আল্লাহর আইন পরিবর্তন কারীর বিধান – আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে অন্য বিধান অনুসরণ করা কুফরী নয় শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মূনীর

আল্লাহর আইন পরিবর্তন কারীর বিধান – আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে অন্য বিধান অনুসরণ করা কুফরী নয় শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মূনীর প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে আপনার বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করুন

পূর্বের পোষ্টের আলোচনাতে স্পষ্টভাবে প্রমানিত হয়েছে যে, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধান অমান্য করা কুফরী নয়। তবে এটা কবীরা গোনাহ্ বা বড় পাপ। কেবলমাত্র খারেজীরা এ ধরণের অপরাধকে কুফরী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। সাহাবায়ে কিরাম ও তাদের পরবর্তী সকল যুগের ওলামায়ে কিরাম তাদের এই মতবাদকে ভ্রান্ত ও পথভ্রষ্টতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং বিভিন্নভাবে তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেছেন। খারেজীদের ব্যাপারে ওলামায়ে দ্বীনের এধরণের পদক্ষেপ ও প্রতিক্রিয়ার ফলে সকল শ্রেণীর মুসলিমরা এটা স্পষ্ট জানে যে, পাপ ও কুফরী এক জিনিস নয়। আল্লাহর আদেশের অবাধ্য হলেই কেউ কাফিরে পরিনত হয় না যতক্ষণ না সে আল্লাহর আদেশকে অস্বীকার করে বা অন্য কোনো কুফরীতে লিপ্ত হয়। এর বিপরীতে কোনো মতবাদ তারা গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। এমতাবস্থায় কিছু সংখ্যক লোক খারেজীদের এই মতবাদটিই মুসলিম উম্মার সামনে একটু ভিন্নভাবে উপস্থাপণ করছে। একটু ঘোর-পেঁচের মাধ্যমে তারা যা কিছু বলছে তাতে মূলত পূর্বের যুগের খারেজীদের এই মতবাদটিই প্রমাণিত হচ্ছে। যদিও তারা নিজেরাই খারেজীদের নিন্দা করে থাকে। এভাবে তারা অজ্ঞাতসারে সেই মতবাদকে সমর্থন করে যাচ্ছে যা তারা অপছন্দ করে। তারা বলে, আল্লাহর বিধান অমান্য করা কুফরী নয় তবে আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে সেই স্থানে ভিন্ন কোনো বিধানের উপর আমল করা কুফরী। চোরের ব্যাপারে আল্লাহর বিধান হলো হাত কেটে দেওয়া। যদি কেউ চোর পাকড়াও করার পর তার উপর কোনো শাস্তি প্রয়োগ না করে বরং তাকে ছেড়ে দেয় তবে সে অপরাধী হবে যেহেতু সে আল্লাহর বিধান অনুসরণ করে নি তবে সে কাফির হবে না।  আর যদি কেউ চোরকে আল্লাহর শাস্তির পরিবর্তে ভিন্ন কোনো শাস্তি যেমন জেল জরিমানা ইত্যাদি প্রদান করে তবে সে কাফির হবে যেহেতু সে আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে ভিন্ন একটি বিধানের উপর আমল করেছে।  এ বিষয়টিকে তারা তাবদীল তথা দ্বীন পরিবর্তন হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে।

একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়। বলা হয়, যদি কেউ মাগরিবের ফরজ সলাত তিন রাকাতের পরিবর্তে চার রাকাত আদায় করে বা রমজানের ফরজ রোজা ত্রিশটির অধিক দাবী করে সে কি কাফির হবে না? একইভাবে যদি কেউ চোরকে হাত কাটার পরিবর্তে জেল-জরিমানা বা অন্য কোনো দন্ডে দন্ডিত করে সেও কাফির হবে।

তাদের এই সকল যুক্তি প্রমাণের জবাব হলো, আল্লাহর বিধান অমান্য করা আর উক্ত বিধানের বিপরীত কিছুর উপর আমল করা মূলত একই বিষয়। যে কেউ আল্লাহর আদেশ অমান্য করে সে উক্ত আদেশের বিপরীত কোনো না কোনো বিষয়ের উপর আমল করে। আল্লাহ তায়ালা যাকাত আদায়ের যে বিধান দিয়েছেন অনেকে সেটা অমান্য করে তার পরিবর্তে গান-বাজনা, যাত্রা পালা ইত্যাদি অবৈধ কাজে টাকা দান করে। হজ্জ ফরজ হওয়ার পরও অনেকে হজ্জ করে না কিন্তু তার পরিবর্তে বহু টাকা খরচ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ করে। এসব কাজ কুফরী হিসেবে চিহিৃত হতে পারে না। যদিও এখানে আল্লাহর আদেশ অমান্য করে তার বিপরীতে বিভিন্ন বিষয়ের উপর আমল করা হচ্ছে। বাস্তব কথা হলো, কোনো একটি আদেশ অমান্য করার অর্থই হলো তার বিপরীতে অন্য কিছু করা। যে সলাত পড়ে না সে ঐ সময় হয়তো ঘুমায় অথবা অন্য কোনো কাজে লিপ্ত থাকে। যে সওম পালন করে না সে এর পরিবর্তে পানাহার করে ইত্যাদি। যে চোরের উপর আল্লাহর বিধান প্রয়োগ না করে তাকে ছেড়ে দেয় সেও তো আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে অন্য বিধান তথা বেকসর খালাশ দেওয়ার বিধান অনুসরণ করে। সুতরাং কেবল আদেশ অমান্য করলে কুফরী হবে না বরং সেটির বিপরীতে কিছু করলে তা কুফরী হবে এই কথাটি সঙ্গত নয়। বরং আল্লাহর আদেশ অমান্য করা কুফরী নয় এর অর্থই হলো আল্লাহর আদেশের বিপরীতে কিছু করা কুফরী নয় যদিও এটা মারাত্নক অপরাধ। একারণে আমরা দেখেছি ওলামায়ে কিরাম আল্লাহর বিধানের বিপরীত কোনো বিধানকে যারা অনুসরণ করে তাদের ব্যাপারে বলেছেন যদি কেউ নিজের বিধানটিকে আল্লাহর বিধান বলে দাবী করে এবং সেটিকেই সঠিক বলে মনে করে তবে কাফির হবে যেহেতু আল্লাহর বিধানকে অস্বীকার করছে। কিন্তু যদি তারা আল্লাহর বিধানটিকেই সঠিক মনে করে কিন্তু অবাধ্যতা বশত অন্য কোনো বিধান অনুসরণ করে তবে এটা কুফরী হবে না বরং পাপকাজ হিসেবে গন্য হবে। ইবনুল আরাবী ও ইবনে তাইমিয়া থেকে আমরা যা কিছু উল্লেখ করেছি তাতে এ সম্পর্কে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে।

সহীহ্ বুখারীতে বর্ণিত আছে, ইয়াহুদীরা জেনাকারীকে রজম করার পরিবর্তে বিভিন্নভাবে লাঞ্চিত ও অপমানিত করতো এবং বেত্রাঘাত করতো। রসুলুল্লাহ সাঃ তাদের বললেন,

রজম সম্পর্কে তারওরাতে কি লেখা আছে?

তারা বলে, “তাদের লাঞ্চিত করা হবে এবং বেত্রাঘাত করা হবে” এটা শুনে আব্দুল্লাহ্ ইবানে সালাম রাঃ বলেন, তোমরা মিথ্যা বলছো, তাওরাতে পাথর মেরে হত্যা করার কথাই লিখিত আছে। এই ঘটনা প্রমাণ করে ইয়াহুদীরা মূলত নিজেদের তৈরী বিধানকে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ বিধান হিসেবে দাবী করতো।

সহীহ্ মুসলিমের একটি হাদীসে ইয়াহুদীদের এসব কার্যাবলীর বর্ণনা এসেছে। সেখানে এও বলা হয়েছে যে, এ প্রসঙ্গে এ আয়াত নাযিল হয়, যে কেউ আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করে না সে কাফির। (সুরা মায়েদা-৪৪)

অতএব আয়াতটিকে কেবল অনুরুপ ঘটনার উপর প্রয়োগ করতে হবে । অর্থাৎ যারা নিজেদের বিধানকে আল্লাহর বিধান হিসেবে দাবী করবে এবং প্রকৃতই যেটা আল্লাহর বিধান সেটা অস্বীকার করবে কেবল তারাই কাফির প্রমাণিত হবে। পূর্বে ইবনুল আরবী রঃ থেকে আমরা বর্ণনা করেছি, তিনি এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন যারা নিজেদের আইনকে আল্লাহর আইন বলে দাবী করে তাদের উপর কুফরীর বিধান প্রযোজ্য হবে কিন্তু যারা এমন দাবী করে না বরং ‍শুধুমাত্র আল্লাহর আইনের পরিবর্তে নিজেদের আইন দ্বারা বিচার-ফয়সালা করে তারা কাফির হবে না বরং পাপী হবে।

আল্লাহর আইন পরিবর্তন কারীর বিধান
আল্লাহর আইন পরিবর্তন কারীর বিধান

অর্থাৎ তিনি ইয়াহুদীদের ঘটনার অনুরুপ ঘটনাবলীতে কুফরীর বিধান প্রয়োগ করেছেন কেননা আয়াতটি তাদের ব্যাপারেই নাযিল হয়েছে।

ইবনে জারীর তাবারী রঃ এ বিষয়ে আরো স্পষ্ট কথা বলেছেন, তিনি এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণনা করেন,

যে কেউ আল্লাহর বিধানকে অস্বীকার করে সে কাফির হবে আর যে আল্লাহর বিধানকে স্বীকার করে কিন্তু তা দ্বারা বিচার-ফয়সালা করে না সে জালেম ও ফাসিক বলে গণ্য হবে।

এর পর ইবনে জারীর তাবারী রঃ বলেন,

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আমার নিকট সঠিক মত হলো আয়াতটি আহলে কিতাবী কাফিরদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। কেননা এই আয়াতের আগে ও পরের আয়াতসমূহ তাদের সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে এবং সেখানে তাদের সম্পর্কেই আলোচনা করা হয়েছে। এই সকল আয়াত যেহেতু তাদের কাহিনী বর্ণনা প্রসঙ্গেই এসেছে তাই এই আয়াতটিও তাদের সাথে সম্পর্কিত হবে এটিই স্বাভাবিক। যদি কেউ বলে আল্লাহ তায়ালা সাধারনভাবে যে কেউ আল্লাহর আইন দ্বারা বিচার করে না তাদের ব্যাপারে এই আয়াতে কথা বলেছেন আর আপনি এটাকে বিশেষ কিছু ব্যক্তির উপর প্রয়োগ করছেন এটা কিভাবে সম্ভব? তাকে বলা হবে, আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে বলছেন, যারা তাদের মতো (অস্বীকার করার মাধ্যমে) আল্লাহর বিধানকে পরিত্যাগ করে তারা কাফির। এভাবে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে কাফির বলা হবে যে, আল্লাহর বিধানকে অস্বীকার করার কারণে তার মাধ্যমে বিচার-ফয়সালা করে না। যেমনটি ইবনে আব্বাস রাঃ বলেছেন। (তাফসীরে তাবারী)

এছাড়া অন্য সকল তাফসীরকারক এই আয়াতের ব্যাখ্যায় অনুরুপ কথা বলেছেন। যা এখানে সুবিস্তারে উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন।

মুলত এই বিষয়টিই হলো তাবদীল তথা আল্লাহর বিধানকে পরিবর্তন করা এবং এধরণের পরিবর্তন সাধন করা কুফরী বলে গণ। কিন্তু শুধুমাত্র আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে ভিন্ন কোনো বিধানের অনুসরণ কারাকেই তাবদীল হিসেবে গণ্য করা এবং কুফরী হিসেবে আখ্যায়িত করা অজ্ঞতা ছাড়া কিছু নয়।

আমরা যদি মাগরিবের ফরজ সলাত চার রাকাত আদায় করা বা ফরজ রোজা ত্রিশটির অধিক দাবী করা কোনো কুফরী হয় সে বিষয়ে চিন্তা করি তবে দেখা যাবে এখানে আল্লাহর বিধান অস্বীকার করা এবং অন্য কোনো বিধানকে আল্লাহর বিধান হিসেবে দাবী করা হচ্ছে বিধায় এটি কুফরী হচ্ছে। কেবলমাত্র আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে ভিন্ন কোনো বিধান অনুসরণের কারণে নয়। যে ব্যক্তি মাগরিবের ফরজ সালাত চার রাকাত আদায় করে নিশ্চিতভাবেই সে এই চার রাকাত সলাতকেই আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরজ হিসেবে বিশ্বাস করে। একইভাবে যে ব্যক্তি রমজানের ফরজ রোজা ত্রিশটির অধিক বলে মনে করে সেও আল্লাহর পক্ষ থেকে ত্রিশটির অধিক রোজা করা হয়েছে এমন দাবী করে অথচ আল্লাহ তা করেন নি। অর্থাৎ এর মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত সঠিক বিধানটি অস্বীকার করা হয় এবং ভিন্ন একটি বিধানকে আল্লাহর বিধান হিসেবে দাবী করা হয়। একারণে এটা কুফরী হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু যেসব বিষয়ে এধরণের দাবী করা হয় না বরং আক্বীদা সঠিক রেখে কেবল কার্যক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানের বিপরীত বিধানের অনুসরণ করা হয় সেখানে বিষয়টি কুফরী হতে পারে না। যদিও সেটা অবাধ্যতা হিসেবে গণ্য হবে। উদাহরণস্বরুপ আল্লাহ তায়ালা পরস্পরের সাথে স্বাক্ষাতের সময় বা বাড়িতে প্রবেশের সময় সালাম দিতে আদেশ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

যখন তোমরা কোনো বাড়িতে প্রবেশ করো তখন নিজেদের আত্নীয় পরিজনকে সালাম দাও। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত একটি অত্যাধিক কল্যাণময় সম্ভাষণ। (সুরা নূর-৬১) সুতরাং একে অপরকে সালাম দেওয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত একটি বিধান। অথচ বর্তমানে বিশেষত শহুরে জীবনে একটি বিষয় রেওয়াজ হয়ে গেছে যে, বাড়িতে প্রবেশ করা বা বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সালাম দেওয়ার পরিবর্তে গুড মর্নিং, গুড ইবিনিং ইত্যাদি ইংরেজী শব্দ উচ্চারণ করা হয়। এ ধরণের বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ নিন্দনীয় ও পরিত্যাজ্য এটা সঠিক তবে কোনো ক্রমেই সালামের পরিবর্তে গুড মর্নিং বলা কুফরী হিসেবে গণ্য হতে পারে না। যদি না সালামের বিধানকে অস্বীকার করা হয় এবং গুড মর্নিং বলাটাই আল্লাহর বিধান হিসেবে দাবী করা হয়। একইভাবে চোরের হাঁত কাটা বা জেনাকারীকে রজম করার পরিবর্তে ভিন্ন কোনো শাস্তি দেওয়া হলে তা কুফরী হবে না যতক্ষণ না এ বিষয়কে আল্লাহর বিদানকে অস্বীকার বা অপছন্দ করা হয় বা জেল-জারিমানাকে আল্লাহর বিধান হিসেবে দাবী করা হয় বা কমপক্ষে এসব বিধি-বিধানকে উত্তম করা হয় এবং এগুলোর মাধ্যমে বিচার ফয়সালা করা বৈধ মনে করা হয়।

আল্লাহর আইন পরিবর্তন কারীর বিধান – আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে অন্য বিধান অনুসরণ করা কুফরী নয় শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মূনীর প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে আপনার বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করতে ভুলবেন না। একই সাথে আল্লাহর আইন পরিবর্তন কারীর বিধান প্রবন্ধটি পড়ে আপনার মতামত ব্যক্ত করুন এবং আল্লাহর আইন পরিবর্তন কারীর বিধান পড়ার পর আপনার চাহিদানুযায়ী প্রবন্ধটি লিখান জন্য কমেন্টে জানান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *