ইসলামে অঙ্গতার সীমারেখা বা তাওহীদ ও রেসালাতের সাথে সংশ্লিষ্ট যেসব ব্যাপারে অজ্ঞতা ওযর হিসেবে গণ্য হবে সেখানে অজ্ঞতার সীমারেখা
ইসলামে অঙ্গতার সীমারেখা বা তাওহীদ ও রেসালাতের সাথে সংশ্লিষ্ট যেসব ব্যাপারে অজ্ঞতা ওযর হিসেবে গণ্য হবে সেখানে অজ্ঞতার সীমারেখা
উপরের আলোচনাতে আমরা দেখেছি, তাকফীরের ক্ষেত্রে তাওহীদ ও রেসালাতকে অস্বীকার করলে অজ্ঞতার কারণে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। অর্থাৎ দুনিয়ার বিধানে তাকে কাফিরই মনে করা হবে। কিন্তু অজ্ঞতার কারণে এই ব্যক্তিও দুটি ক্ষেত্রে ছাড় পাবে।
১। আলেমের একাংশের মতে আখিরাতের বিধানে সে মুক্তি পাবে।
২। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সকল আলেমের ঐক্যমতে দুনিয়াতে দাওয়াত পৌছানোর পূর্বে তাকে হত্যা করা নিষিদ্ধ হবে।
এই দুটি ক্ষেত্রে সাধারন বিধি-বিধানের মতো তাওহীদ ও রেসালাতের ব্যাপারেও অজ্ঞতার কারণে ওযর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাধারন বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে অজ্ঞতাকে যেভাবে ওযর হিসেবে গণ্য করা হয় এক্ষেত্রে তা করা হবে না। যে ব্যক্তি তাওহীদ ও রেসালাতের স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে ইসলাম গ্রহন করার পর কোনো একটি বিধান অস্বীকার করে উক্ত ব্যক্তিকে কাফির বলার পূর্বে ওলামায়ে কিরাম সে নও মুসলিম কিনা বা সে মুসলিম হওয়ার পর জ্ঞানী ব্যক্তিদের সংস্পর্ষে কিছু কাল অবস্থান করার সুযোগ পেয়েছে কিনা ইত্যাদি বিষয় পর্যবেক্ষণ করার নির্দেশ দিয়েছেন যাতে উক্ত ব্যক্তি অজ্ঞতার কারণে যতটুকু ছাড় দেওয়া হয়েছে তাতে এতটা সতর্কতা অবলম্বন করা হয় না। বরং শুধুমাত্র ইসলামের দা’ওয়াত তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করার মাধ্যমে সে আখিরাতে ছাড় পাওয়ার অযোগ্য হয়ে যায় এবং দুনিয়ার বিধানে তাকে হত্যা করা বৈধ হয়। এ সম্পর্কে আমরা একটি হাদীস উল্লেখ করেছি যেখানে রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, আমার সম্পর্কে শোনার পরও যারা ঈমান আনয়ন করবে না তারা জাহান্নামী হবে। এখানে জাহান্নামী হওয়ার জন্য কেবল রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সম্পর্কে শোনাকে শর্ত করা হয়েছে। শোনার পর বিস্তারিত গবেষণা করা বা পর্যবেক্ষণ করার সময় পাওয়া শর্ত নয়। একইভাবে কেবলমাত্র ইসলামের দিকে আহ্বান করার মাধ্যমেই কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করা বৈধ হয়। তাদের এলাকায় ইসলামের জ্ঞান চর্চা হয় কিনা বা তারা ইসলামী রাষ্ট্রে কিছুকাল অবস্থান করে ইসলামের সৌদ্ধর্য অবলোকন করেছে কিনা সেটা লক্ষ্য করা আবশ্যক নয়। কুরআন-সুন্নার দলিল-প্রমাণ এবং ওলামায়ে কিরামের মতামতের আলোকে বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে।
সহীহ্ মুসলিমের একটি লম্বা হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, যুদ্ধের পূর্বে কাফির-মুশরিকদের ইসলাম গ্রহণ করতে আহ্বান করতে হবে যদি তারা তা না করে তবে জিজিয়া কর প্রদান করে ইসলামী রাষ্ট্রের বশ্যতা স্বীকার করতে নির্দেশ দিতে হবে যদি তাও না করে তবে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। এখানে ইসলাম গ্রহণ করতে আহ্বান করার পর কিছুকাল সময় দেওয়ার কথা বলা হয়নি। তবে যদি তারা সময় চায় বা মুসলিমরা স্বেচ্ছাপ্রনোদিত হয়ে তাদের সময় দেয় সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু সাধারণভাবে কেবল ইসলামের আহ্বান পৌছে যাওয়ার মাধ্যমেই তাদের হত্যা করা বৈধ হবে। একমনকি মুসলিমরা বিশেষভাবে আহবান করা ছাড়াও সাধারনভাবে লোকমুখে ইসলামের আহ্বান যার নিকট পৌছে যায় তার ক্ষেত্রেও ওযর শেষ হয়ে যায়। এই ব্যাপারে আলেমদের মাঝে উল্লেখযোগ্য কোন দ্বিমত নেই। একারণে ওলামায়ে কিরাম, ইসলামের দা’ওয়াত পৌছায়নি এমন এলাকা আছে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। এই মাসয়ালাটি সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে তারা “যদি এমন থাকে” বা “যদি ধরে নেওয়া হয়” ইত্যাদি শব্দ ব্যাবহার করেছেন।
উপরে আমরা ইবনে কুদামা রাঃ থেকে উল্লেখ করেছি তিনি এধরণের মন্তব্য করেছেন।
ইমাম কুরতুবী রঃ বলেন, “কোনো কোনো আলেম বলেছেন এমন লোকও থাকতে পারে যাদের নিকট কোনো রাসুলের দাওয়াতই পৌছায়নি”। (তাফসীরে কুরতুবী)
ইমাম শাফেঈ রঃ বলেছেন, আমি মনে করি না যে, বর্তমানে এমন কোনো ব্যক্তি আছে যার নিকট ইসলামের দা’ওয়াত পৌছায়নি তবে আমরা যাদের সাথে যুদ্ধ করছি তাদের এলাকা ছাড়িয়ে অন্য কোনো এলাকায় কোনো মুশরিক সম্প্রদায় থাকে তবে এমন হতে পারে যে, তাদের নিকট ইসলামের দা’ওয়াত পৌছায়নি। (আল-উম)
সুতরাং ওলামায়ে কিরাম দা’ওয়াত পৌছানো বলতে কাফিরদের নিকট গমন করে কয়েক ঘন্টা বা কয়েক দিন সময় নিয়ে ইসলাম সম্পর্কে যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপণ করতে হবে এমন মনে করেননি। বরং যে কোন মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারাকেই তারা দা’ওয়াত পৌছে যাওয়া হিসেবে ধরে নিয়েছেন। একারণে তারা ইসলামের দা’ওয়াত পায়নি এমন কাফিরের অস্তিত্ব আছে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এটা হচ্ছে সেই সময়কার কথা যখন রেডিও-টিভি, সংবাদপত্র, ইন্টারনেট ইত্যাদি প্রচার মাধ্যম ছিল না। আর বর্তমানে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কারণে পৃথিবী একটি গ্রামে পরিনত হয়েছে। একপ্রান্তের খবর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অন্য প্রান্তে পৌছে যাচ্ছে। সুতরাং বর্তমানে যারা তাওহীদ ও রেসালাতের স্বীকৃতি দেয় না তাদের ব্যাপারে অজ্ঞতা কোনো অর্থেই ওযর হিসেবে গণ্য হতে পারে না।
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে যে ব্যক্তি তাওহীদ বা রেসালাতকে অস্বীকার করে আর যে তওহীদ ও রেসালাতকে স্বীকার করে কিন্তু ইসলামের অন্য কোনো বিধান অস্বীকার করে এ দুজনের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য চিহ্নিত হয়েছে। আর তা হলো, প্রথম ক্ষেত্রে কেবলমাত্র ইসলামের দা’ওয়াত শ্রবণ করার মাধ্যমেই যাবতীয়-ওযর আপত্তি নিঃশেষ হবে এবং উক্ত ব্যক্তি আখিরাতে জাহান্নামী হবে আর দুনিয়াতে তার রক্ত বৈধ হবে। কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কাফির বলতে হলে বা তার রক্ত ও সম্পদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হলে নিবিঢ়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। দেখতে হবে সে জ্ঞানের পরিবেশে আছে কিনা বা সে যে বিষয়টিকে অস্বীকার করেছে সে বিষয়ে যথেষ্ট প্রচার-প্রসার আছে কিনা ইত্যাদি।
ইসলামে অঙ্গতার সীমারেখা ইসলামে অঙ্গতার সীমারেখা