ইসলামে অজ্ঞতা দুর করা বা ইকামাতে হুজ্জা – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর
ইসলামে অজ্ঞতা দুর করা বা ইকামতে হুজ্জা শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর এর তাওহীদ আর রহমান গ্রন্থ হতে হুবহু সংকলন করা হয়েছে এই গ্রন্থটি গবেষণা মূলক গ্রন্থ। প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে আপনার বন্ধুদের নিকট শেয়ার করুন।
উপরে আমরা অজ্ঞতা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এ বিষয়ে ওলামায়ে কিরাম যা বলেছেন তার সারমর্ম হলো, যে বিষয়ে যে ধরনের ব্যক্তি অজ্ঞ থাকতে পারে ঐ বিষয়ে উক্ত ব্যক্তিকে ওযরপ্রাপ্ত বলে গণ্য করা হবে। যে বক্তি ইসলামের কোনো একটি বিধান অস্বীকার করে উক্ত ব্যক্তিকে কাফির বলার পূর্বে লক্ষ্য করতে হবে সে যে এলাকায় বসবাস করে যেখানে ঐ বিষয়টি সম্পর্কে যথেষ্ট প্রচার-প্রসার আছে কিনা বা উক্ত ব্যক্তি নও-মুসলিম হওয়ার কারণে এ বিষয়ে অজ্ঞ কিনা। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যেসব শর্তের উপর ভিত্তি করে অজ্ঞতা ওযর হিসেবে গণ্য হয় সেগুলো পরিবর্তনশীল। একজন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণের পর নও-মুসলিম হিসেবে গণ্য হয় একারণে তাকে ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধানের ব্যাপারে অজ্ঞ হিসেবে ধরে নিয়ে ছাড় দেওয়া হয় কিন্তু যখন তার উপর কিছুকাল অতিক্রান্ত হয় তখন এই অবস্থা পরিবর্তিত হয় এবং তার অজ্ঞতা দূরিভুত হয়। একইভাবে যে ব্যক্তি জ্ঞানের সংস্পর্শ থেকে বহু দূরে কোনো এলাকাতে বসবাস করে সে অজ্ঞতার কারণে ছাড় পায়। উক্ত ব্যক্তি যদি ইসলামী রাষ্ট্রের মুসলিমদের মাঝে বসবাস শুরু করে তবে কিছুকাল পরে তার অজ্ঞতা দূরিভুত হবে এবং তার ওযর শেষ হবে। ব্যাপক প্রচার-প্রসার না থাকার কারণে ইসলামের যেসব বিধানের ব্যাপারে অজ্ঞতা ওযর হিসেবে গণ্য হয় ঐ সকল বিধি-বিধান সম্পর্কে যদি ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রসার করা হয় তবে সে বিষয়ে অজ্ঞতা দূরিভুত হবে এবং ওযর শেষ হবে। এভাবে কোনো বিষয়ে কারো ওযর শেষ হওয়াকে বলা হয় ইকামাতে হুজ্জাত তথা হুজ্জাত কায়েম করা বা অজ্ঞতা দূর করা। কারো উপর হুজ্জাত কায়েম হওয়ার পর তাকে অজ্ঞতার কারণে ওযর প্রাপ্ত বলে গণ্য করা হয় না।
হুজ্জাত কায়েম করা তথা অজ্ঞতা দূরিভূত হওয়া সম্পর্কে বর্তমানে দুটি বিপরীতমুখী ভুলধারনা প্রচলিত আছে।
ক। কেউ কেউ মনে করে কোনো ব্যক্তিকে কাফির বলতে হলে তার সাথে সরাসরি আলোচনা করতে হবে। নানা-রকম যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে তার সকল প্রশ্নের অবসান ঘটাতে হবে যাতে করে তার অন্তরের মধ্যে উক্ত বিষয়ে কোনো সন্দেহ-সংশয় বা প্রশ্ন অবশিষ্ট না থাকে।
খ। একদল লোক মনে করে, কারো নিকট গমণ করে তাকে কিছু আয়াত ও হাদসি শুনিয়ে দিলেই তার উপর হুজ্জাত কায়েম হয়ে যায় এবং উক্ত বিষয়ে তার অজ্ঞতা দূর হয় ফলে অজ্ঞতার কারণে তাকে আর ওযরপ্রাপ্ত বলে গণ্য করা যায় না। তারা বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন ভ্রান্ত মতবাদ যেমন গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করে থাকে। এই সকল মতবাদের সাথে জড়িত সকল বিষয়ে জানে না তাই অজ্ঞতার কারণে তাদের ওযর দেওয়া উচিৎ তারা বলে, অমুক অমুকের নিকট আমরা দা’ওয়াত পৌছে দিয়েছি অতএব, তার ক্ষেত্রে কোনো ওযর নেই। এরা মনে করে, দু’একটি আয়াত বা হাদীস বর্ণনা করে কাউকে শুনিয়ে দিলেই হুজ্জাত কায়েম হয়ে যায় এবং ওযর শেষ হয়।
উপরে আমরা ওলামায়ে কিরামের যে মত বর্ণনা করেছি তা একই সাথে এই দুটি চিন্তাধারাকেই ভ্রান্তি প্রমাণ করে। যেহেতু তারা ইসলামের প্রশিদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত বিধি-বিধানসমূহ অস্বীকার করা বা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা কুফরী হিসেবে গণ্য করেছেন। এব্যাপারে আলেমদের মূলনীতি হলো, কোনো ব্যক্তি যে এলাকায় বসবাস করে সেখানে ইসলামের বিধান ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রসার পাওয়া এবং প্রশিদ্ধি অর্জন করার পর অজ্ঞতার ওযর আর প্রযোজ্য হবে না। উক্ত ব্যক্তি বুঝতে পেরেছে কিনা সেটা লক্ষ্য করা হবে না। এ সম্পর্কে তার অন্তরের যাবতীয় সন্দেহ-সংশয় দূর করে আল্লাহর বিধানকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরার নিমিত্তে বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করাও শর্ত নয়। সুতরাং যারা মনে করে কাফির বলার পূর্বে প্রতিটি মানুষের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে, তার মতামত শুনে সেটাকে সঠিক যুক্তি-প্রমাণের আলোকে খন্ডায়ন করতে হবে ইত্যাদি তাদের কথা সঠিক নয়। সঠিক মত হলো-উক্ত ব্যক্তির সাথে ব্যক্তিগত আলোচনার প্রয়োজন নেই বরং তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করতে হবে তার ক্ষেত্রে অজ্ঞতা ওযর হিসেবে গণ্য হতে পারে কিনা। একইভাবে যারা মনে করে কোনো একজন ব্যক্তিকে কয়েকটি আয়াত ও হাদীস শুনিয়ে দিলেই তার অজ্ঞতা দূর হয় তাদের মতও সঠিক নয়। যেহেতু ওলামায়ে কিরাম যে বিষয়টি অস্বীকার করা হচ্ছে সেটির ব্যাপক প্রচার-প্রসার থাকা শর্ত করেছেন। যে বিষয়টির ব্যাপক প্রচার-প্রসার নেই সেটা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ থাকলে বা সে বিষয়ে সমস্ত ওলামায়ে কিরামের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হলেও তা অস্বীকার করা কুফরী হিসেবে গণ্য হবে না। একইভাবে উক্ত বিষয়ে দু’একজন ব্যক্তি দলিল-প্রমাণ সহকারে আলোচনা করলেই তা যথেষ্ট হবে না যেহেতু এর মাধ্যমে বিষয়টির ব্যাপক প্রচার-প্রসার হয়েছে এমন বলা যায় না। একারণে ওলামায়ে কিরাম তাদের সময়কার বিদয়াতী ফিরকাসমূহকে কাফির বলেন না। অথচ তারা দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়কে অস্বীকার করতো। মু’তাজিলা ও কাদরিয়ারা তাকদীর অস্বীকার করতো। মুশাব্বিহারা আল্লাহকে সৃষ্টির গুনাবলীতে ভূষিত করতো। কিন্তু তারা যেসব বিষয় অস্বীকার করতো সেগুলোর ব্যাপক প্রচার প্রসার না থাকার কারণে আলেম-ওলামা ছাড়া অন্যান্য সাধারন মুসলিমরা সেসব বিষয়ে অবহিত ছিলনা। তাই তাদের কাফির বলা হয় নি। আলেমরা তাদের সাথে আলোচনা করতেন এবং বিভিন্ন যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে তাদের সামনে সত্যকে উপস্থাপণ করতেন। এরপরও তাদের কাফির বলতেন না। যদি কারো সামনে দলিল-প্রমাণ সহকারে সত্যকে উপস্থাপণ করার মাধ্যমে অজ্ঞতা দূর হতো তবে বিদয়াতী ফিরকাহ্ সমূহকে কাফির বলা হতো। মোট কথা, ওলামায়ে কিরামের নিকট হুজ্জাত কায়েম করা তথা অজ্ঞতার ওযর শেষ হওয়ার জন্য কাউকে বিস্তারিত আলোচনা ও তর্ক বিতর্কের মাধ্যমে কোনো বিষয় বুঝিয়ে দেওয়া শর্ত নয়। একইভাবে যথার্থ দলিল-প্রমাণ সহকারে দু’একজন ব্যক্তি কারো নিকট দা’ওয়াত পৌছিয়ে দিলেই তার মাধ্যমে অজ্ঞতার ওযর শেষ হয়ে যায় না। বরং এসকল ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়টির যথেষ্ট প্রচার-প্রসার আছে কিনা সেটাই বিবেচ্য বিষয়।
ইসলামে অজ্ঞতা দুর করা ইসলামে অজ্ঞতা দুর করা