ইখতিলাফী মাসয়ালাতে সহনশীল হওয়া – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর

ইখতিলাফী মাসয়ালাতে সহনশীল হওয়া – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর – মাজহাব বনাম হাদীস – গ্রন্থ হতে নেয়া হয়েছে। এছাড়া আরো অনেক লেকচার, গ্রন্থ পাবেন আমাদের সাইটে।

উপরে আমরা ইজমা ও বিরল মত সম্পর্কে আলোচনা করেছি। যেসব ব্যাপারে সকল আলেম একমত হয়েছেন সেটাকে ইজমা বলা হয়া ইজমা শরীয়তের অকাট্য দলীল যার বিরোধিতা করার সুযোগ নেই। সেসব বিষয়ে ইজমা সম্পাদিত না হলেও বহু সংখ্যক আলেম একমত হয়েছেন এবং খুবই নগণ্য সংখ্যক আলেম ভিন্নমত পোষণ করেছেন সেইসব বিষয়েও জমহুর ওলামায়ে কিরামের মতকে গ্রহণ করতে হবে এবং শায বা বিরল মতকে পরিত্যাগ করতে হবে। উপরের দুটি পয়েন্টে আমরা এসব বিষয়েই আলোচনা করেছি। এখন আমরা আলোচনা করবো ইখতিলাফী মাসয়াল-মাসাইল সম্পর্কে। যেসব বিষয়ে মতপার্থক্য খুবই প্রকট এবং উভয় পক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ওলামায়ে কিরাম বিদ্যামান থাকেন ঐ সকল মাসলায়াকে ইখতিলাফী মাসয়ালা-মাসাইল বলা হয়। সালফে সালেহীনদের মতামত ও কার্যপদ্ধতির দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখবো তারা যেমন কিছু বিষয়ে একমত হয়েছেন তেমনি কিছু বিষয়ে দ্বিমত করেছেন। তারা সেসব বিষয়ে একমত হয়েছেন সেগুলো আমরা বিনা বাক্যে গ্রহণ করবো আর যেসব বিষয়ে দ্বিমত করেছেন সেগুলোর ব্যাপারে নিম্মোক্ত কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করবো,

(ক) আমরা এটা বিশ্বাস করি যে শরীয়তের বিধিবিধানের উপর চিন্তা গবেষণা করতে যেয়ে মতপার্থক্য হতে পারে। সাহাবায়ে কিরাম রাঃ আইম্মায়ে মুজতাহিদীনরা বিনা কারণে মতপার্থক্য করেছেন এমন নয় বরং গ্রহণযোগ্য কারণেই মতপার্থক্যে জড়িয়ে পড়েছেন। অনেকে আছে মতপার্থক্যকে পুরোপুরি অস্বীকার করে। তাদের কথা হলো কোরআন-হাদীস বিদ্যমান থাকতে কোনো বিষয়ে মতপার্থক্য হতে পারে না। বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্যে জড়িয়ে পড়ার কারণে তারা পূর্ববর্তী ওলামায়ে কিরামকে নিন্দা ও তিরষ্কার করে থাকে। ইমাম ইবনে তাইমিয়া তাদের জবাব দিয়ে একটি বই লিখেছেন যার নাম দিয়েছেন (الأعلام الأئمة عن الملام رفع ) অর্থাৎ “মহান ইমামদের বিরুদ্ধে অভিযোগের জবাব”। সেখানে তিনি আলেমদের মধ্যে মতপার্থক্যের কারণ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, যদি সহীহ হাদীসের বিরুদ্ধে কোনো ইমামের কথা পাওয়া যায় তবে এটা জানতে হবে যে অবশ্যই উক্ত হাদীসটি পরিত্যাগ করার ব্যাপারে তার কোনো গ্রহণযোগ্য কারণ ছিল।

 সহীহ হাদীসের বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য কারণ কি হতে পারে এসম্পর্কে তিনি বলেন,

এ বিষয়ে সকল কারণ তিনটি ভাগে বিভক্ত। প্রথমত হয়তো তিনি মনেই করেন না যে রসুলুল্লাহ সাঃ এই কথা বলেছেন (অর্থাৎ তার নিকট হাদীসটি সহীহ সনদে পৌছায়নি বা তিনি হাদীসটির সনদকে সহীহ মনে করেন নি)। দ্বিতীয়ত উক্ত হাদীস হতে অন্যরা যা বুঝেছেন তিনি তা বোঝেন নি। তৃতীয়ত তিনি হাদীসটি মানসুখ মনে করেছেন। এই তিনটি প্রকার আবার বহু শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়।

ইবনে তাইমিয়ার কথার উপর সামান্য চিন্তা-ভাবনা করলেই বোঝা যাবে যে, তিনি বলতে চাচ্ছেন কখনও কখনও মতপার্থক্য হয় এক পক্ষের নিকট হাদীস না পৌছানোর কারণে বা এক পক্ষ  হাদীসটিকে সহীহ মনে না করার কারণে। আবার কখনও কখনও উভয় পক্ষ হাদীসটি সহীহ মনে করার পারও সেটার অর্থ কি হবে সে বিষয়ে মতপার্তক্যে জড়িয়ে পড়েন। সাহাবায়ে কিরাম রাঃ এর জীবনীতেও এমন প্রচুর কাহিনী পাওয়া যায় যেখানে তারা কোরআনের আয়াত ও রসুলুল্লাহ সাঃ এর মুখ নি”স্বরিত বাণী সরাসরী শ্রবন করার পরও সেটার অর্থ ও উদ্দেশ্য নিয়ে মতপার্থক্যে জড়িয়ে পড়েছেন। আমরা নিচে এ বিষয়ে কয়েকটি উদাহরণ পেশ করছি।

(একঃ) আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, রসুলুল্লাহ সাঃ সাহাবায়ে কিরামকে সরাসরি নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, কেউ যেনো বানু কুরাইজাতে না পৌছে আসরের সলাত না পড়ে। (সহীহ বুখারী)

পরবর্তীতে বানু কুরাইজাতে পৌছানোর পূর্বেই আসরের সলাতের সময় হয়ে গেলে সাহাবায়ে কিরাম রাঃ নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্যে জড়িয়ে পড়েন। একদল বলেন আমরা আল্লাহর রসুল যা নির্দেশ করেছেন হুবহু তাই পালন করবো ফলে তারা সূর্য ডুবে যাওয়ার পর বনু-কুরাইজাতে পৌছে সলাত আদায় করেন। অন্য দল বলেন রসুলুল্লাহ সাঃ এর উদ্দেশ্য এটা ছিল না বরং তিনি বলতে চেয়েছেন দ্রুত যাও। তারা রাস্তার ভিতরই সলাত আদায় করে নেন। রসুলুল্লাহ সাঃ কে এই ঘটনা বলা হলে তিনি কাউকেই তিরষ্কার করলেন না।

দেখা যাচ্ছে রসুলুল্লাহ সাঃ এর কথা সরাসরি শুনা ও জানার পরও সেটার উদ্দেশ্য ও অর্থ নিয়ে একনিষ্ঠ সাহাবায়ে কিরাম মতপার্থক্যে জড়িয়ে পড়েছেন।

(দুইঃ) বুখারী শরীফে আবু মূসা আল আশয়ারী রাঃ ও আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ এর মধ্যে একটি মতপার্থক্যের কথা বর্ণিত আছে। এটি ছিলো জুনুবী অবস্থায় পানি না পেলে তায়াম্মুম করা বৈধ কিনা এ সম্পর্কে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ এটার বিপক্ষে ছিলেন। আবু মূসা আল-আশয়ারী রাঃ বললেন,

রসুলুল্লাহ সাঃ আম্মারকে বলেছিলেন (জুনুবী অবস্থায় তায়াম্মুম করা) তোমার জন্য যথেষ্ট হতো। আপনি এটার ব্যাপারে কি করবেন?

ইবনে মাসউদ রাঃ বললেন, তুমি কি দেখনি যে উমর রাঃ হাদিসটিকে গ্রহণ করেনি?

আবু মূসা আল-আশয়ারী বললেন, ঠিক আছে, আম্মারের হাদীসটি বাদ দিন। আপনি এ আয়াতটির ব্যাপারে কি করবেন?

এরপর তিনি সূরা মায়েদার ছয় নং আয়াতটি তেলাওয়াত করেন যেখানে স্ত্রী সহবাসের পর পানি না পেলে তায়াম্মুম করার নির্দশ দেওয়া হয়েছে। রাবী বলেন,

এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ বুঝতে পারছিলেন না যে তিনি কি বলবেন। তিনি বললেন যদি আমরা মানুষকে এই সুযোগ দিই তবে আশঙ্কা রয়েছে যে তাদের কারো নিকট পানি একটু ঠান্ডা মনে হয় তারা তা পরিত্যাগ করে তায়াম্মুম করবে। (সহীহ বুখারী)

এখানে দেখা যাচ্ছে কোরআনের আয়াত বিদ্যামান থাকা সত্বেও দুজন সাহাবীর মাঝে মতপার্থক্য হয়েছে। উমর রাঃ ইবনে মাসউদের মতই জুনুবী অবস্থায় তায়াম্মুম না করার পক্ষে ছিলেন। তাদের এই মত বর্তমানে পরিত্যাজ্য হয়েছে। কিন্তু এখানে দেখার বিষয় শুধু এতটুকু যে একটি স্পষ্ট আয়াত বিদ্যমান থাকতে উমর রাঃ ও ইবনে মাসউদ রাঃ এর মতো বরেণ্য সাহাবী কিভাবে তার বিপরীত ফতওয়া দিতে পারেন! কোনো ভাবেই একথা বলা যায় না যে তারা বুঝতে ভুল করেছেন। বোঝা যাচ্ছে কোরআনের আয়াত বা রসুলুল্লাহ সাঃ এর হাদীস বুঝতে যেয়ে এমনকি স্পষ্ট ব্যাপারেও দ্বিমত হতে পারে।

(তিনঃ) রসুলুল্লাহ সাঃ এর পক্ষ হতে নির্দেশ ছিলো, কোনো মুসলিম যুদ্ধে যে কাফিরকে হত্যা করবে তাকে উক্ত কাফিরের যাবতীয় সম্পদ প্রদান করা হবে। খালিদ ইবনে ওয়ালিদকে আমীর নিয়োগ করে একটি অভিযান প্রেরণ করেন। ঐ অভিযানে এক মুসলিম একজন কাফিরকে হত্যা করেন যার সাথে বিপুল পরিমান সম্পদ ছিল। খালিদ রাঃ উক্ত মুসলিমকে নিহত কাফিরের পরিত্যাক্ত সম্পদ দিতে অস্বীকার করলে আওফ ইবনে মালিক নামক আরেক সাহাবী তার প্রতিবাদ করে বলেন, হে খালিদ তুমি কি জানো না যে, রসুলুল্লাহ সাঃ নিহত কাফিরের সম্পদ যে তাকে হত্যা করে তাকে প্রদান করতে বলেছেন?

খালিদ রাঃ বলেন, হ্যা। কিন্তু আমার নিকট এটা অনেক বেশি মনে হচ্ছে।

পরে এ সংবাদ রসুলুল্লাহ সাঃ এর নিকট পৌছালে তিনি বলেন, তুমি কেনো তাকে তার প্রাপ্য প্রদান করো নি?

খালিদ রাঃ বলেন, হে আল্লাহর রসুল সাঃ আমার নিকট ওটা অনেক বেশি মনে হয়েছে।

রসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, ঐ সম্পদ তাকে দিয়ে দাও।

পরবর্তীতে আওফ ইবনে মালিক খালিদ রাঃ এর চাদর টেনে ধরে বলেন, আমি যা বললাম তাই হলো তো?

 তার কথা শুনে রসুলুল্লাহ সাঃ রেগে গিয়ে বললেন, খালিদ তুমি তাকে দিয়ো না তুমি তাকে দিয়ো না তোমরা কি আমার আমীরদের সাথে সদাচরণ করবে না?

সম্পূর্ণ ঘটনাটি সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে।

এখানে দেখা যাচ্ছে নিহত কাফিরের সম্পদ হত্যাকারী মুসলিমকে প্রদান করার ব্যাপারটি খালিদ রাঃ এর জানা ছিল কিন্তু তিনি ভেবেছিলেন সম্পদ অনেক বেশি হলে এই বিধান প্রযোজ্য হবে না। রসুলুল্লাহ সাঃ এর নিকট তিনি তার যুক্তি পেশ করেন রসুলুল্লাহ সাঃ তাকে বললেন তুমি তাকে তার সম্পদ দিয়ে দাও কিন্তু তিনি তাকে তিরষ্কার করলেন না। বোঝা গেলো এ বিষয়ে খালিদ রাঃ এর ইজতিহাদ ভূল ছিল কিন্তু তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে অবাধ্যতা করেন নি। পরবর্তীতে খালিদ রাঃ এর পক্ষ নিয়ে আওফ ইবনে মালিকের প্রতি রাগান্বিত হওয়ার ঘটনাও প্রমাণ করে যে রসুলুল্লাহ সাঃ খালিদ রাঃ কে তার নির্দেশ অমান্য করার কারণে অবাধ্য ও অপরাধী মনে করেননি। কেননা তেমন হলে তিনি খালিদ রাঃ উপরই রাগান্বিত হতেন আওফ ইবনে মালিকের প্রতি নয়।

এই হাদীসেও দেখা যাচ্ছে রসুলুল্লাহ সাঃ এর স্পষ্ট নির্দেশ জানা থাকা স্বত্বেও দুজন সাহাবী দুরকম বুঝেছেন।

(চারঃ) রসুলুল্লাহ সাঃ মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তে উপস্থিত সাহাবায়ে কিরামের উদ্দেশ্যে বললেন, আমার নিকট একটি কাগজ নিয়ে এসো আমি তোমাদের উদ্দেশ্যে এমন একটি বিষয় লিখে যেতে চাই যার ফলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। (সহীহ বুখারী)

উমর রাঃ বললেন, রসুলুল্লাহ সাঃ এখন মারাত্মকভাবে অসুস্থ আর আমাদের নিকট তো আল্লাহর কিতাব রয়েছেই সেটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট।

অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম রাঃ বললেন,

দ্রুত নিয়ে এসো রাসুলুল্লাহ সাঃ এমন কিছু লিখবেন যার ফলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।

এর ফলে ব্যপক মতপার্থেক্যের সৃষ্টি হলো হাদীসটির শেষে এসেছে, যখন তারা উঁচু স্বরে কথা শুরু করলো এবং ব্যপক মতপার্থেক্যে লিপ্ত হলো তখন রসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, এখান থেকে উঠে যাও। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

ইবনে হাজার রঃ বলেন, ইমাম আল-কুরতুবী ও অন্যান্য আলেমরা বলেছেন রসুলুল্লাহ সাঃ এর কথা “নিয়ে এসো” এটা আদেশ। যাদের আদেশ করা হচ্ছিল তাদের উচিৎ ছিলো যত দ্রুত স্বম্ভব আদেশ পালনের চেষ্টা করা কিন্তু উমর রাঃ ও অন্য কিছু সাহাবা মনে করেছিলেন এই আদেশটি বাধ্যতামুলক আদেশ নয় বরং রসুলুল্লাহ সাঃ তাদের প্রতি দয়া পরবশ এটা করতে চাচ্ছেন। এ কারণে তারা রসুলুল্লাহ সাঃ কে কষ্ট দিতে চাননি। (ফাতহুল বারী)

ইমাম আন-নাব্বী রঃ বলেন,

আর উমর রাঃ এর কথাটির ব্যাপারে কথা হলো যেসব আলেমরা এই হাদীসের ব্যাখ্যা করেছেন তারা সকলে একমত হয়েছেন যে উমর রাঃ এর এই কথাটি তার গভীর বুঝ ও সুক্ষ বিচার বুদ্ধির প্রমান বহন করে। যেহেতু তিনি ভয় পাচ্ছিলেন যে হয়তো রসুলুল্লাহ সাঃ এমন কিছু লিখবেন যা পালন করতে মানুষ অপারগ হয়ে যাবে…. । (শারহে মুসলিম)

ঘটনা যাই হোক উমর রাঃ হাদীসটি হতে বাধ্যতামূলক আদেশ বোঝেন নি তেমন মনে করলে তিনি অবশ্যই রসুলুল্লাহ রাঃ এর আদেশ অমান্য করতেন না। দেখা যাচ্ছে রসুলুল্লাহ সাঃ এর আদেশ সরাসরি শোনার পরও অনেকের নিকট ভিন্ন অর্থ মনে হতে পারে।

(পাঁচ) সালিম নামে এক যুবক হুযাইফা রাঃ এর ঘরে লালিত পালিত হয়। সে বড় হওয়ার পরও হুযাইফা রাঃ এর স্ত্রীর সামনে অবাধে যাওয়া আসা করতো। হুযাইফা রাঃ এটা অপছন্দ করতেন। উক্ত মহিলা রাঃ রসুলুল্লাহ সাঃ এর নিকট এসে সব খুলে বললে রসুলুল্লাহ সাঃ তাকে বলেন, তুমি তাকে দুধ পান করাও যাতে তুমিও তার উপর হারাম হয়ে যাও আর হুযাইফার অন্তরের অসন্তুষ্টিও দূর হয়ে যায়।

এরপর উক্ত মহিলা রসুলুল্লাহ সাঃ এর নির্দেশ মোতাবেক উক্ত যুবককে দুধ পান করায়(আলেমরা বলেছেন দুধ বের করে বাটিতে নিয়ে তাকে পান করানো হয়েছিল)

এই হাদীস অনুযায়ী আয়েশা রাঃ ফতওয়া দিতেন ছোট বড় যে কাউকে দুধ পান করালে সে উক্ত মহিলার দুধ পুত্র হিসাবে গণ্য হবে। কিন্তু উম্মে সালমা রাঃ বলেন,

রসুলুল্লাহ সাঃ এর অন্যান্য স্ত্রীরা সকলে এই ধরণের দুধ পানের মাধ্যমে কাউকে তাদের সামনে প্রবেশ করাতে অস্বীকার করেছেন তারা আয়েশা রাঃ কে বলেছেন আল্লাহর কসম আমরা তো মনে করি যে এটা সালিমের জন্য বিশেষ একটি ছাড় যা রসুলুল্লাহ সাঃ খাছভাবে তাকে দিয়েছেন। অতএব এই ধরণের দুধ পানের মাধ্যমে কেউ আমাদের সামনে প্রবেশ করতে বা আমাদের দর্শন করতে পারবে না। (সহীহ মুসলিম)

জমহুর ওলামায়ে কিরাম এই বিষয়ে আয়েশা রাঃ এর মত পরিত্যাগ করেছেন। তারা একমত হয়েছেন যে দুই বছরের বেশি বয়সের কাউকে দুধ পান করানো হলে সে দুধপুত্র বলে গণ্য হয় বা এবং এ সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো বিধান প্রমাণিত হয় না।

এখানে দেখা যাচ্ছে আয়েশা রাঃ এর পক্ষে রসুলুল্লাহ সাঃ এর স্পষ্ট নির্দেশ বিদ্যমান ছিল কিন্তু রসুলুল্লাহ সাঃ এর অন্যান্য স্ত্রীরা এটাকে খাছভাবে শুধুমাত্র সালিমের উপর প্রযোজ্য মনে করেছেন আর আয়েশা রাঃ আমভাবে সবার উপর প্রযোজ্য মনে করেছেন।

এভাবে আবু যার রাঃ এর সাথে জমহুর সাহাবায়ে কিরামের যাকাত ও কানয এর ব্যাপারে মতপার্থক্য। সাহরীর সময় কালো সুতা ও সাদা সুতার ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে দ্বিমত ইত্যাদি প্রচুর ঘটনাকে এই বিষয়ের উপর দলীল হিসাবে উপস্থাপণ করা যায় এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে যার বিস্তারিত বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এখানে শুধু এতটুকু প্রমাণ করতে চাই যে, কোরআন-হাদীসের উপর গবেষণা করে সিদ্ধান্ত দেওয়ার সময় দুজন অভিজ্ঞ ও আস্থাভাজন আলেম মতপার্থক্যে জড়িয়ে পড়তে পারেন। এমনকি কখনও স্পষ্ট বিষয়েও দ্বিমত হতে পারে যেমন হয়েছে তায়াম্মুমের মাসয়ালাতে জমহুর সাহাবায়ে কিরামের সাথে উমর রাঃ ও ইবনে মাসউদ রাঃ এর এবং যাকাতের মাসয়ালাতে আবু যার রাঃ এর। এতদূর জেনে নেওয়ার পর আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারবো যে, নিজের মতের বিরুদ্ধে গেলেই কোনো আলেমকে তিরষ্কার করা সঠিক নয়। রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,

যখন একজন বিচারক ইজতিহাদ করে রায় দেয় তখন যদি তার রায় সঠিক হয় তবে তিনি দুটি পুরষ্কার পান আর যদি তার রায় ভুল হয় তবে একটি পুরষ্কার প্রাপ্ত হন।

সুতরাং ইখতিলাফী মাসয়ালাতে একে অপরকে তিরষ্কার না করে পরষ্পরকে পুরষ্কার প্রাপ্ত মনে করতে হবে। যতক্ষণ না কেউ ইজমার বিরুদ্ধে মতামত দেয় বা তার বেশিরভাগ মতামত জমহুর আলেমের বিরুদ্ধে যায়। সেক্ষেত্রে তাকে পরিত্যাগ করতে হবে এবং সাধারণ মানুষকে তার থেকে সতর্ক করতে হবে। আর আল্লাহই ভাল জানে।

(খ) যেসব মাসয়ালাতে একাধিক মত বিদ্যামান থাকে এবং উভয় পক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফুকাহা ও মুজতাহিদীনদের মত পাওয়া যায় একজন যোগ্যতা সম্পন্ন গবেষক ঐ সকল মাসয়ালাতে চিন্তা গবেষণা করে যেটিকে অধিক সঠিক মনে হবে সেটির উপর আমল করবেন এবং সেটির উপর ফতওয়া দেবেন কিন্তু তিনি ভিন্নমতালম্বীদের উপর নিজের মত চাপিয়ে দিতে পারবেন না। নিজের মতকে তিনি সঠিক মনে করতে পারেন কিন্তু অন্যকে পথভ্রষ্ট মনে করার  অধিকার তার নেই।

ইমাম নাব্বী রঃ বলেন,

আলেমরাও মানুষকে কেবল সেই সব বিষয় হতে নিষেধ করবেন যেসব ব্যাপারে ইজমা সম্পাদিত হয়েছে আর যেসব বিষয়ে দ্বিমত আছে সেসব ব্যাপারে কাউকে নিষেধ করা যাবে না। (শারহে মুসলিম)

এবিষয়ে ইমাম ইবনে তাইমিয়া বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, উমর ইবনে আব্দিল আজীজ বলতেন, আমি এমন মনে করি  না যে, সাহাবায়ে কিরাম কোনো বিষয়ে মতপার্থক্যে লিপ্ত না হলেই ভাল হতো কেননা যখন তারা কোনো বিষয়ে ঐক্যমত পোষন করে তখন তাদের মতের বিরুদ্ধে কেউ গেলে অপরাধী হয় আর যখন তারা দ্বিমত করেন তখন তাদের মতামতসমূহের মধ্যে যে কোনোটি গ্রহণ করার সুযোগ থাকে। (মাজমুয়ায়ে ফাতওয়া)

তিনি আরো বলেন, একারণে আলেমদের মধ্যে কেউ কেউ বলতো সাহাবায়ে কিরামের ইজমা অকাট্য দলীল আর তাদের ইখতিলাফ প্রশস্ত রহমত। (মাজমুয়ায়ে ফাতওয়া)

আরো স্পষ্ট করে তিনি বলেন, একজন আলেমের এই অধিকার নেই যে মানুষকে তার মত মেনে চলতে বাধ্য করবে। একারণে শাফেঈ মাযহাবের ও অন্যান্য মাযহাবের আলেমদের মধ্যে যারা আল-আমরু বিলমা’রুফ ওয়ান-নাহী আনিল মুনকার (সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ) সম্পর্কে বই রচনা করেছেন তারা বলেছেন এই সকল ইজতিহাদী মাসয়ালাতে কোনো শক্তির প্রয়োগ করে কাউকে নিষেধ করা যাবে না। কারো এই অধিকার নেই যে, অন্যকে নিজের মত মানতে বাধ্য করবে। বরং সে যুক্তি প্রমাণ দিয়ে আলোচনা করবে তার আলোচনার মাধ্যমে যদি কারো নিকট কোনো একটি মত সঠিক বলে মনে হয় তবে সে তার অনুসরণ করবে আর যদি কেউ অন্য মতটির তাকলীদ করে তবে তাকে নিন্দা করা যাবে না। (মাজমুয়ায়ে ফাতওয়া) কিছু লোক আছেন সাধারণ মানুষের মাঝে বিভিন্ন ইখতিলাফী বিষয়ের দা’ওয়াত দেয়। সলাতের ভিতর রুকুর আগে পরে হাত তোলা, আমীন জোরে বলা, সুরা ফাতিহা পড়া ইত্যাদি বিষয় এমনভাবে প্রচার করে যে মনে হয় এগুলো ছাড়া কেউ মুসলিমই হতে পারে না। তাদের বুঝতে হবে যে এসব ব্যাপারে স্বয়ং সাহাবায়ে কিরামের মধ্যেই মতপার্থক্য ছিলো কিন্তু তারা এগুলো নিয়ে বাক-বিতন্ডাতে লিপ্ত হননি।

ইখতিলাফী মাসয়ালাতে সহনশীল হওয়া ইখতিলাফী মাসয়ালাতে সহনশীল হওয়া ইখতিলাফী মাসয়ালাতে সহনশীল হওয়া ইখতিলাফী মাসয়ালাতে সহনশীল হওয়া ইখতিলাফী মাসয়ালাতে সহনশীল হওয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *