নিয়তের হাকীকত শায়েখ আব্দুল্লাহ আল-মুনীর

নিয়তের হাকীকত প্রবন্ধ। বর্তমানে দেখা যায় নামাযের নিয়ত নিয়ে বিভিন্ন সময় মানুষের মাঝে ঝগড়া-ফাসাদ হয়ে থাকে‌। এসব তর্ক-বিতর্কের সমাধানকল্পে সলাত-সওম ইত্যাদি ইবাদতে নিয়ত করা শর্ত কিনা সেবিষয়ে আমি নিচে যুক্তি-প্রমাণ সহ কিছু আলোচনা পেশ করতে চাই আশা করি এতে সাধারন মানুষের উপকার হবে ইন-শাআল্লাহ‌‌।

রসুলুল্লাহ (সঃ) বলেন,

إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّةِ، وَإِنَّمَا لِامْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ، فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ،

সব আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল‌‌। যে ব্যাক্তি যেমন নিয়ত করবে সে তেমন ফল পাবে‌। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রসুলের উদ্দেশ্যে হিজরত করে তার হিজরত আল্লাহ ও তার রসুলের উদ্দেশ্যেই হয়‌‌।

[সহীহ বুখারী]

এই হাদীসটি থেকে বোঝা যায় সকল আমলে জন্য নিয়ত শর্ত‌‌। নিয়ত ছাড়া কোনো আমল মহান আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হয় না‌। কিন্তু এখানে কি মুখে নিয়ত করার কথা বলা হচ্ছে? বর্তমানে কেউ কেউ এমনই মনে করে‌। একারণে তারা নামায, রোজা, ওযু ইত্যাদি আমলের আগে নাওয়াতু আন পড়ে নিয়ত করে নেয়‌‌। কেউ কেউ বাংলাতেও নিয়ত করে থাকে তবে অনেকে মনে করে বাংলাতে নিয়ত করলে নামায শুদ্ধ হবে না বরং আরবীতেই নিয়ত করা লাগবে‌। যাই হোক আসল কথা কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো‌। উপরের হাদীসটিতে কখনও মুখে নিয়ত করার কথা বলা হয়নি‌। বরং হাদীসটিতে নিয়ত বলতে অন্তরের ইচ্ছাকে বোঝানো হয়েছে‌। আরবী অভিধান সমূহতে এসেছে, সে নিয়ত করেছে (نوي) এর অর্থ সে ইচ্ছা করেছে (قصد)‌। [লিসানুল আরব] অর্থাৎ অন্তরের ইচ্ছাই হলো নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা শর্ত নয়‌‌। যদি মুখে নিয়ত করা শর্ত হয় তাহলে হাদীসটির অর্থ হবে যে কোনো আমল করার পূর্বে মুখে নিয়ত করা লাগবে‌। যেমন যাকাত দেওয়ার সময় বলতে হবে,

نويت ان ازكي الف دينار للفقراء والمساكين فرضا لله تعالي

উচ্চারণঃ নাওয়াতু আন উঝাক্কিয়া আলফা দেনার লেল ফোকারা ওয়াল মাসাকেনে ফারদ্বাল লেল্লাহে তায়ালা‌।

অর্থঃ আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরজ দায়িত্ব হিসাবে এক হাজার দিনার ফকীর মিসকীনদের উদ্দেশ্যে যাকাত হিসাবে প্রদান করার নিয়ত করছি‌।

যারা সব কাজের আগে মুখে নিয়ত করা জরুরী মনে করেন তাদের জন্য আমরা যাকাতের নিয়তটি আরবী অর্থ ও বাংলা উচ্চারণসহ লিখে দিলাম‌‌। আশা করি তারা অর্থসহ মুখস্থ করে নেবেন‌‌। তবে যারা এক হাজার দিনারের বেশি বা কম টাকা যাকাত দেবেন তারা আলফা দেনার বা এক হাজার দেনার এর স্থানে নিজেদের টাকার সঠিক পরিমানটা উল্লেখ করবেন‌‌। আমাদের দেশের বইগুলোতে নামায-রোজা ও ওযু-তায়ম্মুমের নিয়ত পাওয়া যায় কিন্তু যাকাত, যিকির, কোরান তেলাওয়াত, মিসওয়াক করা ইত্যাদির নিয়ত পাওয়া যায় না‌। যদি নিয়ত বলতে মুখের নিয়তই বোঝায় তাহলে সব আমলের জন্যই মুখে নিয়ত করতে হবে‌। আমি এখন যিকির করার নিয়ত করছি, আমি এখন মিসওয়াক করার নিয়ত করছি এভাবে প্রতিটি আমলের আগেই নিয়ত করতে হবে‌। উপরের যে হাদীসে নিয়তের কথা বলা হয়েছে সেখানে হিজরতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সুতরাং হিজরতের সময় বলতে হবে,

نويت ان اهاجر من مكة متوجها الي جهة المدينة المنورة راكبا الناقة

উচ্চারণঃ নাওয়াতু আন উহাজিরা মিন মাক্কাতা মুতাওজ্জিহান ইলা জিহাতিল মাদীনাতি আল মুনাওয়ারাতি রাকিবান আন-নাকাতি

অর্থঃ আমি উটের পিঠে চড়ে মক্কা থেকে মদীনার দিকে মুখ করে হিজরতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিচ্ছি ….

কিন্তু হিজরতের সময় রসুলুল্লাহ (সঃ) বা সাহাবারা এভাবে মুখে নিয়ত করে মক্কা থেকে মদীনার দিকে রওয়ানা হয়েছিলেন কি? আমাদের দেশের আমপারার বই গুলোতে এইসব নিয়ত লেখা হয় না কেনো? শুধু নামায-রোজা আর ওযু তায়াম্মুমের নিয়ত শেখালে হবে? নামায-রোজা আর ওযু-তায়াম্মুম ছাড়া কি আর কোনো আমল নেই? হজ্জ, যাকাত, যিকির, কোরান তেলাওয়াত এসবের নিয়ত কে শেখাবে? আসল কথা হলো এসব কোনো নিয়তই শেখা লাগবে না কারণ মুখে নিয়ত করা জরুরী নয় বরং অন্তরে ইচ্ছা করাই যথেষ্ট‌‌। যদি মুখে নিয়ত করা শর্ত হতো তাহলে সব আমলের নিয়ত আলাদা আলাদা ভাবে শিখতে শিখতে মাথা খারাপ হয়ে যেতো‌। আল্লাহ আমাদের এই ধরণের কঠিন গুরুদায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছেন একারণে আমরা তার দরবারে শুকরিয়া জানায়‌‌। তাছাড়া কথা হলো বেশিরভাগ লোক তো ওযুর নিয়তই জানে না‌। মুখে নিয়ত ছাড়া যদি ওযু নাই হয় তবে যারা ওযুর নিয়ত জানে না তাদের ওযুই তো শুদ্ধ হয়না নামায কিভাবে শুদ্ধ হবে!! এসব আসলে সঠিক কথা নয়‌‌।

নিয়তের মধ্যে ভুল

আমি আগেই বলেছি আমাদের দেশে যেসব নিয়তের বই পাওয়া যায় সেখানে সব আমলের নিয়ত পাওয়া যায় না‌। কেবল নামায-রোজা, ওযু-তায়াম্মুম ইত্যাদির নিয়ত পাওয়া যায়‌‌। সমস্যা হলো সেসব বইতে যেসব নিয়ত পাওয়া যায় তাও পুরোপুরি সঠিক নয়‌‌। যেমন ধরুন ওযুর নিয়তে আমরা বলি,

نويت ان اتوضأ رفعا للحدث واستباحة للصلاة تقربا الي الله تعالي

উচ্চারণঃ নাওয়াতু আন আতাওয়াদ্দায়া রাফআল লিলহাদাছি ওয়াস তিবাহাতাল লিসসালাতি তাকার্‌রুবান ইলাল্লাহি তায়ালা‌।

অর্থঃ আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অপবিত্র অবস্থা থেকে পবিত্র হওয়ার জন্য এবং সলাত আদায়ের যোগ্য হওয়ার জন্য ওযু করার নিয়ত করছি‌।

এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়‌‌।

একঃ ওযুর নিয়তে বলা হয়েছে রফআল লিলহাদাসি (رفعا للحدث) যার অর্থ অপবিত্র অবস্থা থেকে পবিত্র হওয়ার জন্য‌‌। ওযু কিন্তু সব সময় অপবিত্র অবস্থায় করা হয় না‌। যেমন ধরুন আপনি ওযু করে মাগরিবের নামায পড়লেন‌‌। যখন এশার ওয়াক্ত হাজির হলো তখনও আপনার ওযু ভাঙেনি এখন আপনি ইচ্ছা করলে ওযু করতেও পারেন নাও পারেন যদি এই অবস্থায় আপনি ওযু করেন তাহলে কী নিয়ত করবেন? যদি উপরের নিয়তটি করেন তাহলে তার অর্থ হবে আপনি বললেন আমি অপবিত্র অবস্থা থেকে পবিত্র হওয়ার জন্য ওযু করছি কিন্তু আসলে তো আপনি এখন অপবিত্র নন কারণ আপনার ওযু টিকে রয়েছে অর্থাৎ আপনি নিয়তের মধ্যে মিথ্যা বললেন‌‌।

দুইঃ ওযুর নিয়তের মধ্যে উল্লেখ আছে ইস্তিবাহাতাল লিস সলাতি (استباحة للصلاة) যার অর্থ নামায আদায় করার যোগ্য হওয়ার উদ্দেশ্যে‌। কিন্তু সব সময় আমরা নামায আদায় করার জন্য ওযু করি না‌। অনেক সময় যারা কোরান পড়া শেখেন তারা কোরান স্পর্ষ করার জন্য ওযু করেন‌‌। তখন তারা যদি এই নিয়ত করে তাহলে তো মিথ্যা বলা হবে‌।

এখন আমরা নামাযের নিয়তের ব্যাপারে লক্ষ করি‌। আমরা বিভিন্ন নামাযের বিভিন্ন রকম নিয়ত করে থাকি‌। কোন নামায, কত রাকাত নামায, ইমামের পিছনে দাড়িয়ে আদায় করা হচ্ছে নাকি বাড়িতে আদায় করা হচ্ছে ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করে লম্বা লম্বা নিয়ত করা হয়‌‌। আপনি নিয়তের সময় বলছেন আমি জোহারের চার রাকাত নামায আদায় করছি, বা ফজরে নামায দুই রাকাত আদায় করছি ইত্যাদি‌। এবিষয়ে আমাদের কথা হলো যে আল্লাহ নামায ফরজ করেছেন তিনি কি জানেন না জোহরের নামায কয় রাকাত বা ফজরের নামায কয় রাকাত? যদি এসব বিষয় উল্লেখ করে নিয়ত করা জরুরী হয় তাহলে যিনি নামায পড়ছেন তার নিজের নাম, বাবার নাম, এলাকার নাম ইত্যাদি উল্লেখ করাও তো জরুরী হবে‌। তাকে বলতে হবে,

انا فلان ابن فلان من المنطقة الفلانية في المسجد الفلاني نويت ان اصلي ………

আনা ফুলান ইবনে ফুলান মিনাল মিনতাকাতি আল-ফুলানিয়্যাতি ফিল মাসজিদিল ফুলানি নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া ….

আমি অমুকের ছেলে অমুক অমুক এলাকার অমুক মসজিদ এ দাড়িয়ে নামায পড়ার নিয়ত করছি …..

কারণ যে আল্লাহ নামায ফরজ করেছেন তাকে যদি নামায কয় রাকাত তা বলে দিতে হয় তাহলে যে নামায পড়ছে তার বাপ-দাদার নামও তো বলে দেওয়া দরকার‌‌।

এছাড়া ওযুর নিয়তের মতো নামাযের নিয়তেও কিছু সমস্য রয়েছে যেমন নামাযের নিয়তের মধ্যে বলা হয়,

متوجها الي جهة الكعبة الشريفة الله اكبر

উচ্চারনঃ মুতাওজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা্থবাতিশ শারিফাতি আল্লাহু আকবার,

এর অর্থ আমি কিবলা মুখি হয়ে সলাত আদায়ের নিয়ত করছি‌। এখন যে ব্যক্তি বাস-ট্রেন, প্লেন বা জাহাজের উপর দাড়িযে সলাত আদায় করে তার ক্ষেত্রে বিধান হলো নামায শুরু করার সময় কিবলামুখী হয়ে শুরু করবে পরে উক্ত যানবাহন যেদিকেই মুখ করুক তাতে তার নামাযের কোনো সমস্যা হবে না‌। তাহলে এই ব্যক্তির জন্য আমি কা্থবার দিকে মুখ করে নামায পড়ার নিয়ত করছি এমন কথা বলা সম্পূর্ণ সঠিক নয় বরং তাকে বলতে হবে,

متوجها الي جهة السفينة الله اكبر

উচ্চারণঃ মুতাওজ্জিহান ইলা জিহাতিস-সাফিনাতি আল্লাহু আকবার‌‌।

অর্থঃ আমি জাহাজ যেদিকে ঘোরে সেদিক মুখ করে নামায আদায়ের নিয়ত করছি আল্লাহু আকবার‌‌।

আরো স্পষ্ট করে বললে সে এভাবে বলতে পারে,

متوجها الي جهة الكعبة الشريفة بدأ ثم الامر الي السفينة

অর্থঃ প্রথমে তো কিবলা মুখী হয়ে শুরু করলাম তার পরের ব্যাপার জাহাজের হাতে ছেড়ে দিলাম‌‌।

এখানে যদি কেউ ট্রেনে চড়ে ভ্রমন করে তাহলে সাফীনা (سفينة) না বলে কিতার (قطار) বলবে, বাসে চড়ে ভ্রমণ করলে হাফিলা (حافلة) বলবে, প্লেন হলে তায়িরা (طائرة) বলবে এক কথায় নিয়ত করার আগে তাকে আরবী ভাষায় অনার্স করতে হবে‌।

যে ব্যাক্তি কোনো ইমামের মুক্তাদী হয়ে সলাত আদায় করেন তিনি নিয়তে বলেন,

اقتديت بهذا الامام

উচ্চারণঃ ইক্তাদাইতু বিহাযাল ইমাম‌‌।

অর্থঃ আমি এই ইমামের অনুসরণ করলাম‌‌।

বাংলাতে বললে এখানে বলা হয় আমি এই ইমামের পিছনে দাড়িয়ে জোহরের চার রাকাত ফরজ নামায আদায় করার নিয়ত করছি‌। মজার ব্যাপার হলো দো্থ তোলা বা তিন তোলা মসজিদ গুলোতে কিন্তু মুক্তাদী ইমামের পিছনে থাকে না বরং ঠিক তার মাথার উপরে থাকে‌। সুতরাং বলা উচিত‌‌। আমি এই ইমামের মাথার উপর দাড়িয়ে জোহরের চার রাকাত ফরজ নামায আদায় করার নিয়ত করছি‌।

রোজার নিয়ত সম্পর্কে কিছু কথা বলেই শেষ করার ইচ্ছা রাখি‌। রোজার নিয়তের মধ্যে বলা হয়,

نويت ان اصوم غدا من شهر رممضان المبارك ……

উচ্চারনঃ নাওয়াতু আন আসুমা গাদাম মিন শাহরি রামাদানাল মুবারকি …..

অর্থঃ আমি এই রমজান মাসের আগমী কাল রোজা রাখার নিয়ত করছি‌।

এখন যে ব্যক্তি সাহ্‌রীর সময় নিয়ত করতে ভুলে যায় এবং সকাল হওয়ার পর মনে পড়ে তবে সে তখনই নিয়ত করবে এটাই বিধান‌‌। কিন্তু তখন যদি সে এই নিয়ত করে তবে তার অর্থ হবে আমি আগামী কাল রোজা রাখার নিয়ত করছি অথচ সে নিয়ত করছে আজকের জন্য‌‌। ঘটনাক্রমে যদি ঐ দিনটি রমজানের 30 তম দিন হয় এবং এই ব্যাক্তি নিয়তের মধ্যে তু্তুগাদাম মিন শাহরি রামাদানাল মোবারকে্থ্থ বলে তবে এর অর্থ হবে আমি আগামী কাল রোজা রাখার নিয়ত করছি অথচ আগামী কাল ঈদের দিন‌‌। এক্ষেত্রে তাকে বলতে হবে,

نويت أن اصوم اليوم من شهر رمضان المبارك ……..

উচ্চারণঃ নাওয়াইতু আন আছুমাল ইয়াওমা মিন শাহরি রামাদান আল মোবারকে …

অর্থঃ আমি রমজান মাসের আজকের দ্বিনে রোজা রাখার নিয়ত করছি ……

উপসংহারঃ উপরোক্ত আলোচনার মূল বিষয় হলো নিয়ত অর্থ অন্তরের ইচ্ছা এখানে মুখে উচ্চারণের কোনো ভূমিকা নেই‌‌। আল্লাহর রসুল (সঃ) বা তার সাহাবাদের কারো থেকে এই ধরণের নাওয়াইতু আন জাতীয় কিছু প্রমানিত হয় নি‌। তারা অন্তরের নিয়তকেই যথেষ্ট মনে করতেন মুখে উচ্চারন প্রয়োজনীয় মনে করতেন না‌।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *