আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে বিরক্তি – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনির
আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে বিরক্তি বা আল্লাহরদ্বীনেরসাথেসংশ্লিষ্টকোনোব্যাপারেবিরক্তি, অসন্তোষবাঅস্বীকৃতিপ্রকাশপায়এমনমন্তব্যবাআচরণকরা।- শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনির এর প্রবন্ধটি পড়া শেষে আপনার বন্ধুদের নিকট শেয়ার করুন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, এক আল্লাহর কথা স্মরণ করা হলে যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তাদের অন্তর সংকীর্ণ হয়ে যায়। (সুরা যুমার-৪৫)
তিনি আরো বলেন, আপনার রবের কসম তারা মুমিন হবে না যাতক্ষণ না তাদের মধ্যে যা কিছু বিবাদ ঘটে তার বিচার ভার আপনার উপর অর্পণ করে এবং আপনি যে বিচার করেন তা মেনে নিতে তদের অন্তরে সামান্যও দ্বিধা হয় না বরং পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সাথে মেনে নেয়। (সুরা নিসা-৬৫)
আল্লাহ্ ও তার রাসুলের সিদ্ধান্তের উপর বিরক্তি ও অসন্তোষ প্রকাশ পায় এমন কোনো উক্তি বা আচরণ করা কুফরী। মোল্লাহ্ আলী কারী শারহে ফিকহে আকবারে, ইমাম নাব্বী রাওদাতুত্ তালেবীন নামক কিতাবে, কাজী ইয়াদ আশ-শিফা নামক কিতাবে এবং অন্যান্য ওলামায়ে কিরাম নিজ নিজ গ্রন্থে এ বিষয়ক বহু উদাহরণ উপস্থাপন করেছেন। আমরা এখানে তার কিছু অংশ উল্লেখ করবো।
- শারহে ফিকহে আকবারে মোল্লাহ্ আলী কারী রঃ বলেন, যদি কেউ বিপদ-আপদে পতিত হয়ে বলে, হে আল্লাহ্ তুমি আমার সম্পদ কেড়ে নিয়েছো। তুমি আর কি করতে চাও! বা সে বলে, আর কি করার বাকী আছে বা এই প্রকৃতির কোনো কথা বলে। তবে সে কাফির হবে। যেহেতু সে আল্লাহর তাকদীরের উপর আপত্তি অভিযোগ উত্থাপণ করছে।
এর সাথে সাদৃশ্য রেখে বলা যায়, যদি কারো একমাত্র সন্তান মারা যায় আর কেউ বলে, গরীব মানুষের ছেলেটিই কি আল্লাহর চোখে পড়ল? অথবা বলে, আল্লাহর কি ইনসাফ নেই বা আন্দাজ নেই ইত্যাদি তবে সে তাকদিরের উপর আপত্তি করা ও আল্লাহর ব্যাপারে বেইনসাফীর অভিযোগ উত্থাপন করার কারণে কাফির হবে। একই কারণে যদি কেউ বলে, “আল্লাহ্ কাউকে রেখেছেন গাছ তলায় আর কাউকে রেখেছেন পাঁচতলায় এটা কেমন বিচার?” সে কাফির হবে।
- তিনি আরো বলেন, যদি কেউ মৃতপ্রায় মানুষের নিকট সূরা ইয়াসীন পাঠ করে আর অন্য একজন বলে, তুমি কি মরা মানুষকে সূরা ইয়াসীন গিলিয়ে খাওয়াচ্ছো? এই ব্যক্তি কাফির হবে কারণ সে সূরা ইয়াসীন পাঠ করার ব্যাপারে বিরক্তি প্রকাশ করছে।
- যদি কারো সামনে বলা হয় “লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ্” আর সে বলে এটা কি কাজে আসে? এর মাধ্যমে কি ক্ষুধা মেটে? বা এটা কি একটি রুটির কাজও করে? অথবা বলে, এর মাধ্যমে কি রুটি ভেজানো যায়? তবে সে কাফির হবে। অন্য যে কোনো যিকির বা দোয়ার ক্ষেত্রে এমন কথা বলাও কুফরী হবে। কারণ সে এই সকল দোয়া ও যিকিরের কার্য্কারিতা ও গুরুত্ব অস্বীকার করছে সেই সাথে এগুলো পাঠ করার ব্যাপারে বিরক্তি প্রকাশ করছে।
- যদি কেউ বলে, দিনে রাতে এত বেশি নামায পড়ে আমি ক্লান্ত হয়ে গেলাম। এত আমল কে করতে পারে! সে কাফির হবে কারণ সে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিধি-বিধানের উপর বিরক্তি প্রকাশ করছে। তাছাড়া সে মনে করেছে আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের উপর সাধ্যের বাইরে দায়িত্ব প্রদান করেছেন অথচ তিনি বলেছেন, “আল্লাহ্ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে দায়িত্ব অর্পণ করেন না।
- যে ব্যক্তি ইলমের মজলিস থেকে জ্ঞান অর্জন করে ফিরে আসে তাকে উদ্দেশ্য করে যদি কেউ বলে এই ব্যক্তি গীর্জা থেকে ফিরে আসলো বা মন্দির থেকে ফিরে আসলো তবে সে কাফির হবে কারণ সে ইলমের মজলিসকে গীর্জা বা মন্দিরের সাথে তুলনা করেছে। একইভাবে যদি কেউ ফতোয়ার গ্রন্থ অবজ্ঞাভরে ছুড়ে ফেলে তবে সে কাফির হবে। এ বিষয়ে তিনি (মোল্লাহ্ আলী কারী) একটি কাহিনী বর্ণনা করেছেন। একবার একজন বিজ্ঞ আলেম এক দোকানীর নিকট একটি ফতোয়ার গ্রন্থ রেখে চলে যান তখন উক্ত ব্যক্তি তাকে বলে, আপনি তো ভুলক্রমে আপনার করাতটি ফেলে যাচ্ছেন। উক্ত আলেম বলেন, তোমার কাছে তো আমি একটি কিতাব রেখেছি করাত নয়। সে বলে কাঠমিস্ত্রীরা যেভাবে করাত দিয়ে কাঠ কাটে আপনারাও তো একইভাবে এসব কিতাব দিয়ে মানুষের গলা কাটেন। পরে উক্ত ব্যক্তিকে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয় যেহেতু সে ফিকাহর কিতাব নিয়ে তামাশা করেছে। মোল্লাহ্ আলী কারী রঃ আরো বলেন, শুধু মাত্র শরীয়তের জ্ঞান সম্পর্কিত বইয়ের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য মানবিক (যুক্তি বিদ্যা) বা অন্যান্য জ্ঞান সম্পর্কিত বইয়ের ব্যাপারে এটা প্রযোজ্য হবে না। যেহেতু তার মধ্যে এমন বিষয় রয়েছে যা আসলেই তিরস্কারের যোগ্য।
- যার নিকট শরীয়তের কোনো বিষয় উল্লেখ করা হলে নাক শিটকায় বা আচার-আচরণে বিরক্তির ভাব প্রকাশ করে তবে সে কাফির হবে।
- কাজী ইয়াদ রঃ বর্ণনা করেন, ইবনে আখি আজাব নামে একজন ব্যক্তি রাস্তায় বের হলে বৃষ্টি শুরু হয়। সে বিরক্ত হয়ে বলে, “চামড়া সেলাইকারী এখন চামড়া ভিজাতে শুরু করেছে” একারণে কার্ডোভার ফুকাহায়ে কিরাম তাকে হত্যা করার ফতোয়া দেন। পরে তাকে হত্যা করা হয় এবং তার ব্যাপারে নিরাবতা অবলম্বনের কারণে কাজিকে বহিস্কার করা হয়। (আশ-শিফা)
- তিনি অন্য আরেকজন ব্যক্তির কাহিনী বর্ণনা করেছেন যে নিজেকে পন্ডিত মনে করতো। সে একদিন আলোচনা প্রসঙ্গে অবজ্ঞার ছলে রসুলুল্লাহ সাঃ কে আব্দুল্লাহর ইয়াতীম, হায়দারার (আলী রাঃ এর) শশুর . ইত্যাদি নামে সম্মোধন করেছিল। স্পেনের ওলামায়ে কিরাম তাকে হত্যা করার ফতোয়া জারী করেন। (আশ-শিফা)
- ইবনে হাযার হাইতামী রঃ আল-ই’লাম বিকওয়াতিইল ইসলাম নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেন, একজন ব্যক্তি ঝগড়ার সময় অন্য আরেক জনকে বলে “আমি তোমার শত্রু এবং তোমার নবীর শত্রু” আলেমরা তাকে কাফির হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তারা কেউ কেউ বলেন, সে সাধারন মুরতাদ ফলে তাকে তওবা করার সুযোগ দেওয়া হবে আর অন্যরা বলেন তাকে তওবা করার সুযোগ দেওয়া হবে না যেহেতু সে রাসুলুল্লাহ সাঃ কে গালি দিয়েছে।
- হানাফী মাযহাবের বিভিন্ন ফতোয়া গ্রন্থে ইমাম আবু ইউসুফ রঃ সম্পর্কে বর্ণিত আছে তিনি কাজির পদে থাকা কালীন একবার মজলিসের মধ্যে, রসুলুল্লাহ সাঃ লাউ পছন্দ করতেন। একজন লোক তখনই বলে ওঠে “আমি লাউ পছন্দ করি না”। তার কথা শুনে আবু ইউসুফ বলেন, “আমাকে তরবারী ও বর্ষা দাও”।
মোল্লাহ্ আলী কারী আল-হানাফী রঃ শারহে ফিকহে আকবারের মধ্যে এ কাহিনী বর্ণনা করেছেন এবং এর ব্যাখ্যায় বলেছেন রসুলুল্লাহ সাঃ এর পছন্দ ও অপছন্দের বিষয় বর্ণিত হওয়ার পরপরই সেটার বিপরীতে নিজের মতামত বর্ণনা করার মাধ্যমে মূলত রসুলুল্লাহ সাঃ এর পছন্দের বিষয়ের উপর আপত্তি উত্থাপন করা হয় তাই এটা কুফরী হিসেবে গণ্য হয়েছে।
অর্থাৎ সাধারন ভাবে লাউ খেতে অপছন্দ করা কুফরী নয় কিন্তু এই ঘটনায় রসুলুল্লাহ সাঃ এর হাদীস বর্ণিত হওয়ার পরপরই সেটার বিপরীতে মত ব্যক্ত করা হয়েছে ফলে এটা রাসুলুল্লাহ সাঃ এর শানে বেয়াদবী হিসেবে গণ্য হয়েছে একারণে তা কুফরী।
- মোল্লাহ্ আলী কারী রঃ শারহে ফিকহে আকবারে এবং ইবনে হাজার হাইতামী কওয়াতিউল ইসলাম নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, যে কেউ পবিত্র কুরআনের উপর পা রাখে (নাউযু বিল্লাহ্) সে কাফির।
- তারা আরো বলেন, যদি কেউ কাউকে কুরআন তেলওয়াত করতে শুনে তা নিয়ে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করে (যেমন বলে, ভেড়ার ডাক) সে কাফির হবে। মোল্লাহ্ আলী কারী রঃ বিষয়টি বিশ্লেষণ করে বলেন, যদি কুরআনের আয়াতের ব্যাপারে এরুপ মন্তব্য করে তবে সে কাফির হবে কিন্তু যদি যে তেলওয়াত করছে তার কণ্ঠ কর্কষ হওয়ার কারণে উক্ত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে এ কথা বলা হয় তবে তা কুফরী হবে না। মুয়াজ্জিনের আজান শুনে বিদ্রুপ করার ব্যাপারেও অনুরুপ কথা প্রযোজ্য।
- কুরআনকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া, ময়লা আবর্জনা বা নাপাকী বস্তুর সংস্পর্শে রাখা ইত্যাদি অবমাননাকর কাজ স্পষ্ট কুফরী। রোগ মুক্তির জন্য প্রসাব বা অন্য কোনো নিকৃষ্ট পদার্থ দ্বারা পবিত্র কুরআনের আয়াত লেখা স্পষ্ট কুফরী যা অনেক সময় জাদুকর বা কবিরাজরা করে থাকে।
উপরের আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, আল্লাহ, রসুল ও ফেরেশতা ইত্যাদি দ্বীন সম্পর্কিত যে কোনো বিষয়ে যে কোনো প্রকার মন্দ বাক্য প্রয়োগ করা কুফরী। এ বিষয়ে উম্মতে মুসলিমার ওলামায়ে কিরামের মাঝে কোনো দ্বিমত নেই। রাসুলুল্লাহ সাঃ কে গালি দেওয়ার বিধান ও পরিনাম সম্পর্কে ইমাম ইবনে তাইমিয়া আস-সারিম আল-মাসলুল আলা শা-তিমির্ রসুল নামে পৃথক একটি বই রচনা করেছেন যার অর্থ রাসুলুল্লাহ্ সাঃ কে যে ব্যক্তি গালি দেয় তার বিরুদ্ধে খোলা তলোয়ার। মালেকী মাজহাবের প্রখ্যাত ফকীহ্ কাজি ইয়াদও এ বিষয়ে পৃথক একটি বই রচনা করেছেন। তিনি এর নাম দিয়েছেন, আশ-শিফা ফি তা’রীফি হুককিল মুস্তাফা অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত করা। এসব গ্রন্থে এ বিষয়টির ভয়াবহতা সম্পর্কে সুবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। যেহেতু এ বিষয়টি সুস্পষ্ট ও সর্বজন বিদিত তাই বর্তমান গ্রন্থে আমরা এ বিষয়ে পৃথক শিরোনামে আলোচনা করবো। এক. সাহাবায়ে কিরামকে গাল-মন্দ করা এবং দুই কোনো মুসলিমকে কাফির বলে সম্মোধন করা। পরবর্তী পোষ্টে আমরা এই দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনার করবো। ইনশাআল্লাহ্।
আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে বিরক্তি আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে বিরক্তি