মীলাদ কিয়ামের বিধান – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মূনীর গবেষণা মূলক প্রবন্ধ
মীলাদ কিয়ামের বিধান – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মূনীর গবেষণা মূলক প্রবন্ধ। মীলাদ কিয়ামের বিধান প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।
আমাদের দেশ এবং উপমহাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে একটি রেওয়াজ প্রচলিত আছে। কোনো সুখের বা শোকের ঘটনা ঘটলে কিছু নেককার ব্যক্তিদের দাওয়াত করা হয়। সকলে একত্রিত হয়ে দোয়া-দরুদ পাঠ করে দ্বীনী আলোচনা করে, যিকির-আযকার করে ইত্যাদি। সব শেষে আয়োজক উপস্থিত সবাইকে নিজের সাধ্য অনুযায়ী কিছু খাবার খাওয়ায় এভাবে অনুষ্ঠান শেষ হয়। এধরণের অনুষ্ঠানকে মীলাদ মাহফিল বলা হয়। বর্তমানে কেউ কেউ এটাকে দোয়ার মাহফিলও বলে থাকেন। এক সময় এধরণের দোয়ার অনুষ্ঠানে বহু নিষিদ্ধ কর্মের প্রচলন ছিল যেমন, দরুদ পাঠ করার সময় রাসুলুল্লাহ সাঃ হাজির হয়ে যান এমন মনে করে মানুষ দাড়িয়ে যেতো, রাসুলুল্লাহ সাঃ এর ব্যাপারে অতিরঞ্জন করে উর্দু ও ফার্সী কবিতা পাঠ করা হতো ইত্যাদি। আল্লাহর ইচ্ছায় বর্তমানে বেশিরভাগ এলাকায় এসব অপ্রীতিকর বিষয়ের অবসান ঘটেছে। এখন মানুষ সম্পূর্ণ বৈধ পন্থায় এধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। সব জায়গায় একই পদ্ধতিতে আদায় করা হয় তা নয়। কোথাও রাসুলের জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা করা হয় এবং শেষে দোয়া হয়, কোথাও কেবল দরুদ পাঠ করার পর মোনাজাত করা হয়, আবার কোথাও কিছু না করে কেবল দোয়া করে দেওয়া হয়। যখন মীলাদের মধ্যে নিষিদ্ধ কর্মকান্ডের প্রচলন ছিল তখন আলেমরা ঐ সকল কর্মের নিন্দা করেছেন। তারা মূল বিষয়টির নিন্দা করতেন না বরং এর মধ্যে যেসব নিষিদ্ধ কর্ম-কান্ডগুলো পরিত্যাগ করেছে। কিন্তু এখন কিছু লোক মীলাদ নাম বিষয়টিকে গোড়া শুদ্ধ উপড়ে ফেলার জন্য হৈ চৈ শুরু করেছে। তাদের কথা হলো এই ভাবে একত্রিত হয়ে দোয়া-দরুদ পাঠ করা এবং শেষে তবারোক গ্রহণ করার পদ্ধতি স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাঃ বা তার সাহাবায়ে কিরাম চালু করেন নি তাই এটা বিদয়াত। এই যুক্তিটি পূর্বে খন্ডায়ন করা হয়েছে। আমরা বলেছি কেবল রাসুলুল্লাহ সাঃ করেন নি বা সাহাবয়ে কিরাম করেন নি এই যুক্তিতে কোনো কিছু নিষিদ্ধ প্রমাণিত হবে না বরং দেখতে হবে তাতে কোনো নিষিদ্ধ কাজ করা হয় কিনা। এই মূলনীতিতে বিচার করলে বর্তমানে যে মীলাদ মাহফিল প্রচলিত আছে সেগুলো বৈধ প্রমাণিত হয়। যেহেতু তার মধ্যে নিষিদ্ধ কিছু নেই। আর যদি দেখা যায় কোনো এলাকাতে প্রচলিত মীলাদের মধ্যে নিষিদ্ধ কর্ম-কান্ড রয়েছে তবে উক্ত নিষিদ্ধ কর্ম-কান্ডের নিন্দা করতে হবে মীলাদকে গোড়া শুদ্ধ উপড়ে ফেলার প্রয়োজন নেই। মীলাদের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় নিয়ে বর্তমানে সমালোচনার ঝড় উঠেছে আমরা নিচে সেসব বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরছি।
ক. মীলাদে অনেক সময় “বালাগাল উলা বিকামালিহি…” পাঠ করা হয়। বর্তমানে আহলে হাদীসগণ এবং তাদের মতাদর্শে প্রভাবিত কিছু আলেম-ওলামা এই কবিতাটিকে শিরকী কবিতা হিসেবে চিহিৃত করে থাকে। তারা বলে “বালাগাল উলা বিকামালিহি” এর অর্থ “রাসুলুল্লাহ সাঃ নিজ যোগ্যতার বলে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেছেন।” একারণে এটা একটি শিরকী বাক্য। এই সকল লোকেরা বিপরীতমুখি রোগে আক্রান্ত। একদিকে যেমন তাদের জ্ঞান-গরিমা কম ও গবেষণা শক্তি দূর্বল বিপরীত দিকে কোনো ব্যক্তি বা বিষয় সম্পর্কে মন্তব্য করার ব্যাপারে তাদের সাহস অতিরিক্ত বেশি। আমি একটা বিষয় ভেবে পায় না যে এই বাক্যটির ভিরতে যোগ্যতা কথাটি কোথা থেকে আসল। আরবী ভাষা সম্পর্কে যৎসামান্য জ্ঞান রাখে এমন যে কারও নিকট স্পষ্ট যে এখানে ব্যবহৃত কামাল শব্দটির অর্থ হচ্ছে পরিপূর্ণতা। লিসানুল আরবে বলা হয়েছে, কামাল অর্থ হলো পরিপূর্ণতা। তাজুল উরুসে বলা হয়েছে, কামাল অর্থ হলো তামাম (পরিপূর্ণতা) এ দুটি পরস্পর সমার্থবোধক শব্দ। সিহাহ ও অন্যান্য গ্রন্থে এমনটিই বলা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো রাসুলুল্লাহ সাঃ কি পরিপূর্ণতার দিক থেকে সর্বোচ্চ স্থানে অধিকারী ছিলেন না? স্বয়ং রব্বুল আলামীন বলেন,
হে নবী নিঃসন্দেহে আপনি সর্বোত্তম চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত আছেন। (কলাম-৪)
রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন
আমাকে পাঠানো হয়েছে উত্তম চরিত্রকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার জন্য।
হাকিম মুস্তাদরাকে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন হাদিসটি বুখারী ও মুসলিমের শর্তে সহীহ, ইমাম জাহাবীও তার সাথে ঐক্যমত পোষণ করেছেন, শায়েখ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, সহীহা-৪৫।
কবি নিজেও এই অর্থে রাসুলুল্লাহ সাঃ পরিপূর্ণতার সর্বোচ্চ স্তরে আছেন বলে মন্তব্য করেছেন। তাইতো পরবর্তীতে তিনি বলেন, “তার সকল স্বাভাব-চরিত্র অতীব সুন্দর” সুতরাং এই কবিতাটিতে যা বলা হয়েছে সেটি পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীস হতে চয়ন করা হয়েছে আর নির্বোধরা এটার বিপক্ষে প্রচারে লিপ্ত হয়ে গেছে।
আমার বিশ্বাস, আরবী ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞ কিন্তু উর্দূ ভাষায় দক্ষ কোনো ব্যক্তি এ বিষয়ে প্রথম জটিলতা সৃষ্টি করেছে। যেহেতু উর্দূ ভাষায় কামাল শ্বদটি দক্ষতা, যোগ্যতা, কারামতি ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। বলা হয়, “তোমহারা কামাল দেখাও” অর্থাৎ তোমার কামাল (দক্ষতা, যোগ্যতা, কারামতী, তেলেসমাতী ইত্যাদি) প্রদর্শন করো।
নামক উর্দূ ডিকশোনারীতে কামাল শব্দের অর্থ সম্পর্ক বলা হয়েছে, সম্পূর্ণ হওয়া, তেলেসমাতি বা কারামতি, যোগ্যতা, বিস্ময়কর কাজ, উস্তাদী তথা কর্মদক্ষতা ইত্যাদি।
সেখানে আরও বলা হয়েছে, “কামাল দেখানো” এর অর্থ হলো, তেলেসমাতি ও দক্ষতা প্রদর্শন করা এবং কারামাতী দেখানো।
পাঠক চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন যারা “বালাগাল উলা বিকামালিহি” এর অর্থ করেন, নিজ যোগ্যতায় সর্বোচ্ছ মাকামে পৌঁছে যাওয়া তারা বুঝে হোক, না বুঝে হোক আসলে উর্দু অভিধান হতে অর্থটি গ্রহন করেছেন, আরবী অভিধান হতে নয়। আর বলাই বাহুল্য যে, একটি আরবী কবিতা উর্দু অভিধানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছু নয়।
এই হচ্ছে এদের ভাষাজ্ঞান! আর শরীয়তের মুলনীতি সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা আরো বেশি মারাত্নক। ওলামায়ে কিরামের নিকট স্বীকৃত মূলনীতি হলো, কোনো একটি কথা যখন একাধিক অর্থ বহন করে যার একটি অর্থ কুফরী আর অন্য অর্থটি উত্তম তখন মুসলিমের উপর সুধারনা করতে হবে এবং উত্তম অর্থটি গ্রহণ করতে হবে।
বাহরুর রায়েকে বলা হয়েছে,
যদি দেখা যায় কোনো একটি বিষয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে কুফরী প্রমাণিত হচ্ছে কিন্তু একটি দৃষ্টিকোন থেকে কুফরী প্রমাণিত হচ্ছে না তবে মুফতীর উচিৎ যে দৃষ্টিকোন থেকে কুফরী প্রমাণিত হচ্ছে না সেটি গ্রহণ করা। এভাবে মুসলিমের প্রতি সুধারণা বজায় রাখতে হবে।
অন্যান্য ওলামায়ে কিরামও অনুরুপ কথা বলেছেন। অথচ এই সকল হতভাগারা কল্পিত অর্থের উপর নির্ভর করে উপমহাদেশের হাজার হাজার আলেম-ওলামা ও সাধারন মানুষ শিরকে লিপ্ত আছে এমন মন্তব্য করছে যেহেতু তারা বালাগাল উলা পাঠ করে।
এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তারা “কামাল” শব্দের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পরিত্যাগ করে এখন বালাগা শব্দের পিছনে লেগেছে। তাদের যুক্তি হলো বালাগা ফিলে লাযিম যার অর্থ পৌছে যাওয়া। এখানে বলা উচিৎ ছিল আল্লাহ তার রাসুলকে পরিপূর্ণতার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন, রাসুল সাঃ পরিপূর্ণতার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে গেছেন এভাবে বলা সঠিক নয়। অন্য লোকের ছিদ্রান্বেষণে যে ব্যাক্তি ব্যস্ত থাকে তার বৃদ্ধি যে কি পরিমাণ লোপ পায় তা এই সকল নির্বোধদের কার্যকলাপ না দেখলে কখনও অনুধাবন করা সম্ভব নয়। যখন একজন মুসলিম বলে, আমি বাড়ি পৌছে গেছি। এটা কি শিরক হবে? এর অর্থ কি এটাই বুঝতে হবে যে, সে বলতে চাচ্ছে আমি নিজ যোগ্যতা ও সক্ষমতায় বাড়ি পৌছে গেছি এখানে আল্লাহর কোনো ভূমিকা নেই? (নাউযু বিল্লাহ) সব সময় কি এমন বলতে হবে যে, আল্লাহ আমাকে পৌছে দিয়েছেন, আজ সকালে ভাত খেয়েছে এমন না বলে বলতে হবে আল্লাহ আমাকে খাওয়ালেন? এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে আমি করেছি, আমি বলেছি, আমি গিয়েছি এগুলো বাদ দিয়ে বলতে হবে আল্লাহ আমাকে দিয়ে করিয়েছেন, আল্লাহ আমাকে দিয়ে বলিয়েছেন ইত্যাদি। এর আন্যথা হলে কি ঈমান নষ্ট হবে? এ ধরণের চিন্তাধারা সুস্পষ্ট ভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতা ছাড়া কিছু নয়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
হে নবী নিঃসন্দেহে আপনি সর্বোত্তম চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত আছেন। (কলাম-৪)
এখানে তিনি কেনো বললেন না, হে নবী আমি আপনাকে সর্বোত্তম চরিত্রের উপর পতিষ্ঠিত করেছি? রাসুল সাঃ সর্বোত্তম চরিত্রের উপর আছেন এর অর্থ যে আল্লাহই তাকে এর উপর রেখেছেন এটা কি না বললে বোঝা যায় না?
মহান আল্লাহ এই সকল নির্বোধদের চক্রান্ত থেকে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করুন।
খ। মীলাদে দরুদে ইব্রাহীমীর পরিবর্তে সুর করে আল্লাহুম্মা সাল্লী আলা মাওলানা মুহাম্মদ…. বা ইয়া নাবী সালামু আলাইকা……. ইত্যাদি দরুদ পাঠ করা হয়। সুর করে কোনো কিছু পাঠ করা সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি সুন্দর কথা সুন্দর কন্ঠে পাঠ করা দোষণীয় নয়। আর দরুদে ইব্রাহীমী ছাড়া ভিন্ন কোনো দরুদ পাঠ করার ব্যাপারে কথা হলো, মুসলিম উম্মাহর সকল ওলামায়ে কিরাম একমত যে, সলাতের ভিতরে ছাড়া অন্যান্য সময় দরুদে ইব্রাহীমীর পরিবর্তে ছোট যে কোনো দরুদ পাঠ করাতে সমস্যা নেই। রাসুলুল্লাহ সাঃ এর নাম শুনেই আমরা বলি, সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম বা এই জাতীয় যে কোনো শব্দ, যার মধ্যে সলাত ও সালাম কথার উল্লেখ থাকে। যারা মীলাদে দরুদে ইব্রাহীমীর পরিবর্তে ভিন্ন কোনো দরুদ পাঠ করার নিন্দ করে তারাও জুময়ার খুতবা বা অন্য কোনো উপলক্ষে এসব ছোট দরুদ পাঠ করে থাকে। আমাদের ওলামায়ে কিরাম যখন কোনো প্রন্থ প্রণয়ন করেন তথন শুরুতে বিভিন্ন শব্দ যোগ করে আল্লাহর প্রশংসা ও রাসুলের উপর দরুদ পেশ করেন। যারা অবগত নয় তারা যে কোনো বরেণ্য আলেমের আরবী ভূমিকা লক্ষ্য করলে এ বিষয়ে ধারনা পেয়ে যাবেন। সুতরাং দরুদে ইব্রাহীমীর পরিবর্তে ভিন্ন কোনো দরুদ পাঠ করার বিষয়টিকে নিন্দা করার কোনো কারণ নেই। যদি কেউ সলাতের মধ্যে এমনটি করে তবে তাকে বাধা দিতে হবে কিন্তু সলাতের বাইরে যে কোনো অনুষ্ঠান বা অবস্থানে যে কোনো দরুদ পাঠ করাতে নিষেধ নেই যদি তাতে নিষিদ্ধ কোনো বিষয়ের উল্লেখ না থাকে।
গ। কেউ কেউ বলে “ইয়া নাবী সালামু আলাইকা” বলা যাবে না কারণ এখানে নাবী শব্দটি নাকেরা করা হয়েছে। ইয়া নবী না বলে বলতে হবে আয়্যুহান্নাবী। তা না হলে রাসুলকে অবমাননা করা হয়। তাদের প্রশ্ন করি যখন আমরা বলি ইয়া রাহমানু ইয়া রাহীমু তখন কি আল্লাহকে অপমান করা হয়? আয়্যুহার রাহমান বা আয়্যুহার রহীম এভাবে না বললেই কি নয়? প্রশ্ন হলো বিরোধী পক্ষের পিছনে আদাজল খেয়ে লাগার কি কোনো প্রয়োজন আছে। যার সাথে আমার বিবাদ আছে তার ভাল-মন্দ সব কিছুকে অস্বীকার করাই কি ন্যায়পরায়নতা?
কেউ কেউ আবার “ইয়া নবী সালামু আলাইকা” এর মধ্যে সালাম শব্দটি কেনো নাকেরা হলো সেই প্রশ্ন তুলতে পারে তাদের উত্তরে আমরা বলবো আল্লাহ বলেছেন, “রাসুলদের উপর সালাম” (সুরা সাফফাত-১৮১) এখানে সালামকে নাকেরা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নবী এবং নেককার ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য এভাবে সালাম শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। অতএব, এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা অকারণ।
অনেকে বলেন, হাদীসে এসেছে, “সালাম হবে কালাম তথা কথার আগে” (তিরমিযি)।
সুতরাং, “ইয়া নবী সালামু আলাহকা” “হে নবী আপনার উপর সালাম” এভাবে না বলে বলতে হবে “সালামু আলাইকা ইয়া নবী” “আপনার উপর সালাম হে নবী” । উপরোক্ত হাদীসটির সনদ বিশুদ্ধ কিন্তু সেটা ভুল স্থানে প্রয়োগ করা হচ্ছে। ঘটনা হলো, আমরা একে অপরকে যে সালাম দিই তা সম্ভাষণ হিসেবে। বিষয়টিকে আরবীতে বলা হয় তাহিয়্যা। মহান আল্লাহ একে অপরকে সালাম দেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পর বলেন, “এটা হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত সম্ভাষণ” (সুরা নুর-৬১)
কারো সঙ্গে দেখা হলে বা কোথাও গমণ করলে প্রথমেই যে কাজটি করা হয় সেটিকে বলা হয় তাহিয়্যা। যেমন মসজিদে প্রবেশ করে প্রথমেই যে দু’রাকাত সলাত আদায় করা হয় তাকে বলে তাহিয়্যাতুল মাসজিদ। যদি কেউ মসজিদে প্রবেশ করে বসে পড়ে বা কিছুক্ষণ কুরআন তেলোয়াত করে এবং পরে দু’রাকাত সলাত আদায় করে তবে তাকে আর তাহিয়্যাতুল মাসজিদ বলা যাবে না কারন এটা প্রথমেই করা হয় নি। মুসলিমরা পরস্পরের সাথে দেখা হলে যে সালাম দেয় সেটাকে বলা হয় তাহিয়্যা বা সম্ভাষণ। সেক্ষেত্রে প্রথমেই সালাম না দিলে বিষয়টি আর তহিয়্যা বলে গণ্য হয় না এবং সুন্নাতও আদায় হয় না। একারণে এ বিষয়ে হাদিসে অত্যাধিক কঠোরতা করা হয়েছে। এমনকি কারো বাড়িতে অনুমতি গ্রহণের সময় আগে অনুমতি গ্রহণ করে পরে সালাম দেওয়ার ব্যাপারে নিষেধ করা হয়েছে বরং আগে সালাম দেওয়ার পরে অনুমতি গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। “কথার আগে সালাম” এই হাদীসটির ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী ক্বারী অনুরুপ কথা বলেছেন। তিনি বলেন,
রসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, “কথার আগে সালাম দিতে হবে” এর কারণ সালাম হচ্ছে তাহিয়্যা যা প্রথমে শুরু করতে হয় প্রথমে অন্য কোনো কথা বলে পরে সালাম দিলে বিষয়টি আদায় হয় না। যেমন তাহিয়্যাতুল মসজিদ মসজিদে প্রবেশ করার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে আদায় কলে আদায় হয় না। (আল-মিরকাত)
এখন আমার প্রশ্ন হলো রাসুলুল্লাহ সাঃ এর নাম উচ্চারণ করার পর আমরা যে সালাম পেশ করি সেটা কি তাহিয়্যা বা সম্ভাষণ হিসেবে গণ্য? সম্ভাষণ তো হয় কারো সঙ্গে সাক্ষাত হলে কিন্তু আমাদের সাথে কি এখন রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সাক্ষাত হয়? তাহলে সঠিক কথা হলো, আমরা রাসুলুল্লাহ সাঃ এর উদ্দেশ্যে এখন যে সালাম পেশ করি তা তাহিয়্যা বা সম্ভাষণ নয় বরং দোয়া। একারণে আমরা বলি, “রসুলুল্লাহ আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম”। এখানে দুটি জিনিস সালাম দেওয়ার পূর্বে উল্লেখ করা হয়। প্রথমত রাসুলুল্লাহর নামটি আগে উল্লেখ করা হয় দ্বিতীয়ত সলাত তথা দুরুদ কথাটি সালামের পূর্বে উল্লেখ করা হয়। আগে সালাম দিতে হবে এ নীতি এখানে প্রয়োগ করলে বলতে হতো, আস-সালামু আলাইহি, ওয়াস-সলাতু রসুলুল্লাহ। সুস্থ মস্তিস্কের যে কারো নিকট বিষয়টি বেজায় বেখাপ্পা মনে হবে সন্দেহ নেই।
মীলাদ মাহফিলে বলা হয় “ইয়া নাবী সালামু আলাইকা” তথা হে নবী আপনার উপর সালাম। এখানে কিন্তু সালামের মাধ্যমে তাহিয়্যা বা সম্ভাষণ উদ্দেশ্য নয়। যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাঃ এখানে হাজির নাজির নেই। এখানে আসলে দোয়া উদ্দেশ্য। আর হরফে নেদা তথা হে নবী কথাটি আসলে মাজাঝ বা রুপক অর্থে বলা হয়েছে প্রকৃত অর্থে নয়। যেমন দূর দেশে বিপদে পড়লে বা রোগাক্রান্ত হলে আমরা বলি ওমা! ও বাবা। এখানে বাবা মাকে ডাকা-ডাকি করা উদ্দেশ্য নয় যেহেতু তারা হাজির নেই। মোট কথা রাসুলের অবর্তমানে তার উপর যে সালাম পেশ করা হয় সে ব্যাপারে কথার আগে সালাম দিতে হবে এই বিধান প্রযোজ্য নয়। যেহেতু এখানে সালাম সম্ভাষণ অর্থে নয় বরং দোয়া অর্থে। মিলাদের মাহফিলে সালাম আগে উল্লেখ করার ব্যাপারে কঠোরতা কেবল তারাই করতে পারে যারা রাসূল সাঃ কে হাজির নাজির মনে করে।
অনেকে অবাক হয়ে বলতে পারেন এসব বিষয়ে এত লম্বা আলোচনার কি প্রয়োজন? এ বিষয়ে আমাদের কৈফিয়ত হলো, এধরনের লম্বা আলোচনায় আমাদের দ্বিমূখী উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত যারা বর্তমানে বিদয়াতের বিরোধীতা করার ঠিকাদারী নিয়েছে তারা কত ছোট বিষয়ের উপর নির্ভর করে মুসলিম উম্মাহকে পথভ্রষ্ট ও বিদয়াতী হিসেবে আখ্যায়িত করার হীন প্রচেষ্টায় লিপ্ত তা পাঠকের সামনে তুলে ধরা। দ্বিতীয়ত পথভ্রষ্ট ও বিদয়াতী হিসেবে আখ্যায়িত করার হীন প্রচেষ্টায় লিপ্ত তা পাঠকের সামনে তুলে ধরা। দ্বিতীয়ত এই সকল লোকের শরীয়তের সুক্ষ্ম বিষয়াবলী অনুধাবনে কতটা অক্ষম তা প্রমাণ করা। আর আল্লাহই তৌফিক দাতা।
মীলাদ কিয়ামের বিধান – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মূনীর গবেষণা মূলক প্রবন্ধ। মীলাদ কিয়ামের বিধান প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে আপনার বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করুন।
শায়েখের মীলাদ কিয়ামের বিধান যে বিইটি থেকে নেয়া হয়েছে বইটির নাম বিদায়াতে দ্বলালা। সম্পূর্ণ বইটি ডাউনলোড করুন। এখানে মীলাদ কিয়ামের বিধান সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে পাবেন।