলো,

১। উক্ত বিষয়টি কুফরী হওয়া সম্পর্কে ঐ ব্যক্তির নিশ্চিত বিশ্বাস থাকতে হবে।

২। উক্ত কাজে লিপ্ত হওয়ার সময় এ বিষয়টি তার স্মরণে ছিল কি না তা লক্ষ করতে হবে।

যদি এমন হয় যে, একজন ব্যক্তি সলাত পরিত্যাগ করা কুফরী মনে করে। সাধারণভাবে মতামত ব্যাক্ত করার সময় সে এই রায়ই ঘোষণা করে কিন্তু এ বিষয়ে দুই রকম দলিল প্রমাণ এবং অন্যান্য ওলামায়ে কিরামের দ্বিমত থাকার কারণে এটা কুফরী নাও হতে পারে এমন সম্ভাবনা তার অন্তরে উদিত হয়। অর্থাৎ সে বিষয়টি কুফরী হওয়ার মতটিকেই অধিক সঠিক ও প্রানিধানযোগ্য মনে করে ঠিকই কিন্তু কুফরী না হওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি অমূলক মনে করে না। এমতাবস্থায় সে সলাত পরিত্যাগ করলে তাকে কাফির বলা যেতে পারে না যেহেতু সে নিশ্চিতভাবে কুফরীতে লিপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এমন বলা যায় না।

একইভাবে যদি এমন হয় যে, উক্ত ব্যক্তি কোনো একটি বিষয়কে নিশ্চিতভাবে কুফরী মনে করে কিন্তু যখন সে উক্ত কাজে লিপ্ত হয়েছিল তখন তার বিষয়টি স্মরণে ছিল না তাহলে সে কাফিরে পরিনত হবে না। তবে যদি উক্ত কাজে লিপ্ত হওয়ার সময় তার এটা স্মরণ হয় যে, এতে লিপ্ত হলে আমি কাফির হয়ে যাবো এরপরও সে উক্ত কাজে লিপ্ত হয় তখন সে কুফরী কাজ করা বা কাফির হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এমন বলা যায় ফলে সে কাফির হবে। উদাহরণস্বরুপ, হয়তো সে মদ পান করা বা জিনা করাকে কুফরী মনে করে। কিন্তু প্রবৃত্তির তাড়নায় ঘটনাক্রমে সে এসব কাজে লিপ্ত হয়ে গেল। উক্ত কাজে লিপ্ত হওয়ার সময় তার একবারও একথা মনে হয় নি যে আমি তো কুফরী করছি। তবে এই ব্যক্তি কুফরী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এমন বলা যায় না। আর যদি উক্ত কাজে লিপ্ত হওয়ার সময় তার মনে হয় এ বিষয়টি নিশ্চিত কুফরী তবু সে তাতে লিপ্ত হয় তবে সে মানসিক দিক থেকে কুফরীতে লিপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কারণে কাফির হবে।

উপরোক্ত বিশ্লেষণের আলোকে বোঝা যায়, কোনো একজন ব্যক্তি ভুল বুঝের কারণে বা মতপার্থক্যের কারণে কোনো একটি বিষয়কে কুফরী মনে করার পরও ঐ কাজে লিপ্ত হলেই সে কুফরী করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং কাফির হয়েছে এমন বলা যায় না। যতক্ষণ না প্রমাণিত হবে সে উক্ত বিষয়টিকে নিশ্চিত কুফরী মনে করে এবং উক্ত কাজে লিপ্ত হওয়ার সময় বিষয়টি তার স্মরণে ছিল। অর্থাৎ সে নিশ্চিত কুফরীতে লিপ্ত হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই উক্ত কাজে লিপ্ত হয়েছে। যেহেতু কুফরীতে লিপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া বা কুফরীতে লিপ্ত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়াও কুফরী।

এখানে প্রশ্ন হতে পারে, মূর্তির সামনে সাজদা করা বা হারামকে হালাল মনে করা ইত্যাদি কুফরী কর্মকান্ডে কেউ লিপ্ত হলে তাকে সাধারণভাবে কাফির বলা হয়। এখানে সে ঐ বিষয়টিকে নিশ্চিতভাবে কুফরী মনে করে কিনা বা উক্ত কাজে লিপ্ত হওয়ার সময় সেটা তার স্মরণে ছিল কি না তা শর্ত করা হয় না তবে এক্ষেত্রে এসব শর্ত কেন আরোপ করা হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর হলো, যেসব কাজ কুফরী হওয়ার বিষয়টি কুরআন-হাদীস ও উম্মতের ইজমার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে এবং সাধারন মুসলিমদের মাঝে বিষয়টির ব্যাপক প্রচার প্রসার আছে ঐ সকল বিষয় কুফরী কিনা এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করার অধিকার কারো নেই। সুতরাং কেউ এ ব্যাপারে সন্দেহ করলেও তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। বিপরীত দিকে যেসব বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে বা উক্ত বিষয়ের জ্ঞান মুসলিমদের মাঝে ব্যাপক ভাবে প্রচার লাভ করে নি সেসব বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে বা উক্ত বিষয়ের জ্ঞান মুসলিমদের মাঝে ব্যপক ভাবে প্রচার লাভ করে নি সেসব বিষয়ে যে কারো অন্তরে সন্দেহ থাকা স্বাভাবিক। তাই ঐ সব ব্যাপারে সাধারনভাবে কাউকে কাফির বলা হবে না। যদি কেউ উক্ত বিষয়টি কুফরী হওয়ার মত গ্রহণ করার পরও তাতে লিপ্ত হয় তবে দেখতে হবে সে ওটাকে নিশ্চিত কুফরী মনে করে, নাকি তার অন্তরে এ ব্যাপারে কিছুটা সন্দেহ বিদ্যামান? যেহেতু বিষয়টি সন্দেহের উর্দ্ধে নয় তাই এ ব্যাপারে কেউ সন্দেহ পোষণ করলে তাকে ছাড় দেওয়া হবে।

এখন উক্ত কাজে লিপ্ত হওয়ার সময় সেটা যে কুফরী এটা স্মরণ থাকা শর্ত হওয়ার ব্যাপারে কথা হলো, মানুষের উপর যে কোনো রায় দেওয়া হয় দুটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে, (১) স্পষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে (২) তহার নিজস্ব স্বীকৃতির ভিত্তিতে। ইসলামের যে কোনো বিধানের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। কোনো ব্যাপারে বিশ্বস্ত সাক্ষীরা স্বাক্ষ্য দিলে এবং তার অপরাধ সম্পর্কে স্পষ্ট প্রমান পাওয়া গেলে তার স্বীকৃতির কোনো গুরুত্ব দেওয়া হবে না বরং তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেওয়া হবে। কিন্তু যদি তার অপরাধ স্পষ্ট সাক্ষ্য-প্রমানের ভিত্তিতে প্রমাণিত না হয় তবে উক্ত ব্যক্তি অপরাধ স্বীকার করে কিনা সেটা লক্ষ্য করতে হবে। যদি কেউ এমন কোনো কাজে লিপ্ত হয় যা স্পষ্ট কুফরী তবে ঐ কাজের উপর নির্ভর করেই তাকে কাফির বলা হবে তার অন্তরের অবস্থা লক্ষ্য করা হবে না। কিন্তু যদি সে এমন কাজে লিপ্ত হয় যা আসলে স্পষ্ট কুফরী নয় তবে উক্ত ব্যক্তিকে ঐ কাজের উপর নির্ভর করে কাফির বলা যায় না। এখন ঐ ব্যক্তি যেহেতু বিষয়টিকে কুফরী মনে করে তাই ঐ কাজে লিপ্ত হওয়ার অর্থ কুফরীতে লিপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া এই মূলনীতির আলোকে তাকে কাফির বলতে হলে তার অন্তরে প্রকৃতপক্ষে কুফরী করার সিদ্ধান্ত ছিল কিনা সেটা সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করতে হবে। যেহেতু এ বিষয়ে উক্ত ব্যক্তিকে কাফির বলার ব্যাপাটি তার অন্তরের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে বাইরের কাজটির উপর নয়। উক্ত কাজে লিপ্ত হওয়ার সময় ঐ কাজটি কুফরী এটা যদি তার স্মরণ নাই থাকে তবে সে কুফরী কাজের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এমন বলা যায় না অতএব তাকে কাফিরও বলা যায় না। এখানে এই ব্যক্তির বাইরে কাজটি স্পষ্ট কুফরী নয় ফলে তাকে কাফির বলার ক্ষেত্রে আমাদের তার অন্তরের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে একারণে এ ক্ষেত্রে তার অন্তরে প্রকৃতই কুফরী করার সিদ্ধান্ত ছিল কিনা তা গুরুত্বসহকারে লক্ষ্য করতে হবে। যদি সে এমন কোনো কাজ করতো যা উম্মতের ইজমার আলোকে স্পষ্ট প্রমাণিত এবং সর্ব স্তরের মুসলিমদের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রশিদ্ধ ও পরিচিত তবে এই কাজে লিপ্ত হওয়া স্পষ্ট কুফরী হিসেবে গণ্য। এখানে বাহ্যিক কাজটিই কুফরীর স্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে গণ্য ফলে উক্ত ব্যক্তিকে কাফির বলার ক্ষেত্রে তার অন্তরের অবস্থা বিবেচ্য নয়। উদাহরণস্বরুপ যদি কেউ তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলে আমি তোমাকে তালাক দিচ্ছি তবে তার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে ঐ ব্যক্তি আসলেই তালাক দেওয়ার উদ্দেশ্যে এটা বলেছে কিনা তা দেখা হবে না কারণ তালাক শব্দটি এ বিষয়ে স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। কিন্তু যদি সে বলে, আমি তোমাকে পরিত্যাগ করছি তবে ঐ ব্যক্তি তালাকের উদ্দেশ্যে এটা বলেছে না কি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে বলেছে তা তাকে প্রশ্ন করে জেনে নিতে হবে। যেহেতু “পরিত্যাগ  করা” স্পষ্টভাবে তালাকের অর্থ বহন করে না তাই এক্ষেত্রে বাহ্যিক শব্দের উপর বিধান দেওয়া যায় না বরং অন্তরের উদ্দেশ্যে বিবেচ্য বিষয় হয়।

ট্যাগ: কুফরী মনেকরে কোনো কাজে লিপ্ত হওয়া কুফরী মনেকরে কোনো কাজে লিপ্ত হওয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *