গায়েবের বিষয়ে জানার জন্য চেষ্টা করা বৈধ কিনা – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মূনীর

গায়েবের বিষয়ে জানার জন্য চেষ্টা করা বৈধ কিনা – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মূনীর এর প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে আপনার বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করুন।

পূর্বের আলোচলায় আমরা দেখেছি, নির্দিষ্ট কিছু শর্ত উপস্থিত না থাকলে গায়েব সম্পর্কে জানার দাবী করা বা জানতে চেষ্টা করা কুফরী হবে না। আমরা দেখেছি যে ব্যক্তি গনকের নিকট গমণ করে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করে কিন্তু তার কথা অকাট্য ও সুনিশ্চিত মনে না করে সে কাফির হবে না তবে পাপী হবে যেহেতু রসুলুল্লাহ সাঃ গনকের নিকট গমন করতে নিষেধ করেছেন। সুতরাং গায়েব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা কুফরী না হলেও অনেক সময় নিষিদ্ধ ও হারাম হিসেবে গণ্য হতে পারে। গায়েব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করার বৈধতা-অবৈধতা নির্ভর করে কি পদ্ধতিতে গায়েব জানার চেষ্ট করা হচ্ছে তার উপর। নিন্মে এসকল বিষয় সম্পর্কে পৃথকভাবে আলোচনা করা হলো।

(ক) স্বপ্ন বা কাশফ ইলহামের মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে গায়েব জানা যায়। এ বিষয়ে বিস্তারিত দলিল-প্রমাণ আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। এখন যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহর নিকট হতে নেক স্বপ্ন বা ইলহামের মাধ্যমে কোনো বিষয়ে অবগত হওয়ার ইচ্ছায় বিভিন্ন বৈধ পন্থায় চেষ্টা-তদবীর করে তবে তা নিন্দনীয় হবে না।

হাদীসে কোনো কাজ করার পূর্বে দুরাকাত সালাত আদায় করে আল্লাহর নিকট উত্তম জিনিস প্রার্থনা করে ও মন্দ জিনিস হতে আশ্রয় চেয়ে দোয়া করতে বলা হয়েছে। এই সলাতকে বলা হয় “ইস্তিখারার সলাত”। এবিষয়ে রসুলুল্লাহ সাঃ একটি দোয়াও শিক্ষা দিয়েছেন। ইস্তিখারার সলাতে বান্দা আল্লাহর নিকট দোয়া করে, যেনো তিনি তার অন্তরকে সত্য ও কল্যাণের দিকে পথনির্দেশ করেন। ইস্তিখারার সলাত বান্দার পক্ষ থেকে তার রবের নিকট পরামর্শ গ্রহণ করা হিসেবে গণ্য। আর বান্দার অন্তরে নির্দিষ্ট একটি বিষয় জাগ্রত করে দেওয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত জানানোর মতো। অন্তরে কোনো বিষয় জাগ্রত হওয়াকেই মূলত “ইলহাম” বলে। সুতরাং ইস্তিখারার সলাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে ইলহামের মাধ্যমে কোনো বিষয়ে সঠিক সিন্ধান্ত জানার চেষ্টা করা হয়।

স্বপ্নের বিষয়টিও অনুরুপ। হাদীসে বলা হয়েছে, নেক স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে সংবাদ বহন করে। যদি কেউ এধরনের স্বপ্ন দেখার জন্য বিশেষ কিছু আমল করে তবে সেটা অবৈধ হতে পারে না। রাত্রে ঘুমানোর সময় রসুলুল্লাহ সাঃ ওযু করতে আদেশ করেছেন। এর কারণ সম্পর্কে কেউ কেউ বলেছেন, “যাতে সে অধিক পরিমান সত্য স্বপ্ন দেখতে সক্ষম হয়।” (শারহে মুসলিম)

একইভাবে বৈধ হবে, কোনো বিষয়ে নেককার ব্যক্তিদের পরামর্শ নেওয়া এবং এমন আশা করা যে, হয়তো আল্লাহ তার অন্তরে সত্য জাগ্রত করবেন ফলে সে উদ্ভত পরিস্থিতিতে সঠিক সমাধান বর্ণনা করতে সক্ষম হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তারা পরস্পরের মধ্যে পরামর্শ করে কাজ করে” । সুরাঃ সুরা-৩৮

এছাড়া বিভিন্ন হাদীসে মুমিনদের পরামর্শ নিতে উৎসাহিত করা হয়েছে। উত্তম দিক নির্দেশনা পাওয়ার আশায় নেক-কার ব্যক্তিদের স্বপ্ন সম্পর্কে খোঁজ-খবর করাও সঠিক কর্মপন্থা হিসেবে গণ্য। রসুলুল্লাহ সাঃ তার সাহাবাদের প্রায়ই প্রশ্ন করতেন, “তোমাদের কেউ কি কোনা স্বপ্ন দেখেছো?” (সহীহ বুখারী)

(খ) জিন ও ফেরেস্তার মাধ্যমে গায়েবের বিষয়ে খবর পাওয়ার চেষ্টা করা।

উপরে আমরা বলেছি, জিন ও ফেরেস্তার মাধ্যমে গায়েবের বিষয়ে খবর পাওয়া যায়। এখন প্রশ্ন হলো, যদি কেউ জিন বা ফেরেস্তার মাধ্যমে গায়েব জানার চেষ্টা করে তবে তার বিধান কি হবে?

জিনদের মাধ্যমে যারা বিভিন্ন খবর সংগ্রহের চেস্টা করেন তাদের ব্যাপারে কথা হলো, যদি তারা জিনদের মাধ্যমে ভবিষ্যতের কোনো বিষয় জানার চেষ্টা করে তবে সেটা হারাম হবে কারণ মানুষের মতো জিনেরাও ভবিষ্যত সম্পর্কে কিছুই জানে না তবে আকাশের ফেরেস্তাদের নিকট হতে তারা দু একটি কথা শুনে ফেলে। কিন্তু এটা তাদের জন্য নিষিদ্ধ। অতএব কেবলমাত্র অবাধ্য জিনেরাই আড়ি পেতে এধরণের খবর শুনে থাকে। ঐসকল অবাধ্য জিনদের সাথে সম্পর্ক রাখা এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করে তারা যে খবর শ্রবণ করেছে সেটা শ্রবণ করার চেষ্টা করা মানুষের জন্যও অবৈধ হবে এতে সন্দেহ নেই। আর যদি তারা বর্তমানে ঘটমান এবং অতীতে ঘটেছে এমন বিষয়াবলী জানার জন্য জিনদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে তবে কথা হলো, মানুষের মধ্যে যেমন নেককার লোকদের তুলনায় বদকারের সংখ্যা বেশি তেমনি বেশিরভাগ জিনই যে আসলে অবাধ্য শয়তান সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তাছাড়া দুষ্টু জিনেরাই মূলত মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে তাদের বিভিন্ন প্রকারে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে থাকে। নেককার ও আমলদার জিনদের পক্ষে এ ধরণের খেল-তামাশায় অংশ নেওয়ার সুযোগ কমই থাকার কথা। বাস্তবেও দেখা যায়, বে-নামাযী ওঝা-কবিরাজ, বদকার গনক ও জাদুকর ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকৃতির খারাপ লোকেরাই জিনের সাথে যোগাযোগের দাবী করে। প্রকৃত নেককার ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা এসব দাবী কমই করে থাকেন। বদরের যুদ্ধে কাফিরদের পক্ষে স্বয়ং “ইবলিস শয়তান” একজন বৃদ্ধ পরামর্শদাতার রুপে যোগদান করেছিল এবং তাদের উৎসাহ দিয়ে বলেছিল,

আজ কেউই তোমাদের পরাজিত করতে সক্ষম হবে না আমি তোমাদের সাথে আছি। (সুরা আনফাল-৪৮)

কিন্তু রসুলুল্লাহ সাঃ এর পক্ষে কোনো জিন অংশগ্রহণ করেছিল বলে শোনা যায় নি। এমনকি বদরে কাফিরদের সংখ্যা কত ছিল সেটা জানার জন্য স্বয়ং রসুলুল্লাহ সাঃ আবু বকর রাঃ কে সাথে নিয়ে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়েন। কোনো জিন সেদিন এই সামান্য তথ্যটি তাকে জানাতে আসেনি। এ ঘটনা প্রমান করে মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ যতটা স্বাভবিক মানুষের সাথে জিনদের যোগাযোগ ততটা স্বাভাবিক নয়।

মোটকথা, জিনদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুষ্টু শয়তানদের হাতে পড়ে শিরক-কুফর ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়া বা দিন দুনিয়ার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। তাই এসব বিষয়ে আগ্রহ না দেখানোই উত্তম।

তবে কোনো অবৈধ কাজে লিপ্ত না হয়ে জিনের মাধ্যমে কোনো বিষয়ে অবগত হওয়া সম্ভব হলে সেটা নিষিদ্ধ হবে না। আমরা পূর্বে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রঃ থেকে বর্ণনা করেছি, তিনি এ ব্যাপারটিকে বৈধ বলেছেন। কিন্তু জিনদের মাধ্যমে পাওয়া খবরকে অকাট্য সত্য হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। সেটার আলোকে কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করাও বৈধ হবে না। সেহেতু এটা জানা সম্ভব নয় যে, সে মিথ্যা বলেছে না সত্য বলেছে। এখন ফেরেস্তাদের ব্যাপারে কথা হলো, নবী রাসূল ছাড়া অন্য কারো নিকট সাধারনত ফেরেস্তা আগমন করে না। যদি ফেরেস্তা কোনো মানুষের নিকট খবর নিয়ে আসে তবে মানুষের আকৃতিতে বা গয়েবী আওয়াজের মাধ্যমে এমনভাবে তাকে খবরটি শোনানো হবে যাতে উক্ত ব্যক্তির পক্ষে এটা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না হয় যে, এটা ফেরেস্তা নাকি জিন।

যদি কেউ ফেরেস্তাদের মাধ্যমে কোনো বিষয়ে জানার চেষ্টা করে এবং ফেরেস্তাকে নিশ্চিতভাবে চিনতে পারা ও তার নিকট হতে অকাট্য ও অলঙ্ঘনীয় জ্ঞান হাসিল করার আশা করে তবে এটা নবুয়ত ও ওহী পাওয়ার ইচ্ছা হিসেবে গণ্য হবে এবং কুফরী হবে। যেহেতু শেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাঃ এর পর আর কোনো নবী আসবে না এ বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে। অতএব, এখন রসুলুল্লাহ সাঃ এর রেখে যাওয়া কুরআর ও হাদীস ছাড়া ফেরেস্তাদের মাধ্যমে বা অন্য কোনোভাবে সরাসরি আল্লাহর নিকট হতে নিশ্চিত ও অকাট্য জ্ঞান হাসীল করার চেষ্টা করা বা তার দাবী করা স্পষ্ট কুফরী হিসেবে গণ্য হবে। তবে যদি কেউ মানুষের আকৃতিতে বা অন্য কোনো অনিশ্চিত পন্থায় ফেরেস্তাদের মাধ্যমে কিছু শোনার ইচ্ছা করে তাহলে তা কুফরী হবে না কিন্তু এটা অনুচিত হবে যেহেতু এ ক্ষেত্রে কোনা জিন বা শয়তান নিজেকে ফেরেস্তা পরিচয় দিয়ে তাকে বিভ্রান্ত করতে পারে। অতএব, উপরে জিনের মাধ্যমে গায়েবী খবর জানা সম্পর্কে আমরা যা কিছু বলেছি সেটা এ ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।

(গ) প্রকৃতির বুকে ঘটমান বিভিন্ন ঘটনার উপর গবেষণা ও অভিজ্ঞতার আলোকে গায়েব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা।

যেবস মাধ্যমে গায়েবের বিষয়ে সাধারন মানুষ অবহিত হবে পারে সে সম্পর্কে আমরা বলেছি, প্রকৃতিতে ঘটমান বিভিন্ন বিষয়ের উপর চিন্তা গবেষণা করে অনেক সময় অজানা বিষয়ে  জানা সম্ভব হয়। এরুপ অভিজ্ঞতার আলোকে গৃহিত সিদ্ধান্ত অনেক সময় সঠিক প্রমাণিত হয়। রসুলুল্লাহ সাঃ এর চাচা আব্বাস মুখের পরিবর্তন লক্ষ্য করে রসুলুল্লাহ সাঃ এর মৃত্যু সম্পর্কে সঠিক ভবিষ্যৎবাণী করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ওহশী একজন ব্যক্তির পায়ের চিহৃ দেখে তার পরিচয় শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। এসব ঘটনা আমরা পূর্বে বর্ণনা করেছি। অভিজ্ঞতার আলোকে গায়েব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করার পন্থা ও পদ্ধতি বিভিন্ন রকম হতে পারে এবং ভিন্ন-ভিন্ন অবস্থার পেক্ষিতে এর বিধানও বিভিন্ন রকম হতে পারে। নিচে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পেষ করা হলো।

  1. এর মধ্যে কিছু বিষয় এমন রয়েছে যা বারবার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। যেমন মানুষ মেঘ দেখলে ঝড়-বৃষ্টির আশঙ্কা করে থাকে যেহেতু সাধারনত ঝড়-বৃষ্টির পূর্বে আকাশে মেঘ দেখা যায় এবং আকাশে মেঘ দেখা গেলে ঝড়-বৃষ্টি হয়। যদি অন্য কোনো ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে ঝড়-বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দূর্যোগ সম্পর্কে পূর্বেই জানতে পারা যায় তবে সে জ্ঞানের উপর নির্ভর করে সতর্কতা অবলম্বন বৈধ হবে বরং ক্ষেত্র বিশেষে আবশ্যক হবে। আবহাওয়া কেন্দ্র থেকে জরুরী সতর্কবার্তা ঘোষণার পরও গভীর সমুদ্রে গমণ করা অনেক সময় আত্নঘাতি হিসেবে গণ্য হতে পারে। একারণে “রসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, মুমিন এক গর্ত হতে দুইবার দংশিত হয় না” (সহীহ্ মুসলিম) অর্থাৎ মুমিন ব্যক্তির উচিত কোনো ব্যাপারে একবার অভিজ্ঞতা হয়ে যাওয়ার পর ভবিষ্যতে সেটা স্বরন রেখে বিপদ এড়িয়ে চলা। সুতরাং অভিজ্ঞতার আলোকে প্রমাণিত বিষয়াবলীর উপর নির্ভর করা কেবল বুদ্ধির দাবী তাই নয় বরং ঈমানে দাবী।
  2. কিছু বিষয় এমন রয়েছে যা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে প্রমাণিত নয় তবে মুল বিষয়ের সাথে পুরোপুরি সম্পর্কহীন নয়। যেমন, কারো মুখ দেখে তার আচার-আচরণ, স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে অনুমান করার চেষ্টা করা বা গর্ভবতী মায়ের গঠন ও আকৃতির উপর চিন্তা-গবেষণা করে গর্ভের সন্তান মেয়ে কি ছেলে সে বিষয়ে মন্তব্য করা ইত্যাদি। আব্বাস রাঃ এর পক্ষ থেকে রসুলুল্লাহ সাঃ এর চেহারা লক্ষ্য করে তার মৃত্যু সম্পর্কে মন্তব্য করাও এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত। তিনি বলেছিলেন, আব্দুল মোত্তালিবের বংশধরদের মৃত্যূর সময় তাদের চেহারা কেমন হয় তা আমি জানি। সম্ভবত তিনি স্বীয় জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর লোকদের মৃত্যুর সময় হাজির থাকতেন এবং তাদের মুখের ভাব লক্ষ্য রাখতেন। এভাবে তিনি এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। যাই হোক, এধরণের মন্তব্য করা দোষের কিছু নয় যদিও এসব বিষয়ের উপর নির্ভর করা যায় না এবং এসব বিষয়কে নিশ্চিত সত্য হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। যেহেতু এগুলোর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত নয়।
  3. কিছু কিছু বিষয় এমন রয়েছে যা অভিজ্ঞতার আলোকে প্রমাণিত নয় আবার মূল বিষয়ের সাথে কোনভাবেই সম্পৃক্ত নয় বরং সেগুলো কুসংস্কার এবং মুর্খতা হিসেবে গন্য। যেমন ভ্রমনের সময় কাক ডাকলে বা পেঁচা দেখলে সেটাকে অশুভ জ্ঞান করে ভ্রমণ থেকে ফিরে থাকা, হাত দেখে ভবিষ্যৎ বলে দেওয়া, তারকারাজি বা রাশি গননা করে ভাগ্য নির্ধারন করা ইত্যাদি। এসকল কার্যাবলী ইসলামে নিষিদ্ধ। বিভিন্ন নিষিদ্ধ কর্মের বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়াল বলেন, “এবং তীরের মাধ্যমে ভাগ্য নির্ধারণ করা” (মায়েদা-0৩)

মুফাসসিরীনে কিরাম এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, আরবরা যখন কোনো কাজ করার ইচ্ছা করতো তখন তিনটি তীর নিতো। যার একটিতে লেখা হতো, “আল্লাহ আমাকে এ কাজটি করার আদেশ দিয়েছেন” অন্যটিতে লিখতো “আল্লাহ্ আমাকে এ কাজটি করতে নিষেধ করেছেন” তৃতীয় তীরটিতে কিছুই লেখা হতো না। এরপর তীরগুলোর মাধ্যমে লটারী করতো। যদি “আল্লাহর আদেশ সংক্রান্ত তীরটি উঠে আসতো তবে তারা উক্ত কাজে লিপ্ত হতো আর নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত তীরটি উঠে আসলে উক্ত কাজ হতে বিরত থাকতো। যে তীরটিতে কিছুই লেখা নেই সে তীরটি উঠে আসলে পুনরায় লটারী করতো। (ইবনে কাছীর ও অন্যান্য)

এধরনের কাজকর্ম শিশুসুলভ নির্বুদ্ধিতা ও কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। একারণে আল্লাহ তায়ালা এটা হারাম করেছেন। তারকারাজীর উপর গবেষণা করে পৃথিবীতে কি ঘটবে বা কার ভাগ্যে কি আছে তা নির্ণয় করার বিধান একই। পৃথিবীতে ঘটমান ঘটনাবলীর সাথে তারকারাজীর কোনো প্রকারের সম্পর্ক প্রমাণিত নয়। এটার উপর নির্ভর করা স্পষ্ট বোকামী ও মুর্খতা ছাড়া কিছু নয়। রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,যে জ্যোতির্বিদ্যার (তারকারাজী সংক্রান্ত জ্ঞান) কিছু অংশ শিক্ষা করলো সে আসলে জাদুর কিছু অংশ হাসিল করলো। (আবু দাউদ) শায়েখ আলবানী হাদীসটিকে সহিহ বলেছেন।

আল-খাত্তাবী রঃ বলেন, কিছু লোক যে, তারকারীজর উপর গবেষনা করে বৃষ্টি বর্ষিত হওয়া, জিনিসপত্রের দর-দাম পরিবর্তিত হওয়া ইত্যাদি ভবিষ্যতে ঘটমান বিষয়াবলী সম্পর্কে মন্তব্য করে, হাদীসে এটাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারকারাজির মাধ্যমে সলাতের সময় নির্ধারণ করা বা কিবলা কোন দিকে তা নির্ণয় করা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত নয়। (আল-মিরকাত ও আওনুল মাবুদ)

রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, “তিয়ারা শিরক”

তিয়ারার অর্থ সম্পর্কে ইবনে আছির রঃ বলেন, “এটা হলো কোন কিছুকে অশুভ জ্ঞান করা”। (আন-নিহাইয়া)

এই হাদীসে কোনো বিষয়কে অশুভ জ্ঞান করা শিরক বলা হয়েছে। এখানে প্রকৃত অর্থে শিরক বোঝানো হয়নি বরং বিষয়টি যে নিষিদ্ধ এখানে সেটিই বোঝানো হয়েছে।

বদরুদ্দীন আল-আইনী রঃ বলেন, “রসুলুল্লাহ সাঃ তিয়ারাকে শিরক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এটা আসলে তাগলীজ (অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা) অর্থে (প্রকৃত অর্থে নয়)। (উমদাতুল কারী)

এখানে যে প্রকৃত অর্থেই শিরক বোঝানো হয়নি তার একটি প্রমাণ হলো, অন্য হাদীসে রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, আমার উম্মতের একটি দল বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এরপর তাদের বর্ণনা দিয়ে বলেন, তারা হলো, যারা ঝাড়-ফুঁক গ্রহণ করে না, তিয়ারা করে না, লোহা পুড়িয়ে দাগ দেয় না বরং তারা তাদের রবের উপর ভরসা করে। (বুখারী ও মুসলিম)

এই হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, যারা তিয়ারা করে না তারা বিনা হিসেবে জান্নাতে যাবে। অতএব, যারা তিয়ারা করে তারা হিসাব গ্রহণের পর জান্নাতে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি তিয়ারা প্রকৃত অর্থেই শিরক হতো তবে যারা তিয়ারা করে তারা হিসাব গ্রহণের পূর্বে বা পরে কখনই জান্নাতে প্রবেশ করতো না।

সুতরাং এই প্রকৃতির উদ্ভট ও অসংলগ্ন ও আজগুবী বিষয়াবলীর উপর নির্ভর করে গায়েব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা হারাম তবে এটা কুফরী নয়। যদি এর মধ্যে ঐ সকল বিষয় বিদ্যামান না থাকে যা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। যেমন নক্ষত্ররাজীকে পৃথিবীর উপর স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে কর্তৃত্বশীল মনে করা বা নক্ষত্রের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানকে অকাট্য ও অলঙ্ঘনীয় মনে করা ইত্যাদি। কেননা সে ক্ষেত্রে বিষয়টি কুফরী হিসেবে গণ্য হবে।

গায়েবের বিষয়ে জানার জন্য চেষ্টা করা বৈধ কিনা – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মূনীর এর প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে আপনার বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করতে ভূলবেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *