ইসলামে জাতীয়তাবাদ এর বিধান – বর্তমান সময়ে কুফরী মতবাদ সমূহ – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর

ইসলামে জাতীয়তাবাদ এর বিধান – বর্তমান সময়ে কুফরী মতবাদ সমূহ – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনীর এর তাওহীদ আর রহমান গ্রন্থ হতে নেয়া হয়েছে

জাতিগত পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারনত ভাষা, এলাকা বা বংশপরিচয়ের ভিত্তিতে জাতীয়তা গড়ে ওঠে। তবে ধর্ম তথা বিশ্বাস বা মতবাদের উপর ভিত্তি করেও জাতি গড়ে উঠতে পারে। এই সকল বিষয়ের  কোন একটিকে কেন্দ্র করে জাতীয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়। নিজের ধর্ম, এলাকা, ভাষা, বংশ ইত্যাদি বিষয়সমূহের মধ্যে যার নিকট যেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় সে তার উপর ভিত্তি করে জাতীয়তা গড়ে তোলে। এই সকল বিষয়ের মধ্যে যে কোনো একটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে এবং বাকিগুলোকে উপেক্ষা করে বা গৌণ সাব্যস্ত করে জাতীয়তার সৃষ্টি হয়। যদি এলাকার উপর ভিত্তি করে জাতীয়তা প্রতিষ্ঠিত হয় তবে উক্ত এলাকায় বসবাসকারী বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা ও বংশের লোকেরা নিজেদের এক জাতি হিসেবে মনে করবে এবং উক্ত এলাকার বাইরে সকল মানুষকে তারা বিজাতী মনে করবে যদিও তাদের ধর্ম, ভাষা বা বংশের মিল থাকে। যেমন বাংলাদেশী এমন কিছু উপজাতি রয়েছে যাদের ভাষা বাংলা নয় তবু বাংলাদেশে বসবাস করার কারণে তারা বাংলাদেশী হিসেবে গণ্য হয় এবং এদেশের যাবতীয় নাগরিক সুবিধাদি পেয়ে থাকে। একইভাবে যারা ভাষার উপর ভিত্তি করে জাতীয়তা প্রতিষ্ঠিত করে তারা একই ভাষার সকলকে এক জাতিভূক্ত মনে করে যদিও তারা দুটি পৃথক দেশে বসবাস করে। যেমন, কেউ কেউ ভাষার মিল থাকার কারণে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের বাঙ্গালিদের একই জাতিভূক্ত মনে করে যদিও উভয়ের ধর্ম, বর্ণ, দেশ ইত্যাদি আলাদা।

বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষ দেশ তথা এলাকাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। প্রায় সকল রাষ্টে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই প্রকারের জাতীয়তাই স্বীকৃত। একারণে বর্তমানে জাতীয়তাবোধ আর দেশত্ববোধ প্রায় একই বিষয়ে পরিনত হয়েছে। দেশের ভালবাসা ও প্রশংসায় এত বেশি অতিরঞ্জন করা হয় যে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় দেশ নিজেই এখন প্রতিমায় পরিনত হয়েছে। দেশত্ববোধের উপর প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদের কারণে দ্বিমুখী বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে আল্লাহর দ্বীন ইসলামকে উপেক্ষা করে কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে বসবাস করার কারণে হিন্দু, খৃষ্টান, নাস্তিক ইত্যাদি সকল ধর্ম ও মতবাদের লোকদের এক জাতি হিসেবে বিবেচনা করা এবং তাদের পরস্পরের ভাই-ভাই হিসেবে গণ্য করার মাধ্যমে ইসলামকে ছোট করা হয়েছে। বিপরীত দিকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী মুসলিমদের নিজ নিজ দেশের জাতীয়তাবোধের বন্ধনে বেধে ফেলার মাধ্যমে বৃহৎ মুসলিম উম্মাহকে শতদাবিভক্ত করে ফেলা হয়েছে। এমনকি মুসলিম উম্মার একটি অংশ আরেকটি অংশের ভিনদেশী হিসেবে গণ্য করার কারণে একে অপরকে শোষন ও নিপিড়ন করছে ক্ষেত্রবিশেষে পরষ্পরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে।

এখানে লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, নিজের দেশ ও জাতির প্রতি অন্তরের টান ও সহজাত ভালবাসা থাকা সম্পপূর্ণ স্বাভাবিক। ইসলাম এটা নিষিদ্ধ করে না। তবে ইসলাম একজন মুসলিমের উপর এটা আবশ্যক করে যে, নিজের দ্বীন ও ঈমানকে নিজের বংশ, ভাষা, দেশ ইত্যাদির চেয়ে বেশি মূল্যবান মনে করতে হবে। রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, “একজন ব্যক্তি মুমিন হবে না যতক্ষণ না আমি তার নিকট বেশি প্রিয় হবো তার পিতা, সন্তান ও সমস্ত মানুষ হতে।” (সহীহ্ বুখারী ও মুসলিম) সূরা তাওবার ২৪ নং আয়াতে পিতা, ভ্রাতা, স্বগোত্র, ঘর-বাড়ি, ব্যাবসা-বানিজ্য আল্লাহ্, রাসুল ও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার তুলনায় বেশি প্রিয় মনে করার ব্যাপারে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করা হয়েছে।

একজন মুমিনদের দায়িত্ব হলো জীবন, বংশ-গোত্র, দেশ, ভাষা ইত্যাদি যে কোনো পরিচয়ের তুলনায় আল্লাহর দ্বীনকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া। নিজের দেশ ও জাতির প্রতি স্বাভাবিক ভালবাসা থাকা দোষের কিছু নয় তবে বিষয়টিকে দ্বীন ও ঈমানের তুলনায় বেশি রুগুত্ব দেওয়া যাবে না। বরং দ্বীন-ঈমানকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনে নিজের স্বগোত্রে ও স্বদেশ ছেড়ে হিজরত করতে হবে এটিই ইসলামের নির্দেশ। রাসুলুল্লাহ সাঃ ও তার সাহাবায়ে কিরাম দ্বীন রক্ষার্থে মক্কা হতে মদীনাতে হিজরত করেছিলেন। তারাও নিজেদের আত্মীয়-স্বজন ও বাসস্থানকে ভালবাসতেন। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ কেউ মদীনাতে যাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। সহীহ্ বুখারীতে আয়েশা রাঃ হতে বর্ণিত আছে তার পিতা আবু বকর রাঃ এবং বিলাল রাঃ মক্কা থেকে মদিনাতে হিজরত করে আসার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ অবস্থায় তারা দুজনেই কবিতার মাধ্যমে নিজ এলাকা ও আত্মীয়-স্বজনদের পরিত্যাগ করার কষ্ট বর্ণনা করতেন। নিজের বাসস্থান ও জ্ঞাতি-গোষ্ঠির প্রতি ভালবাসা তাদেরও ছিল কিন্তু তারা আল্লাহর দ্বীনকে অধিক ভালবাসতেন একারণে দ্বীনের প্রয়োজনে নিজের দেশ বা স্বজাতিকে পরিত্যাগ করতে এক মুহুর্ত দ্বিধা করেন নি। তারা কখনই ঈমান-ইসলামের পরিচয় ভিন্ন অন্য কোন পরিচয়কে গুরুত্ব দেন নি। এমনকি তারা যখন নিজের বংশ-গোত্র ইত্যাদি পরিচয় নিয়ে গর্ব অহংকার করতেন ঈমান ও নেক আমলের দিক থেকেই তা করতেন দুনিয়াবী মাল-সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তির দিক হতে নয়। তিবরানী শরীফের একটি হাদীসে এসেছে, আওস ও খাজরাজ দুই গোত্রের সাহাবায়ে কিরাম নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপের সময় নিজ-নিজ গোত্রের আমলদার ও নেককার লোকদের নিয়ে গর্ব করতেন। আবু বকর রাঃ উহুদ যুদ্ধে দেখেন, একজন ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাঃ এর পাশে অবস্থান করে কাফিরদের সাথে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে রাসুলুল্লাহ সাঃ এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। এটা দেখে তিনি বলেন,

আমি যখন এ মহৎ কাজ করতেই পারিনি তখন এটা যেনো তালহা হয়। আমার গোত্রের কেউ একাজ করুক এটিই আমার নিকট অধিক প্রিয়। (মুসনাদে তয়ালিসী)

মোট কথা, গোত্রপ্রীতি ও জাতীয়তাবোধ সাহাবায়ে কিরামের মধ্যেও ছিল কিন্তু তারা এটাকে আল্লাহর দ্বীনের পক্ষে ব্যবহার করতেন বিপক্ষে নয়। স্বগোত্রের প্রতি ভালবাসা বলতে তারা বুঝতেন নিজের গোত্রের লোকেরা আল্লাহর দ্বীনের জন্য ভাল কিছু করুক এটা কামনা করা, আল্লাহর দ্বীনকে উপেক্ষা করে নিজের গোত্রগত পরিচয়কেই প্রধান মনে করা নয়। কিন্তু বর্তমানে গোত্রপ্রীতি ও জাতীয়তাবোধ বলতে বোঝায়, ঈমান-আক্বীদা ও ধর্ম-কর্মকে উপেক্ষা করে ভাষা বা এলাকাভিত্তিক জাতীয়তা প্রতিষ্ঠিত করা এবং ধর্ম-কর্মের উর্দ্ধে নিজের জাতিগত পরিচয়কে প্রধান পরিচয় হিসেবে বিবেচনা করা। বৈধ বা অবৈধ যে কোন পন্থায় স্বজাতি ও স্বদেশের পক্ষে অবস্থান করা। জাহেলী যুগে একটি স্লোগাণ ছিল, “তোমার ভাই (স্বগোত্রের লোক) জালিম হলেও তাকে সাহায্য করো” বর্তমান সময়ে প্রচলিত জাতীয়তাবাদ এই জাহেলী চিন্তাধারাই প্রচার করে। এই জাতীয়বাদের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। উপরোক্ত আলোচনার সারমর্ম হলো, স্বজাতি ও স্বদেশের প্রতি সহজাত টান থাকা নিতান্ত স্বাভাবিক একটি বিষয়। ইসলাম এই সহজাত ও স্বাভাবিক ভালবাসাকে স্বীকৃতি দেয় যদি না সেটা ইসলামের বিপরীতে ব্যাবহার করা হয়। যারা বৈধ পন্থায় স্বদেশপ্রীতি প্রকাশ করে তাদের তিরষ্কার করা হবে না। কিন্তু যারা স্বদেশ প্রেমের কারণে অবৈধ কাজে লিপ্ত হয় তারা অপরাধী হবে আর যদি কেউ স্বজাতি ও স্বদেশকে আল্লাহর দ্বীনের উপরে স্থান দেয় তবে সেটা হবে সুস্পষ্ট কুফরী। বর্তমানে জাতীয়তাবাদ ধর্মের উপর জাতীয়তাবোধকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে তাই সাধারনভাবে এটাকে কুফরী মতবাদ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তবে এর অর্থ এই নয় যে, জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী যে কেউ কাফির হবে। বরং দেখতে হবে তার বিশ্বাস কুফরীর পর্যায়ে পৌছায় কিনা।

ইসলামে জাতীয়তাবাদ এর বিধান ইসলামে জাতীয়তাবাদ এর বিধান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *