শাবানের মধ্যরাতে আলেমদের কর্মপন্থা – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর
শাবানের মধ্যরাতে আলেমদের কর্মপন্থা – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর এর লায়লাতুল বারায়াত গ্রন্থ হতে হুবহু তুলে ধরা হয়েছে এছাড়ও শায়েখের বিভিন্ন গ্রন্থর জন্য আমাদের সাইটে ভিজিট করুন
ইমাম শাফেঈর মত আমরা পূর্বেই দেখেছি “আমি জানতে পেরেছি পাঁচটি রজনীতে দোয়া কবুল করা হয় জুমআর রাত, ইদুল আদহার রাত, ইদুল ফিতরের রাত, রজব মাসের প্রথম রাত ও শাবান মাসের মাঝ রাত।(আল উম)
ইবনে রজব আল হাম্বালী এ বিষয়ে বিভিন্ন আলেমদের মত বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,
শামের কিছু তাবেঈ যেমন ইবনে মা’দান, মাকহুল, লুকমান ইবনে আমর, এবং অন্যান্যরা এই রাতটিকে মর্যাদা দিতেন এবং এরাতে ইবাদতে মনোনিবেশ করতেন। তাদের নিকট হতেই পরে সাধারন মানুষ এই দিবসটি ফজীলতপূর্ণ ও সম্মানীত হওয়ার বিষয়টি গ্রহণ করে। বলা হয়ে থাকে যে, তাদের নিকট এ বিষয়ে কিছু ইসরাঈলী রেওয়ায়েত পৌছেছিল। যখন এই দিবসে তাদের কর্মনীতি জনসাধারনের নিকট প্রসিদ্ধ হয়ে পড়ে তখন বিভিন্ন এলাকার লোকেরা এ বিষয়ে মতপার্থক্যে লিপ্ত হয়ে পড়ে তাদের মধ্যে একদল যথা বসরার ইবাদতকারীরা এটাকে গ্রহণ করে আর হিজাজের বেশিরভাগ আলেম এটাকে অপছন্দ করেছেন যেমন আতা, ইবনে মুলাইকা আব্দুর রহমান ইবনে যাইদ মদীনার ফকীদের নিকট হতে এই মত উল্লেখ করেছেন। ইমাম মালিকের অনুসারী ও অন্যান্য আলেমদের মত এটাই। তারা বলেছেন এসব বিদআত।
এরপর তিনি ইমাম শাফেঈর পাঁচটি রাতের মর্যাদা সংক্রান্ত কথাটি বর্ণনা করেন যা আমারা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। এরপর এবিষয়ে ইমাম আহমদের মত উল্লেখ প্রসঙ্গে বলেন,
শাবান মাসের মাঝ রাত সম্পর্কে ইমাম আহমদের কোনো মত পাওয়া যায় না তবে এই রাতে সলাত আদায় করা মুস্তাহাব হওয়ার পক্ষে ঈদের রাত সম্পর্কে তার দুটি রেওয়ায়েত হতে মত বের করা যেতে পারে। এক রেওয়ায়েতে তিনি ঈদের রাতে জামাতের সাথে সালাত আদায় করা মুস্তাহাব মনে করেননি কারণ আল্লাহর রসুল রাঃ ও তার সাহাবাদের নিকট হতে তা বর্ণিত নেই। অন্য রেওয়ায়েতে তিনি ঈদের রাতে জামাতের সাথে সলাত আদায় করা মুস্তাহাব মনে করেছেন কারণ আব্দুর রহমান ইবনে ইয়াযীদ হতে এটা করার কথা বর্ণিত আছে আর তিনি একজন তাবেঈ। শাবান মাসের রাতে সলাত আদায় করা সম্পর্কেও একই কথা। রসুলুল্লাহ সাঃ ও সাহাবাগণ হতে এ বিষয়ে সহীহ কিছু বর্ণিত হয়নি কিন্তু একদল তাবেঈ হতে তা বর্ণিত আছে যারা শামের উচ্চস্তরের ফকীহ ছিলেন। (লাতাইফুল মাআরিফ)
ইবনে রজবের এই বিশ্লেষণ থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন শুধু মাত্র কিছু বিশিষ্ট তাবেঈ কোনো কাজ করেছেন এই বিষয়টি উক্ত কাজ করার পক্ষে দলীল হতে পারে। অনেকে মনে করেন যেসব হাদীস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তার ভিতর কিছু পাওয়া না গেলে তা নিশ্চিত বিদআত বলে গণ্য হয়। আলেমদের নিকট কিন্তু বিষয়টি এমন নয় বরং সাহাবা ও তাদের পরবর্তী গ্রহণযোগ্য ইমামদের আমলের মাধ্যমেও কোনো কাজ প্রমাণিত হতে পারে যেহেতু তাদের ব্যাপারে আমাদের আস্থা এই যে, তারা জেনে বুঝে ছাড়া কোনো আমল করেন না এবং এমনটি হতেই পারে যে, তারা কোনো হাদীসের কারণে কোনো আমল করেছেন কিন্তু তা আমাদের নিকট পৌছায়নি। সে কারণে যেসব বিষয়ে পক্ষে বিপক্ষে শরীয়তের কোনো নির্দেশ পাওয়া যায় না সেসব বিষয়ে তাদের আমলকে গ্রহণযোগ্য মনে করা যেতে পারে। ইমাম মালিক তো মাদীনা বাসীর আমলকে এতটাই শক্ত মনে করতেন যে তার বিপরীতে হাদীস বর্ণিত হলে অনেক সময় হাদীসকে দূর্বল বলতেন। তার কথা ছিল কোনো কিছু রসুলুল্লাহ সাঃ করবেন অথচ মদীনাবাসী জানবে না তা হতে পারে না। এটা গেলো শবেবরাতের পক্ষে কোনো সহীহ হাদীস না পাওয়া গেলে কিন্তু আমরা পূর্বে দেখেছি যে এ বিষয়ে সহীহ হাদীস রয়েছে এবং বিষয়টি হকপন্থী আলেমদের নিকট প্রমাণিত হয়েছে এর পরও একে বিদআত বলে আক্ষায়িত করার কি কারণ থাকতে পারে?]
ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন,
আমাদের মাযহাবের বা অন্যান্য মাযহাবের বহুসংখক বরং বেশিরভাগ আলেমের মত হলো এই রাতের ফজীলত রয়েছে। ইমাম আহমদের স্পষ্ট মাধ্যমে এটাই প্রমানিত হয়। (ইক্তিদাউস-সিরাত আল মুস্তাকীম)
শাবান মাসের মাঝ রাতে সলাত পড়া সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন,
যদি কেউ শাবান মাসের মাঝ রাতে একাকি সলাত আদায় করে বা ব্যক্তিগত জামাতে সলাত আদায় করে যেমনটি একদল সালাফ করতেন তবে তা খুবই সুন্দর। আর যদি কেউ নির্দিষ্ট সংখক যেমন ১০০ রাকাত সলাত ১০০০ বার “কুল হুয়াল্লাহু আহাদ” পড়ে আদায় করার জন্য মসজিদে একত্রিত হয় তবে এটা বিদআত হবে কোনো ইমাম এটা পছন্দ করেননি।
পরে তিনি আরো বলেন,
আর শাবান মাসের মাঝ রাতের ফজিলত সম্পর্কে বহু সংখক হাদীস ও আছার বর্ণিত আছে এবং একদল সালাফ হতে এমন বর্ণনা আছে যে, তারা এই রাতে সলাত আদায় করতেন। অতএব যদি কোনো ব্যক্তি একা একা সলাত আদায় করে তবে তার পক্ষে একদল সালাফকে পাওয়া যাবে এবং তার পক্ষে দলীলও রয়েছে সুতরাং এমন বিষয়কে অপছন্দ করা যেতে পারে না। (মাজমুআয়ে ফাতাওয়া)
পরবর্তীতে তিনি উক্ত রাতে জামাতের সাথে সলাত আদায় সম্পর্কে লম্বা আলোচনা করেছেন। যেখানে তিনি সাধারন নফল সলাতসমূহ মসজিদে একত্রিত হয়ে নিয়মিত আদায় করা অপছন্দ করেছেন তবে কখনও কখনও তা করা যায় বলে মন্তব্য করেছেন। ইবনে রজব এ প্রসঙ্গে বলেন, শামের আলেমরা মতপার্থক্য করেছেন যে, এই রাতে ইবাদত কিভাবে সম্পন্ন করা হবে। প্রথমত কেউ কেউ বলেছেন এই রাতে মসজিদে গমন করত জামাতে সলাত আদায় করা মুস্তাহাব। খালিদ ইবনে মা’দান, লুকমান ইবনে আমির এবং অন্যান্যরা এই রাতে উত্তম পোশাক পরিধান করতেন, সুগন্ধি ও সুরমা মাখতেন এবং মসজিদে সারারাত সলাত আদয় করতেন। ইসহাক ইবনে রাহওয়াই এ ব্যাপারে তাদের সাথে একমত হয়েছেন এবং এরাতে মসজিদে জামাতে সলাত আদায় করা বিদআত নয় বলে মত দিয়েছেন। তার এ মত হারব আল কিরমানী তার মাসায়েল এ বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় মত হলো এই রাতে সলাত গল্প গুজব দুয়া যিকির ইত্যাদির উদ্দেশ্যে মসজিদে একত্রিত হওয়া অপছন্দনীয় তবে যদি কেউ ব্যাক্তিগতভাবে সলাত আদায় করে তবে তা অপছন্দনীয় নয়। এটি শামের ইমাম ও ফকীহ আওজাঈর মত আর এটিই বেশি সঠিক। (লাতাইফ আল মাআরিফ)
তিনি এরাতে জামাতে সলাত আদায় করা এবং ব্যক্তিগতভাবে সলাত আদায় করার ব্যাপারে আলেমদের দুটি মত বর্ণনা করেছেন। কেউ জামাতে পরা উত্তম মনে করেছেন আর কেউ তা অপছন্দ করেছেন ইমাম ইবনে তাইমিয়া জামাতে পড়া বৈধ মনে করেছেন যদি এটাকে নিয়মিত নিয়ম বানিয়ে না ফেলা হয়। কিন্তু যদি কেউ শবে বরাতের রাতে মসজিদে গমন করে একাকী সলাত পড়ে যেমনটি আমাদের দেশে করা হয় তবে এ বিষয়ে কেউ আপত্তি করেছেন বলে জানি না। তাছাড়া যদি সলাত পড়া বৈধ হয় তবে বাড়িতে বা মসজিদে যে কোনো স্থানেই তা বৈধ হবে। এটাই শরীয়তের সাধারন নিয়ম। তবে রসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
ফরজ ব্যাতীত যে কোনো সলাত বাড়িতে পড়াই উত্তম। (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম) এ হাদীস প্রমান করে যে ফরজ সলাত ছাড়া অন্যান্য সলাত বাড়িতে পড়াই উত্তম। কিন্তু সাহাবা এ কিরাম মসজিদেও নফল আদায় করতেন যা নফল সলাত মসজিদে আদায় করা বৈধ হওয়া প্রমান করে। যদি শাবান মাসের মাঝ রাতে সলাত আদায় করা বৈধ হয় তবে বাড়ি বা মসজিদ যে কোনো স্থানেই তা বৈধ হবে এটাই স্বাভাবিক। আর আল্লাহই ভাল জানেন।
শাবানের মধ্যরাতে আলেমদের কর্মপন্থা শাবানের মধ্যরাতে আলেমদের কর্মপন্থা