আল্লাহর দ্বীনকে অসঙ্গত স্থানে প্রয়োগ করা – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনির
আল্লাহর দ্বীনকে অসঙ্গত স্থানে প্রয়োগ করা শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনির এর গ্রন্থটি পড়া শেষ হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না
পূর্বের পোষ্টে আমরা আলোচনা করেছি আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে খারাপ শব্দ প্রয়োগ করা বা খারাপ আচরণ করা সম্পর্কে। আমরা দেখেছি, বিরক্তি ও অসন্তোষ প্রকাশ, লোক হাসানো বা উপমা ও উদাহরণ হিসেবে আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে শব্দ প্রয়োগ করা বা খারাপ আচরণ করা কুফরী। এখন আমরা আলোচনা করবো আল্লাহর দ্বীনকে অসঙ্গত স্থানে প্রয়োগ করা সম্পর্কে। এটা তিন ভাগে বিভক্ত।
ক। আমল বা ইবাদত হিসেবে আল্লাহর দ্বীনকে অসঙ্গত স্থানে প্রয়োগ করা।
মোল্লাহ্ আলী ক্বারী রঃ শারহে ফিকহে আকবারে বর্ণনা করেন, যদি কেউ মদ পান করার পূর্বে বা জিনা করার পূর্বে বা অন্য যে কোনো হারাম জিনিস ভক্ষণ করার পূর্বে বিসমিল্লাহ্ বলে সে কাফির হবে। তবে উক্ত হারাম বস্তুটি সুস্পষ্ট হারাম হবে যে বিষয়ে উম্মতের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ওটা যে হারাম তা ঐ ব্যক্তির জানা থাকতে হবে। অর্থাৎ সেটা হারাম হওয়ার বিষয়টি ব্যপক প্রচার প্রসার থাকতে হবে যেমন মদ পান করা।
তিনি আরো বলেন, একইভাবে যদি সে জুয়া খেলার গুটি নিক্ষেপের সময় বলে বিসমিল্লাহ্ তবে সে কাফির হবে। (শারহে ফিকহে আকবার)
ইমাম নাব্বী রঃ বলেন, যদি কেউ আল্লাহর কালামকে অবমাননার উদ্দেশ্যে মদ পান করার সময় বা জেনা করার সময় বিসমিল্লাহ্ বলে তবে সে কাফির হবে। (রওদাতুত তালেবনীন)
বর্তমানে গান-বাজনার অনুষ্ঠানে কুরআন তেলাওয়াত করা বা অশ্লীল ছায়াছবি মুক্তি পাওয়ার সময় দোয়ার অনুষ্ঠান করা এইক কারণে কুফরী হিসেবে গণ্য।
যদি কেউ পায়খানায় বসে বা স্ত্রী মিলনের সময় ইচ্ছাকৃতভাবে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করে তার উপরও একই বিধান প্রযোজ্য হবে। লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, এখানে কুফরীর বিষয়টি আল্লাহর কালামকে অবমাননা করার সাথে সংশ্লিষ্ট। অতএব, যদি কোনো ক্ষেত্রে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, আল্লাহর নামকে অবমাননা করা হচ্ছে না তবে তাকে কাফির বলা হবে না। যেমন, একজন ব্যক্তি সকল জিনিস খাওয়া বা পান করার পূর্বে বিসমিল্লাহ্ বলে থাকে এটা তার অভ্যাস। একারণে সে মদপানের পূর্বেও অভ্যাসবশত বিসমিল্লাহ্ বলে ফেলল সে কাফির হবে না। উক্ত ব্যক্তি হারাম কাজের সাথে আল্লাহর কালাম উল্লেখের মাধ্যমে কুফরী করছে কিনা সেটা অনুধাবন করার জন্য হানাফী মাজহাবের ওলামায়ে কিরাম এ বিষয়ে তিনটি শর্ত আরোপা করেছেন,
১। সে যে কাজের পূর্বে বিসমিল্লাহ্ বলছে সেটা কেবলমাত্র হারাম কাজ হারাম-হালাল মিশ্রিত কোনো কাজ নয়। উদাহরণস্বরুপ কোথাও একটি জনসভার আয়োজন করা হলো যেখানে গান-বাজনাও হবে। যদি উক্ত জনসভার শুরুতে কুরআন তিলাওয়াত করা হয় তবে তা কুফরী হবে না যেহেতু এখানে জনসভাই মূল উদ্দেশ্য আর গান-বাজনা তার সাথে সংযুক্ত।
২। উক্ত হারাম কাজটি ইজমার মাধ্যমে প্রমাণিত হবে সে বিষয়ে কোন দ্বিমত থাকবে না। যেমন, মদ, জিনা ইত্যাদি।
৩। উক্ত বিষয়টি যে হারাম সে বিষয়ে ব্যাপক প্রচার প্রসার থাকতে হবে।
এই সকল শর্ত উপস্থিত থাকার পরও যদি কেউ এ ধরণের হারাম কাজ আল্লাহর নামে শুরু করে তবে সে কাফির হবে কারণ হয়তো সে এ বিষয়টিকে হারাম মনে করে না অথবা সে জেনে বুঝে আল্লাহর কালামকে অবমাননা করতে চায়।
খ। উপমা বা ভাষার প্রয়োগ হিসেবে আল্লাহর দ্বীনকে অসঙ্গত স্থানে প্রয়োগ করা।
প্রতিটি জাতিই নিজেদের মধ্যে কথোপোকথনের সময় বিভিন্ন কবিতা বা ছন্দকে উপমা ও উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। ইসলাম পরবর্তীযুগে পবিত্র কুরআন এবং রসুলের মুখ নিঃসরিত বাণী আরবী সাহিত্যের প্রধান অলংকারে পরিনত হয়। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,
আমি এই কুরআনে যা ওহী করেছি তাতে সুন্দর সুন্দর কাহিনী বর্ণনা করেছি। (সুরা ইউসুফ-৩) রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন “আমাকে ব্যাপক অর্থবোধক সংক্ষিপ্ত কথা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে” (সহীহ্ মুসলিম) পবিত্র কুরআন ও রাসুলের হাদীসের মধ্যে একদিকে যেমন প্রতিটি ক্ষেত্র সম্পর্কে স্পষ্ট দিক নির্দেশনা রয়েছে অন্য দিক থেকে প্রতিটি দিক নির্দেশনা অতি চমৎকার ও আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গিতে বর্ণনা করা হয়েছে। একারণে মুসলিমদের মাঝে বিভিন্ন ঘটনা প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের আয়াত ও হাদীসের খন্ডিত অংশ উপমা ও উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করার ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি বিষয়। সাহাবায়ে কিরামের যুগ থেকেই এটা শুরু হয়। ইমাম বুখারী বর্ণনা করেন, আবু মুছা আল আশআরী রাঃ কে মিরাছের একটি মাসয়ালা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি একটি রায় দেন। পরবর্তীতে তার রায় সম্পর্কে ইবনে মাসউদকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এমন ফতোয়া দিলে তো আমি পথভ্রষ্ট্ হয়ে যাবো এবং কখনও পথ প্রাপ্ত হবো না। এই কথাটি মূলত সুরা আনয়ামের ৫৬ নং আয়াতের অংশ। ইবনে মাসউদ রাঃ নিজের কথার মধ্যে তা চয়ন করেছেন। এ বিষয়টির পারিভাষিক নাম ইকতিবাস বা চয়ন করা। ইমাম সুয়ূতী রঃ আল-ইতকান ফি উলুমিল কুরআনে এ সম্পর্কে পৃথক একটি অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, মালেকী মাযহাবের ওলামায়ে কিরাম এ ব্যাপারে ব্যাপক কঠোরতা করেছেন বলে প্রশিদ্ধ আছে। তবে আমাদের মাজহাবের (শাফেঈ মাযহাব) কেউ এটাকে নিন্দা করেনি।
এরপর তিনি ইজ্জুদ্দিন আব্দুস্ সালাম হতে বিষয়টি বৈধ হওয়ার পক্ষে মত উল্লেখ করেছেন। মালেকী মাযহাবের প্রখ্যাত ফকীহ আবুবকর ইবনে আরবী রঃ হতে কবিতা ছাড়া অন্যান্য স্থানে এমন করার বৈধতা উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, মালেকী মাজহাবের আরেক ফকীহ্ কাজি ইয়াদ রঃ নিজেই আশ-শিফা নামক কিতাবের ভূমিকাতে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতাংশ চয়ন করেছেন।
এরপর তিনি ইবনে হুজ্জা নামক একজন আলেম হতে ইকতিবাস বা চয়ন করা সম্পর্কে বিস্তারিত মত বর্ণনা করেছেন। তিনি, বলেন, নিজের কথার মধ্যে পবিত্র কুরআন হতে কোনো আয়াত বা আয়াতাংশ চয়ন করা তিন রকম হতে পারে। (১) উত্তম (২) বৈধ (৩) অবৈধ।
প্রথম প্রকার হলো দ্বীনী বিষয়ে ওয়াজ-নসীহত করার সময় পরিবত্র কুরআন ও সহীহ্ হাদীস হতে চয়ন করা।
দ্বিতীয় প্রকার হলো, সাধারন দুনিয়াবী কথা-বার্তা ও চিঠি-পত্রে বা গল্প-কাহিনী বর্ণনা প্রসঙ্গে এমন করা। তৃতীয় প্রকারটি দুরকম হতে পারে;
ক। আল্লাহ্ নিজের সম্পর্কে যা বলেছেন সেটা যদি কেউ নিজের কথা হিসেবে বর্ণনা করে। এ বিষয়টির উদাহরণ হিসেবে তিনি একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। কোনো একজন ব্যক্তি তার কর্মচারীদের প্রসঙ্গে বলে, “নিশ্চয় আমার দিকেই তারা প্রত্যাবর্তন করবে এবং আমার নিকটই তাদের হিসাব হবে” পবিত্র কুরআনে এই কথাটি আল্লাহ তায়ালা নিজের বান্দাদের হিসাব সম্পর্কে বলেছেন সেই কথাটিকে এই ব্যাক্তি নিজের কর্মচারীদের ব্যাপারে প্রয়োগ করেছেন। এটা অবশ্যই অসঙ্গত কাজ।
শারহে ফিকহে আকবারের মধ্যে মোল্লাহ্ আলী কারী রঃ এ বিষয়ে আরো বেশ কিছু উদাহরণ উল্লেখ করেছেন। যেমন যদি কেউ কিছু লোককে ডেকে একত্রিত করে আর বলে, “আমি তাদের সবাইকে একত্রিত করলাম”। হানাফী মাযহাবের বেশ কিছু ফতোয়া গ্রন্থে বলা হয়েছে এই ব্যক্তি কাফির হবে। এখানে আরবীতে যে শব্দদুটি উল্লেখ করা হয়েছে তা সরাসরি কুরআন হতে প্রহণ করা হয়েছে। আল্লাহ হাশরের ময়দান সম্পর্কে এ কথা বলেছেন আর এই ব্যক্তি সেটা নিজের উপর প্রয়োগ করেছে।
২। অবৈধ চয়ন করার আরেকটি প্রকার হলো, হাসি তামাশার ছলে পবিত্র কুরআনকে উপস্থাপন করা। (নাউযু বিল্লাহ)
এই বিশ্লেষণটি উল্লেখ করার পর ইমাম সুয়ূতী বলেন, এই বিশ্লেষণটি চমৎকার! আমি এই মতই পোষই করি। (আল-ইতকান) যে কেউ চিন্তা করলে এটা বুঝতে পারবে যে, এ বিষয়ে ইমাম সুয়ূতী ঠিক কথাই বলেছেন।
উপরোক্ত বিশ্লেষণের আলোকে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে যে, নিজের কথার মধ্যে পবিত্র কুরআন বা রাসুলের হাদীস হতে চয়ন করা দোষের কিছু নয় যতক্ষণ না আল্লাহ্ বা রাসুলের জন্য বিশেষভাবে বলা হয়েছে এমন কোনো কথা নিজের উপর প্রয়োগ করা হয় বা নিকৃষ্ট স্থানে কুরআন হাদীস হতে উপমা উল্লেখ করে কুরআন হাদীসকে ছোট করা হয়। যেমন, সিনেমাতে যদি নায়ক গানের ছলে নায়িকার সৌন্দর্য্ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলে, নুরুন আল নূর (অর্থাৎ আলোর উপর আলো) তবে এটা কুফরী হবে যেহেতু এখানে জেনা ব্যাভিচার ও প্রেম-প্রীতির মধ্যে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতকে উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
আল্লাহর দ্বীনকে অসঙ্গত স্থানে প্রয়োগ করা শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনির এর গ্রন্থটি পড়া শেষ হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না এবং দ্বীনকে অসঙ্গত স্থানে প্রয়োগ করা প্রবন্ধটি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য করুন।