তাওহিদ সম্পর্কে কিছু কথা – #শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মুনীর#

তাওহিদ সম্পর্কে কিছু কথা #শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মুনীর# এর গবেষণা মূলক প্রবন্ধটি তওহীদ আর রহমান বই থেকে হুবহু তুলে ধরা হয়েছে যা বর্তমানে একটি যুগান্তকারি বই। তাওহীদ ক্যাটাগরিতে প্রতিটি অধ্যায় দেয়া হয়েছে। আপনি পড়ুন এবং আপনার প্রিয়জনদের মাঝে শেয়ার করুন।

উপরে আমরা ঈমান ভঙ্গের বিভিন্ন কারণ তথা শিকর-কুফরের বিভিন্ন প্রকার ও পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি, যেসব কুফরী কাজ-কর্মে লিপ্ত হলে ঈমান ভঙ্গ হয় তা চারটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রতিটি মূলনীতি কুরআন-সুন্নার আলোকে এবং উম্মতের ওলামায়ে কিরামের ইজমার মাধ্যমে প্রমাণিত। এই সকল মূলনীতির বাইরে কোনো বিষয় ওলামায়ে কিরামের নিকট কুফরী হিসেবে স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য নয়। পূর্ববর্তী ওলামায়ে দ্বীন শিরক-কুফর বলতে তাই বুঝতেন যা আমরা উপরে বর্ণনা করেছি। এই সকল মূলনীতির আলোকেই তারা ঈমান ও কুফরের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির ব্যাখ্যা প্রদান করতেন। উদাহরণস্বরুপ রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, “যে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ বলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে” (সহীহ্ বুখারী ও মুসলিমসহ বিভিন্ন হাদীসগ্রন্থে এই অর্থের বিভিন্ন হাদীস বর্ণিত আছে।) [তিরমিযি] এই হাদীসের প্রকাশ্য অর্থের উপর নির্ভর করে কিছু লোক দাবী করেছে, কেবলমাত্র কালেমা পাঠ করলেই একজন ব্যক্তি জান্নাতী হবে যদিও সে শিরক-কুফরে লিপ্ত হয়। এমনকি কারামিয়া সম্প্রদায় দাবী করেছে যদি কেউ মুখে কালেমা পাঠ করে তবে তার অন্তরে বিশ্বাস না থাকলেও সে মুমিন হবে। (তাফসীরে কুরতুবী) এসবই স্পষ্ট ভ্রান্তি ও নিকৃষ্ট বিদয়াত। বিপরীত দিকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের ওলামায়ে কিরামের স্পষ্ট বক্তব্য হলো, কালেমা পাঠ করার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি মুক্তি পাবে যদি সে ইসলামের সকল বিধি-বিধানকে মেনে নেয় এবং সকল প্রকার শিরক-কুফর থেকে বেঁচে থাকে। তারা বিভিন্ন দলিল-প্রমাণের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেই এই মত ব্যক্ত করেছেন।

অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে, যে আমাদের মতো সলাত আদায় করে, আমাদের কিবলাকে কিবলা হিসেবে গ্রহণ করে, আমাদের যবেহকরা পশু খাওয়া বৈধ মনে করে তবে সে মুসলিম। তার (জান ও মালের ব্যাপারে) আল্লাহর পক্ষ থেকে নিরাপত্তা রয়েছে। অতএব, কেউ যেন আল্লাহর দেওয়া নিরাপত্তা ভঙ্গ না করে। (সহীহ্ বুখারী)

অন্য একটি হাদীসে এসেছে, “তোমরা কোনো পাপে লিপ্ত হওয়ার কারণে তোমাদের কিবলার অনুসারী কাউকে কাফির বলো না। (তিবরানী)

এই হাদীসটির সনদ সহীহ নয় তবে এর মূলভাব বুখারী শরীফে বর্ণিত হাদীসটির অনুরুপ।

এই সকল হাদীসের কারণে বিভিন্ন ওলামায়ে কিরাম বলেছেন, আমরা কিবলার অনুসারী কাউকে কোনো পাপে লিপ্ত হওয়ার কারণে কাফির বলি না।

বাহরুর রায়েকে হাবিল ফাতাওয়ার বরাতে এই আক্বীদাটি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। শাফেঈ মাজহাবের ফিকাহ গ্রন্থ আত-তাজকিরাতে একই কথা বলা হয়েছে। উপরোক্ত হাদীস এবং ওলামায়ে কিরামের এই সকল বক্তব্যের মাধ্যমে কেউ কেউ মনে করেছে কিবলামূখী হয়ে সলাত আদায় করে এমন কাউকে কাফির বলা যেতে পারে না। কিন্তু এখানে তা উদ্দেশ্য নয়। রাসুলুল্লাহ সাঃ এর হাদীস এবং ওলামায়ে কিরামের বক্তব্যে কিবলার অনুসারী বলতে এখানে ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান মেনে নেওয়া এবং ঈমান ভঙ্গ করে এমন কর্মকান্ড তথা সকল-প্রকার শিরক-কুফর থেকে দূরে থাকাই উদ্দেশ্য।

মোল্লাহ্ আলী কারী রঃ বলেন, জেনে নাও, আহলুল কিবলা (কিবলার অনুসারী) বলতে বোঝানো হয়েছে যারা আল্লাহর দ্বীনের অকাট্যভাবে প্রমাণিত প্রতিটি বিষয় মেনে নেয় যেমন, পৃথিবী ধ্বংসশীল, পুনরুত্থান দিবস, ছোট-বড় সকল বিষয়ে আল্লাহ জ্ঞান রাখেন ইত্যাদি। যদি কেউ সারাজীবন ইবাদত ও আনুগত্য করে কিন্তু সে বিশ্বাস করে পৃথিবী অবিনশ্বর বা পুনরুত্থান দিবসকে অস্বীকার করে অথবা আল্লাহ তায়ালা ছোট-বড় সকল বিষয়ে জ্ঞান রাখেন এটা অস্বীকার করে তবে এই ব্যক্তি আহলে কিবলা (কিবলার অনুসারী) বলে বিবেচিত হবে না। অতএব, আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের নিকট কিবলার অনুসারী কাউকে কাফির না বলা+-র অর্থ হলো, কাউকে কাফির বলা হবে না যতক্ষণ না সে এমন কোনো কাজে লিপ্ত হয় যা কুফরীর প্রমাণ ও প্রতীক হিসেবে গণ্য এবং তার মধ্যে এমন কোনো কর্মকান্ড পাওয়া না যায় যা মানুষকে কাফিরে পরিনত করে। (শারহে ফিকহে আকবার-পৃষ্ঠা:২৩০)

সুতরাং যে ব্যক্তি কোনো একটি স্পষ্ট কুফরীতে লিপ্ত হয় সে কাফির বলে গণ্য হবে এবং তার যাবতীয় আমল বিনষ্ট হবে। তার কালেমা পাঠ করা বা সলাত-সওম পালন করা কোনোই কাজে আসবে না। এই সুস্পষ্ট মূলনীতিটি অস্বীকার করা ঘৃণিত বিদয়াত ও স্পষ্ট বিভ্রান্তি হিসেবে গণ্য। একইভাবে এই সকল কুফরী কর্মকান্ড ছাড়া অন্য কোনো পাপ ও অপরাধের কারণে কোনো মুসলিমকে কাফির বলাও বিদয়াত ও পথভ্রষ্টতা। এটা খারেজী সম্প্রদায়ের আক্বীদা। উপরে বর্ণিত কোনো মুসলিমকে পাপে লিপ্ত হওয়ার কারণে কাফির না বলা সংক্রান্ত মূলনীতিটি এই ক্ষেত্রে  প্রযোজ্য। বর্তমানেও দেখা যায় কিছু লোক খারেজীদের মতামত অনুসারে মানুষকে এমন কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে তাকফীর করে থাকে যা আসলে কুফরী নয়। নিজেদের স্বপক্ষে তারা এমন কিছু আয়াত ও হাদীসকে দলিল হিসেবে উল্লেখ করে যেখানে শিরক-কুফর শদ্বগুলো রুপক অর্থে ব্যাবহার করা হয়েছে। বিভিন্ন হাদীসে, আত্মহত্যা করা, নিজের পিতা ছাড়া অন্য কাউকে পিতা বলে পরিচয় দেওয়া, মৃতের জন্য বিলাপ করে কাঁদা, বংশ তুলে গালি দেওয়া, আল্লাহর নাম ছাড়া অন্য কারো নামে কসম করা, তাবীজ ঝুলানো ইত্যাদি বিষয়কে শিরক বা কুফর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এখানে অধিক কঠোরতার উদ্দেশ্যে রুপক অর্থে শিরক-কুফর শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে প্রকৃত অর্থে নয়। কিন্তু কেউ কেউ এই সকল হাদীসের কোনো কোনোটি প্রকৃত অর্থে গ্রহণ করে সাধারন মুসলিমদের তার উপর নির্ভর করে কাফির আখ্যায়িত করে থাকে। একইভাবে আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে কোনো মুসলিমকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে সে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে (সুরা নিসা-৯৩) যে সুদ গ্রহণ করে সে আল্লাহ ও রাসুলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করুক (বাকারা-২৭৯), যে সুদ পরিত্যাগ করে সে মুলধন ফেরত পাবে কিন্তু যে পুনরায় তাতে লিপ্ত হয় সে জাহান্নামের আগুনে চিরকাল অবস্থান করবে (সুরা বাকারা-২৭৫) এই সকল আয়াত থেকে কেউ কেউ মুমিনকে হত্যা করা বা সুদ গ্রহণ করা কুফরী হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, “যে কেউ আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করে না সে কাফির” (মায়েদা-৪৪) এই আয়াতের উপর নির্ভর করে কেউ কেউ সাধারনভাবে যে কেউ রাষ্ট্রে অন্য কোনো আইন চালু করে বা অন্য আইন দিয়ে বিচার করে তাদের কাফির বলে থাকে যদিও সে আল্লাহর আইনকে অস্বীকার না করে বা মানবরচিত আইনকে উত্তম ও বৈধ মনে না করে। এসবই বিভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাস হিসেবে গণ্য। ওলামায়ে কিরাম পূর্বে উল্লেখিত মূলনীতির আলোকেই এসব আয়াত ও হাদীসের ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। হারামকে হালাল মনে করা বা ইসলামী বিধি-বিধানকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা ছাড়াই শুধুমাত্র হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ার মাধ্যমে তারা কাউকে কাফির বলে আখ্যায়িত করেন না। তারা বিভিন্ন প্রকার দলিল-প্রমাণের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে রায় ঘোষণা করে থাকেন। কোনো একটি বা কয়েকটি আয়াত ও হাদীসকে আলাদাভাবে উপস্থাপণ করে তারা কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না।

শিরক-কুফর শব্দের ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে যেমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে তাওহীদের সাথে সংশ্লিষ্ট আরো কিছু শব্দ যেমন, ইবাদত, ইলাহ, রব, তাগুত ইত্যাদির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও অনুরুপ বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। এই সকল শব্দের শাব্দিক অর্থ ও ব্যাবহারিক প্রয়োগ সম্পর্কে আমাদের একই মূলনীতি স্মরণ রাখতে হবে আর তা হলো, উপরে ঈমান ভঙ্গের কারণ তথা শিরক-কুফর সম্পর্কে যা কিছু আলোচনা গত হয়েছে সেগুলোর উপর উম্মতের ওলামায়ে কিরামের ঐক্যমত সম্পাদিত হয়েছে অতএব, তার বাইরে কোনো বিষয়কে শিরক-কুফর হিসেবে প্রমাণ করার জন্য ইবাদত, ইলাহ, রব, দ্বীন, তাগুত ইত্যাদি শব্দের ভুল ব্যাখ্যা করা যাবে না। এই সকল শব্দের ঐ ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ গ্রহনযোগ্য হবে না যাতে এমন কোনো বিষয় কুফরী হিসেবে প্রমাণিত হয় যা মূলত কুফরী নয়। এই ধরণের যে কোনো ব্যাখ্যা বিভ্রান্তির ও পথভ্রষ্টতা হিসেবে গণ্য হবে। অর্থাৎ এই সকল শব্দ আসলে উপরে ঈমানভঙ্গের কারণ সম্পর্কে আমরা যা কিছু বর্ণনা করেছি সেই অর্থই বহন করে। সুতরাং এগুলোর উপর পৃথকভাবে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। তবে আমরা এগুলোর শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করবো।

ট্যাগ: তাওহিদ সম্পর্কে কিছু কথা তাওহিদ সম্পর্কে কিছু কথা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *