আল্লাহর হাত পা চোখ ইত্যাদির ব্যাপারে আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনির

আল্লাহর হাত পা চোখ ইত্যাদির ব্যাপারে আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা

আল্লাহর হাত পা চোখ ইত্যাদির ব্যাপারে আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনির এর প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।

পবিত্র কুরআনের বেশ কিছু আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নিজের ব্যাপারে হাত, চোখ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

হে ইবলিস তুমি তাকে কেনো সাজদা করলে না যাকে আমি নিজে দুহাত দ্বারা সৃষ্টি করেছি? (সুরা সদ-৭৫)

তার (আল্লাহর) দুই হাত প্রশস্থ তিনি যা ইচ্ছা দান করেন। (সুরা মায়েদা-৬৪)

মুসা আঃ এর উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন, “আমি চেয়েছিলাম তুমি আমার চোখের সামনে বেড়ে ওঠো” (সুরা তহা- ৩৯)

একটি আয়াতে এসেছে, সেদিন পায়ের গোছা উম্মোচন করা হবে আর তাদের সাজদার দিকে ডাকা হবে কিন্তু তারা তা করতে সক্ষম হবে না। (সুরা কলাম-৪২)

এ আয়াতে কার পায়ের গোছা উম্মোচন করা হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু নেই। মুফাসসিরীনে কিরাম বলেছেন, পায়ের গোছা উম্মোচন করা বলতে এখানে কিয়ামতের ময়দানে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। আরবী ভাষায় শব্দটি এ অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বর্তমানে অনেকে দাবী করেন, এখানে আল্লাহ তায়ালা তার নিজের পায়ের গোছা উম্মোচন করবেন (নাইযু বিল্লাহ্)। অথচ এ আয়াতে সে সিষয়ে স্পষ্ট কিছু নেই তবে সহীহ্ বুখারী ও মুসলিমে বির্ণত একটি হাদীসে এসেছে রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, “আল্লাহ তায়ালা জাহান্নামের উপর তার পা রাখবেন” এই হাদীস এবং উপরে আমরা হাত, চোখ ইত্যাদি সম্পর্কে যা কিছু উল্লেখ করেছি যেসব অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সাথে পরিচিত তা উদ্দেশ্য নয়। আল্লাহ তায়ালা এর জন্য এই প্রকার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থাকা অসম্ভব যেহেতু এটা সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য আর তিনি সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য ধারন করা হতে পবিত্র।

আল্লাহ তায়ালা এর ডান হাত সম্পর্কে বর্ণিত একটি হাদীস প্রসংগে ইবনে বাত্তাল বলেন,

এখানে আল্লাহ তায়ালা এর ডান হাত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। এটা আল্লাহর একটি সত্ত্বাগত অঙ্গ নয় সেমনটি মুজাসসিমারা মনে করে থাকে। কেননা আল্লাহ তায়ালা এর কোনো অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বা বিভিন্ন অংশ ও খন্ড থাকা সঙ্গত নয়। তার কোনো দেহ থাকবে এটিও সঙ্গত নয়। (শারহে বুখারী)

অন্য এক স্থানে তিনি এ বিষয়টির বর্ণনা দিয়ে বলেন,

কেননা এ বিষয়ে দলিল-প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালাকে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিশিষ্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে না। যেমনটি মুজাসসিমারা বলে থাকে, আল্লাহর দেহ রয়েছে যা অন্যদের দেহের মতো নয়। (ইবনে বাত্তাল)

বদরুদ্দিন আইনী রঃ উমদাতুল কারীতে হুবহু একই কথা বলেছেন।

জাহান্নামের উপর পা রাখা সম্পর্কিত হাদীসটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইমাম নাব্বী রঃ বলেন,

এই হাদীসটির প্রকাশ্য অর্থ গ্রহণ করা হবে না বরং অবশ্যই এটিকে ব্যাখ্যা করতে হবে কেননা স্বাভাবিক বুদ্ধির মাধ্যমেই এটা অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, আল্লাহ তায়ালা এর কোনো অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থাকতে পারে না। (শারহে মুসলিম)

ইবনে হাযার আসক্বলানী রঃ বলেন,

আহলুসসুন্নাহ ওয়াল-জামায়া এ বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, এখানে হাত বলতে অঙ্গ বোঝানো হচ্ছে না যা সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য। (ফাতহুল বারী)

অন্য স্থানে তিনি বলেন, “আল্লাহর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে এমন বলা হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই” (ফাতহুল বারী)

মোট কথা, ঐ সকল আয়াত ও হাদীসে হাত, চোখ, পা ইত্যাদি শব্দগুলো কোনক্রমেই শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বোঝায় না এ ব্যাপারে আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামায়ার সকল ওলামায়ে কিরাম ঐক্যমত পোষণ করেছেন। এখন যেহেতু আমরা হাত-পা বলতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই বুঝে থাকি কিন্তু তা এই সকল আয়াতে উদ্দেশ্য নয় অতএব, আয়াতের অর্থ আমাদের নিকট স্পষ্ট নয়। একারণে এই সকল আয়াতকে মুতাশাবিহাত আয়াত বলা হয় অর্থাৎ যার উদ্দেশ্য বোধগম্য নয়।

একটি হাদীসে কিছু নেককার লোক সম্পর্কে বলা হয়েছে,

তারা আল্লাহর ডান হাতের দিকে থাকবে আর তার দুটি হাতই ডান হাত। (সহীহ্ মুসলিম)

ইমাম নাব্বী রঃ এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন,

রসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, আল্লাহর দুটি হাতই ডান হাত এর মাধ্যমে বোঝা যায় আসলে এখানে ডান হাত বলতে অঙ্গ বোঝানো হয় নি। আল্লাহ তায়ালা এ থেকে উর্দ্ধে কেননা এটা (অঙ্গ-পত্যঙ্গ থাকা) আল্লাহর জন্য অসম্ভব। (শারহে মুসলিম)

এই সকল অস্পষ্ট আয়াত সম্পর্কে মন্তব্য করার ব্যাপারে বরেন্য ওলামায়ে কিরামের কর্মপন্থা সম্পর্কে ইমাম নাব্বী রঃ বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন,

জেনে নাও, সিফাত সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীসের ব্যাপারে ওলামায়ে কিরামের দুটি পন্থা রয়েছে। প্রথম পন্থাটি হলো, বেশিরভাগ বরং সকল সালাফদের পথ আর তা হলো আমরা এসব আয়াত ও হাদীস কম্পর্কে কোনো মন্তব্য করবো না তারা বলেন, আমাদের উপর কেবল এতটুকু দায়িত্ব যে আমরা এগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপণ করবো এবং নিশ্চিতভাবে মনে করবো যে, এগুলোর এমন কোনো অর্থ আছে যা আল্লাহর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয় (কিন্তু সে অর্থটি কি তা আমরা নির্ধারণ করার ছেষ্টা করবো না)। সেই সাথে দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নন এবং তিনি দেহ ধারণ করা, স্থান গ্রহণ করা, স্থানন্তরিত হওয়া, কোনো একটি নির্দিষ্ট দিকে অবস্থান করা ইত্যাদি সকল প্রকার সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হতে পবিত্র। মুতাকাল্লিমীন (কালাম শাস্ত্রবিদ) ওলামায়ে কিরামের একটি অংশ এই মতই পোষণ করেন। তাদের মধ্যকার মুহাক্কিকগণ এই মতটিই গ্রহণ করেছেন। এই মতটিই অধিক নিরাপদ।

এ বিষয়ে দ্বিতীয় পন্থাটি হলো বেশিরভাগ মুতাকাল্লিমীনদের মতো। তারা বলেন, এই সকল আয়াতকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হবে যা সঙ্গতিপূর্ণ হয়। তবে এই সকল আয়াতের ব্যাখ্যা করা কেবল তার জন্য বৈধ হবে যে ব্যাখ্যা করার যোগ্যতা রাখে। জ্ঞান চর্চার ব্যাপারে তার ব্যাপক অনুশীলন থাকতে হবে। (শারহে মুসলিম)

অন্যস্থানে তিনি এ সম্পর্কে বলেন,

পূর্বে গত হয়েছে যে, এ বিষয়ে আলেমরা মতপার্থক্য করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন আমরা সেগুলোর উপর ঈমান রাখবো কিন্তু এসবের কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করবো না। এগুলোর অর্থ কি আমরা তা জানি না। তবে আমরা এতটুকু বলবো যে, এগুলোর এমন একটি অর্থ রয়েছে যা আল্লাহর মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু আমরা নিশ্চিত বিশ্বাস করি যে, এসব আয়াত ও হাদীসের প্রকাশ্য অর্থে যা বোঝা যায় তা এগুলোর উদ্দেশ্য নয়। এই মতটিই জমহুর সালাফদের মত এবং একদল মতাকাল্লিমীনদের মত। দ্বিতীয় মতটি হলো, আমরা এসব আয়াতের এমন ব্যাখ্যা করবো যা আল্লাহর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। বেশিরভাগ কালামশাস্ত্রবিদের মত এটাই। (শারহে মুসলিম)

ইমাম নব্বীর এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে বেশ কিছু বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। যেমন,

ক) আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের সকল ওলামায়ে কিরাম এ বিষয়ে একমত যে, যেসব আয়াত ও হাদীসে আল্লাহর ব্যাপারে, হাত-পা চোখ ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে সেগুলোর প্রকাশ্য অর্থ উদ্দেশ্য নয় এবং তার অর্থ আসলে কি সেটাও স্পষ্ট নয়। এ ধরণের আয়াতকেই বলা হয় মুতাশাবিহাত আয়াত।

খ) মুতাশাবিহাত আয়াতের ব্যাখ্যা করা হবে কি হবে না সে বিষয়ে দুটি মত রয়েছে। একদল আলেম মনে করেন মুতাশাবিহাত আয়াত কেবল তিলওয়াত করতে হবে এবং সেগুলোর উপর ঈমান রাখতে হবে। সেসবের ব্যাখ্যা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা যাবে না। এটিই বেশিরভাগ ওলামায়ে কিরামের মত। অন্য একদল ওলামায়ে কিরাম মনে করেন, অন্যান্য আয়াতের সাথে সঙ্গতি রেখে মুতাশাবিহাত আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা যায়। এই মতপার্থক্যের মূল ভিত্তি হলো, আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াত।

আল্লাহ বলেন,

তিনি আপনার উপর এ কিতাব নাযিল করেছেন। এ কিতাবের কিছু আয়াত সুস্পষ্ট। সেগুলোই কিতাবের মূল বিষয়। আর অন্য কিছু আয়াত আছে অস্পষ্ট। যাদের অন্তরে বক্রতা আছে তারা ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্য ঐসকল আয়াতের বিকৃত ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করে। সেগুলোর ব্যাখ্যা আল্লাহ্ ছাড়া কেউ জানেনা আর জ্ঞানী লোকেরা বলে আমরা তো এসবের উপর ঈমান রাখি। সেসবই আমাদের রবের পক্ষ থেকে। কেবলমাত্র বোধসম্পন্ন লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে। (আলে ইমরান-৭)

এই আয়াত প্রমান করে আল্লাহর কিতাবে এমন কিছু আয়াতও রয়েছে যার অর্থ অস্পষ্ট হওয়ার কারণে সেগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হওয়া মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ কাজ। বিদয়াতী ও বদ মতলবের অধিকারীরাই এসব আয়াত নিয়ে বেশি ঘাটা-ঘাটি করে। একারণে পূর্ববর্তী ওলামায়ে কিরামের একটি বিরাট অংশ এই সকল আয়াত সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতেন না এবং এগুলোর ব্যাপারে প্রশ্ন করাও পছন্দ করতেন না। ইমাম মালিককে “আরশে আসীন” হওয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে ঈমান রাখা ওয়াজিব কিন্তু এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা বিদয়াত” (ফাতহুল বারী) পরবর্তীতে ওলামায়ে কিরাম ইমাম মালিকের এই কথাটি এ বিষয়ে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তারা এই সকল আয়াতের ব্যাপারে প্রশ্ন করতে অনুৎসাহিত করতেন এবং যত্র-তত্র আলোচনা করা অপছন্দ করতেন। উমর রাঃ থেকে বর্ণিত আছে একজন ব্যক্তি এধরণের প্রশ্ন করলে তিনি তাকে শাস্তি প্রদান করেন। সুফেইয়ান ইবনে উয়াইনা রাঃ থেকে বাইহাকী সহীহ সনদে বর্ণনা করেন তিনি সিফাত সম্পর্কিত আয়াত সম্পর্কে বলেছেন, “এসব আয়াতের ব্যাখ্যা হলো তেলাওয়াত করে চুপ থাকা” (ফতহুল বারী) ওয়ালিদ ইবনে মুসরিম বলেন, আমি আওজাঈ, মালিক ও লাইছকে এইসব আয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তারা বলেন, “কোনো মন্তব্য না করেই এগুলো অতিক্রম করে চলে যাও” (ফাতহুল বারী; ইবনে রজব)। আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের ওলামায়ে কিরাম হতে এধরণের সতর্কতা অবলম্বনের বর্ণনা প্রচুর পরিমাণ রয়েছে যা এখানে সবিস্তারে উল্লেখ করা সম্ভব নয়।

এখানে লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, ঐ সকল ওলামায়ে কিরাম আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে অত্যাধিক জানা এবং দ্বীনের গভীর বুঝ সম্পর্কে সর্বাধিক অবহিত হওয়া সত্ত্বেও এই সকল আয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করা বা এগুলো নিয়ে আলোচনা করার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। অথচ বর্তমানে কিছু নির্বোধ লোক অন্য কিছু নির্বোধ লোককে সাথে নিয়ে এসব আয়াত সম্পর্কে যাচ্ছেতাই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উল্লেখ করে চলেছে। সাধারন মুসলিমদের এর শিক্ষা দিচ্ছে; আল্লাহর হাত আছে, পা আছে, সুন্দর চেহারা আছে, তারা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো এই সব আয়াতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ উল্লেখ করে এবং যে কেউ তাদের ব্যাখ্যা অনুসরণ করে না বরং ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা করে বা এসব আয়াতের ব্যাপারে নিরাবতা অবলম্বন করে তারা তাকে ভীষণভাবে তিরস্কার করে। এদের দৃষ্টিতে আল্লাহর হাত আছে? পা আছে? এসব প্রশ্ন করার ব্যাপারে নিজে ভীত হওয়া বা অন্যকে ভয় প্রদর্শন করার জরুরত নেই। একইভাবে তারা মনে করে, আল্লাহর হাত-পা, চোখ ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে তবে সেগুলো অন্যান্য সৃষ্টির মতো নয় এই বিশ্বাস যে রাখেনা সে মূলত এসম্পর্কিত আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে। যে এসব বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতেই রাজী হয় না তাকেও এরা বিদয়াতীদের পর্যায়ে ফেলে। অথচ আমরা দেখেছি এসব আয়াতের ব্যাপারে নিরাবতা অবলম্বন করাই বেশিরভাগ সালফে সালেহীনদের পথ। তারা এ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। তারা এসব বিষয়ে প্রশ্ন-উত্তর করার ব্যাপারটিই পূরোপূরি অপছন্দ করেছেন। তারা বলেছেন আয়াতগুলো তেলাওয়াত করতে হবে এবং নিরবতা অবলম্বন করতে হবে। যদি এসব আয়াতের কোনো একটি অর্থ নির্ধারন করা ওয়াজিব হতো তবে তারা অবশ্যই নিরাবতা অবলম্বন করতেন না।

গ) ইমাম নাব্বীর কথার মাধ্যমে এটাও প্রমাণিত হয় যে, যদিও বেশিরভাগ ওলামায়ে কিরামের মত হলো আল্লাহ তায়ালা এর সিফাত সংক্রান্ত আয়াত ও হাদীসের কোনোরুপ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বর্ণনা না করা বরং চুপ থাকা তবে কালাম শাস্ত্রবিদ আলেমদের বেশিরভাগ অংশ এবং অন্যান্য ওলামায়ে কিরামের কিছু অংশ এ বিষয়ে সঙ্গতিপূর্ণ ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। উপরে উল্লেখিত সূরা আলে ইমরানের আয়াতটির শেষের অংশে বলা হয়েছে,

সেগুলোর ব্যাখ্যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না আর জ্ঞানী লোকেরা বলে আমরা তো এসবের উপর ঈমান রাখি। এসবই আমাদের রবের পক্ষ থেকে। (সুরা আলে ইমরান-৭)

আয়াতটির এই অংশের ব্যাখ্যায় দুটি মত বর্ণিত আছে, একমতে “এর অর্থ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না” এটুকু পূর্ণাঙ্গ বাক্য হবে এবং জ্ঞানী ব্যক্তিরা বলে আমরা ঈমান রাখি এটি নতুন একটি বাক্য বলে গণ্য হবে। অন্য মতে বাক্যটি হবে এমন, আল্লাহ ছাড়া কেউ এর অর্থ জানে না এবং জ্ঞানী ব্যক্তিরা। অর্থাৎ জ্ঞানী ব্যক্তিরাও অন্যান্য আয়াতের উপর চিন্তাগবেষণা করে মুতাশবিহাত আয়াতের অর্থ সম্পর্কে ধারনা করতে পারেন। প্রথম মত অনুযায়ী ঐ সকল আয়াতের ব্যাপারে কোনোরুপ মন্তব্য করা অনুচিত কিন্তু দ্বিতীয় মতের উপর নির্ভর করলে যোগ্যতা সম্পন্ন ওলামায়ে কিরাম ঐ সকল আয়াতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারেন। উক্ত আয়াতটির ব্যাখ্যার ব্যাপারে এরুপ দ্বিমত সৃষ্টি হওয়ার কারণে এখানে দুটি কর্মপন্থা অবলম্বনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কেউ ইচ্ছা করলে এসব আয়াতের ব্যাপারে কোনোরুপ মন্তব্য না করে চুপ থাকতে পারে। এটিই জমহুর সালফে সালেহীনদের অনুসৃত নীতি এবং এটিই অধিক নিরাপদ যেমনটি ইমাম নাব্বী রঃ বলেছেন। আবার যোগ্যতা সম্পন্ন ওলামায়ে দ্বীন অন্য আয়াতের উপর চিন্তা গবেষণা করে এই সকল আয়াতের সঙ্গত অর্থ বর্ণনা করার চেষ্টা করলে তা বিদয়াত ও অপছন্দনীয় হবে না। তবে খুব সতর্ক থাকতে হবে যেন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আল্লাহকে কোনোভাবেই সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যে বিশেশায়িত না করা হয়। একারণে ইমাম নাব্বী রঃ সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এতটুকু নিশ্চিত বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ তায়ালা দেহধারন, নির্দিষ্ট দিকে বা নির্দিষ্ট অবস্থান গ্রহণ এবং এক স্থান থেকে আরেক স্থানে স্থানান্তর ইত্যাদি সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য হতে পবিত্র। অন্যস্থানে তিনি এও বলেছেন যে, আল্লাহর শানে হাত-পা, চোখ ইত্যাদি বিষয়কে কোনোভাবেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মনে করা যাবে না। এরুপ করলে তা মুজাসসিমাদের আক্বীদা বলে গণ্য হবে। এখানে আরো একটি শর্ত স্মরণ রাখতে হবে। আল্লাহ্ তায়ালা এর বৈশিষ্ট্য বর্ণনার ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন এবং অকাট্যভাবে প্রমাণিত হাদীসে যতটুকু বর্ণিত হয়েছে তার বাইরে এক পাও অগ্রসর হওয়া যাবে না। কুরআনে হাত, চোখ ইত্যাদি শব্দ এসেছে বিধায় হাতের সাথে নোখ বা চোখের সাথে চোখের পাতা ও চোখের মনি ইত্যাদি বিষয়ের অবতারণা করা যাবে না।

বদরুদ্দিন আল-আইনি রঃ বলেন, ইমাম খাত্তাবী রঃ বলেন, হাতের আঙ্গুল বা এই জাতীয় বিষয়ে কথা হলো আল্লাহর ব্যাপারে এমন কোনো শব্দ প্রয়োগ করা যাবে না যা কুরআন ও অকাট্যাভাবে প্রমাণিত হাদীসে নেই। এভাবে প্রমাণিত নয় এমন কোনো বিষয় আল্লাহর উপর প্রয়োগ করা হতে বিরত হওয়া ওয়াজিব। (উমদাতুল কারী)

কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর ব্যাপারে কিয়াসের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয় প্রমাণের চেষ্টা করে। যেমন আল্লাহ শোনেন অতএব তার কান আছে আল্লাহকে কিয়ামতের দিন দেখা যাবে অতএব তার আকার-আকৃতি রয়েছে ইত্যাদি। এই সকল লোকেরাই প্রকৃত মুজাসসিমা। যেহেতু তারা সৃষ্টির সাথে তুলনা করে আল্লাহর বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের চেষ্টা করে। অথচ আল্লাহ বলেন, “কোনো কিছুই তার মতো নয়”। যাকে দেখা যায় তার কোনো আকৃতি থাকতে হবে বা যে শোনে তার কান থাকতে হবে এটা সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। (এমনকি অনেক সৃষ্টিও কান ছাড়া শুনে থাকে, সুতরাং, আল্লাহ শোনেন অতএব, তার কান থাকতে হবে বা আল্লাহকে দেখা যায় অতএব তার আকৃতি রয়েছে এ যুক্তি পূরোপুরি অগ্রহণযোগ্য)। আল্লাহ তায়াল এসব নিয়ম-কানুনের উর্দ্ধে। তিনি নিয়ম সৃষ্টি করেন কিন্তু তিনি নিয়মের অধীন নন। অতএব, এই ধরণের কিয়াস ও কল্পণার মাধ্যমে যারা আল্লাহর প্রতি কোনো বৈশিষ্ট্য আরোপ করে স্পষ্ট জেনে নিতে হবে যে, তারাই মুজাসসিমাদের উত্তরাধিকার।

তবে উপরে বর্ণিত শর্তাবলী লংঘন না করে এবং পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের বিপরীতে না যেয়ে ঐ সকল আয়াতের যে কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করা নিষিদ্ধ নয়। মুফাসসিরীনে কিরাম বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যায় এবং হাদীসের ব্যাখ্যাকাররা সিফাত সম্পর্কিত বিভিন্ন হাদীস প্রসঙ্গে এধরনের ব্যাখ্যা বর্ণনা করেছেন। ঐ সকল ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকে দুটি ধারায় বিভক্ত করা যায়।

১। আল্লাহর চোখ আছে এর অর্থ আল্লাহর এমন একটি গুণ বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার উপর আল্লাহ নিজেই চোখ শব্দ প্রয়োগ করেছেন যদিও সেটা কোনো অঙ্গ নয় এবং মানুষ চোখ বলতে যা কিছু বোঝে সেটা তেমন নয়। একই কথা হাত-পা বা অন্য যে কোন শব্দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যা কুরআন ও হাদীসে আল্লাহর শানে এসেছে।

২। যেসব আয়াতে আল্লাহর শানে চোখ, হাত ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে সেখানে আসলে ভিন্ন অর্থে তা ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন আল্লাহর বাণী “আমি তাকে দুহাতে সৃষ্টি করেছি” এবং মুসা আঃ এর উদ্দেশ্যে আল্লাহর বাণী “যেন তুমি আমার চোখের সামনে বেড়ে ওঠো” এর অর্থ আমার তত্ত্বাবধায়নে তুমি বেড়ে ওঠো ইত্যাদি। বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে এবং হাদীসের শরাহতে এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উল্লেখ করা হয়েছে।

“আল্লাহর দুই হাত উম্মুক্ত রয়েছে” {সুরা মায়োদা-৬৪} এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী রঃ হাত শব্দের বিভিন্ন অর্থের বর্ণনা দিয়েছেন। অঙ্গ অর্থে হাত শব্দের ব্যবহার থেকে শুরু করে, নিয়ামত বা অনুগ্রহ অর্থে কুদরত ও কুওয়া তথা ক্ষমতা প্রদর্শন অর্থে ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থে বর্ণনা দিয়েছেন। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা এর বিশেষ একটি সিফাত যা অঙ্গ নয় আবার প্রকৃত অর্থে হাতও নয় এমন বোঝাতেও হাত শব্দটি ব্যবহৃত হয় বলে উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে ঐ আয়াতটি উল্লেখ করেছেন যেখানে আদম আঃ কে আল্লাহ নিজ হাতে সৃষ্টি করার কথা বলেছেন। (সুরা সদ-৭৫)

পরবর্তীতে এই আয়াতের ব্যাখ্যায়ও তিনি বিভিন্ন মতামত বর্ণনা করেছেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন রকম সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, আদম আঃ এর সম্মান প্রমাণ করার জন্যই তাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করার কথা বলা হয়েছে, সেভাবে সালিহ্ আঃ এর উষ্ট্রীকে আল্লাহর উষ্ট্রী বলা হয়েছে এবং মসজিদকে বিশেষত কা’বা শরীফকে বায়তুল্লাহ্ বা আল্লাহর ঘর এবং ঈসা আঃ কে রুহুল্লাহ্ বা আল্লাহর রুহ্ বলা হয়েছে।

এরপর তিনি বলেন, এমনও বলা হয়ে থাকে যে, এই আয়াতে কুদরত অর্থে হাত শব্দ আসেনি বরং এখানে দুহাত বলতে আল্লাহর স্বত্ত্বাগত দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে যার মাধ্যমে তিনি আদম আঃ কে সৃষ্টি করেছেন।

তিনি আরো বলেন,

এমনও বলা হয়ে থাকে যে, এখানে আসলে ক্ষমতা তথা কুদরত উদ্দেশ্য।  এমন বলা হয়, “এ বিষয়ে আমার হাত নেই” (অর্থাৎ আমার কিছু করার ক্ষমতা নেই), “এতো ভারি জিনিস বহন করার মতো দুটি হাত আমার নেই” (এখানেও ক্ষমতা নেই এটিই উদ্দেশ্য)। এই মতটির স্বপক্ষে প্রমাণ হলো, কুদরত বা ক্ষমতা ছাড়া সৃষ্টি করা সম্ভব নয় এ ব্যাপারে ইজমা সম্পাদিত হয়েছে।

এরপর তিনি একটি কবিতা উল্লেখ করেন যেখানে ক্ষমতা অর্থে দু’হাত প্রয়োগ করা হয়েছে।

আদম আঃ কে দুই হাত দ্বারা সৃষ্টি করা সম্পর্কে ইবনে হাযার আসক্বালানী রঃ বিভিন্ন মত উল্লেখ করেছেন। প্রথমেই তিনি ইবনে বাত্তাল রঃ থেকে দুটি হাত বলতে দুটি সিফাত বোঝানোর মতটি উল্লেখ করে বলেন,

এ ধরণের কথা উপমা হিসেবে বলা হয়ে থাকে যাতে কোনো বিষয় সহজে বোধগম্য হয়। যে ব্যক্তি কোনো বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এবং সে বিষয়ে যত্নবান হয় সে সেটা স্বহস্তে করে (তাই স্বহস্তে করা বলতে যত্নসহকারে করা বোঝানো হয়েছে)। এ ব্যাখ্যার মাধ্যমে এটা বোঝা যায় যে, আদম আঃ কে যতটা গুরুত্ব সহকারে সৃষ্টি করা হয়েছে অন্যদের সেভাবে করা হয়নি।

এরপর তিনি (ইবনে হাযার) বলেছেন হাত শব্দটির বহু অর্থ রয়েছে তার মধ্যে আমি ২৫ টি অর্থ অবগত হতে সক্ষম হয়েছি। পরে তিনি উক্ত ২৫ টি অর্থ বর্ণনা করেছেন। যার প্রতিটির স্বপক্ষে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে বায়াতে রিদওয়ান সম্পর্কে অবতীর্ণ আল্লাহ তায়ালা এর বাণী, “আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর” এ সম্পর্কে বলেন, এর অর্থ হলো আহদ বা চুক্তি। (ফাতহুল বারী)

রসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, সকল মানুষের অন্তর আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মধ্যে রয়েছে একটি অন্তরের মতোই। আল্লাহ যেভাবে খুশি সেগুলো পরিবর্তন করে থাকেন। (সহীহ্ মুসলিম)

ইমাম নাব্বী রঃ এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন,

এই হাদীসটি সিফাতের হাদীসসমূহের মধ্যে গণ্য। পূর্বেই বলেছি এ বিষয়ে আলেমদের দুটি মত রয়েছে। একদল আলেম বলেন, এগুলোর উপর ঈমান আনয়ন করতে হবে কোনভাবেই এগুলোর ব্যাখ্যা করা হবে না এবং তার অর্থ নির্ধারণের চেষ্টার করা হবে না। শুধু এতটুকু বিশ্বাস রাখতে হবে যে, এগুলো সত্য ও সঠিক এবং বাহ্যিকভাবে এ থেকে যা কিছু বোধগম্য হচ্ছে তা উদ্দেশ্য নয়। যেহেতু আল্লাহ্ বলেছেন, কোনো কিছুই তার মতো নয়। দ্বিতীয় মতটি হলো, এসব বর্ণনাকে সঙ্গতিপূর্ণ ব্যাখ্যা প্রদান করা হবে। এই মত অনুযায়ী বলা হবে, এখানে রুপক অর্থে আঙ্গুলের কথা বলা হয়েছে। যেমন বলা হয় অমুক আমার মুঠোর মধ্যে বা সে আমার হাতের তালুতে, এর মাধ্যমে এটা বোঝানো হয়না যে সে আসলেই তার হাতের মুঠোর মধ্যে বা হাতের তালুতে রয়েছে। বরং এর উদ্দেশ্য হলো, সে আমার ক্ষমতার অধীন রয়েছে। একইভাবে বলা হয়, অমুক আমার দুই আঙ্গুলের মাঝে রয়েছে আমি তাকে যেভাবে খুশি পরিচালনা করি। অর্থাৎ সে আমার অনুগত আমি তাকে যেভাবে খুশি পরিচালিত করি। অতএব হাদীসটির অর্থ হবে, আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের অন্তরসমূহ যেভাবে ইচ্ছা পরিচালিত করি। অতএব হাদীসটির অর্থ হবে, আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের অন্তরসমূহ যেভাবে ইচ্ছা পরিচালিত করে থাকেন। কোনো কিছুই তার আয়ত্বের বাইরে নয়। তিনি যা ইচ্ছা করেন তার বাইরে কেউ যেতে পারে না যেভাবে একজন মানুষের দুই আঙ্গুলের মাঝে যা থাকে তা তার আয়ত্বের অধীন থাকে। এখানে আরবরা যেভাবে বোঝে সেভাবে তাদের বোঝানো হয়েছে। (প্রকৃতই আঙ্গুলের কথা বলা হয়নি)

এরপর তিনি বলেন,

যদি কেউ বলে, আল্লাহর ক্ষমতা তো একক তাহলে এখানে দুই আঙ্গুলের কথা বলা হচ্ছে কেন? তবে বলা হবে, পূর্বেই বলেছি এখানে রুপক অর্থ উদ্দেশ্য তাই উপমা হিসেবে মানুষ যেভাবে চিন্তা করে সেভাবে বলা হয়েছে। দ্বিবচণ বা বহুবচন ইত্যাদি কোনো কিছুই এখানে উদ্দেশ্য নয়। (শারহে মুসলিম)

অন্য একটি স্থানে আঙ্গুল সম্পর্কিত বর্ণনার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, এমনও বলা হয় যে এখানে আঙ্গুল বলতে আল্লাহর কোনো সৃষ্টির আঙ্গুল বোঝানো হয়েছে। একটিও অসম্ভব নয়। মোট কথা এর মাধ্যমে অঙ্গ বোঝা যাবে না। (শারহে মুসলিম)

অজ্ঞ লোকেরা বলতে পারে কোনো একজন সৃষ্টির আঙ্গুলকে কিভাবে আল্লাহ নিজের আঙ্গুল বলতে পারেন। এর উত্তর হলো, উক্ত সৃষ্টির বিশেষত্ব বোঝানোর জন্য এমন বলা সম্ভব যেভাবে অন্য হাদীসে এসেছে, আল্লাহ্ বলবেন, আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম তুমি আমাকে খাবার দাওনি, আমি অসুস্থ ছিলাম তুমি আমাকে সেবা করো নি ইত্যাদি। এখানে বান্দার ক্ষুধাকে আল্লাহ নিজের ক্ষুধা এবং বান্দার অসুস্থতাকে আল্লাহ্ নিজের অসুস্থতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যদিও ক্ষুধা ও অসুস্থতা হতে তিনি পবিত্র। (সহীহ্ মুসলিম)

আমরা পূর্বে আল্লাহ তায়ালা এর শানে হাত-পা, চোখ ইত্যাদি  শব্দ ব্যবহৃত হওয়া সম্পর্কে দুই প্রকার ব্যাখ্যার কথা বলেছি। এক. আল্লাহ তায়ালা এর এমন কিছু গুন ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে তিনি যার নামকরণ করেছেন হাত বা চোখ যদিও সেগুলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নয়। দুই. এগুলোর মাধ্যমে আসলে কোনো গুন বা বৈশিষ্ট উদ্দেশ্য নয় বরং ক্ষমতা, তত্ত্বাবধায়ন ইত্যাদি অর্থে এগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। উভয় প্রকার ব্যাখ্যাই বরেণ্য ওলামায়ে কিরামের মতামতের মাধ্যমে প্রমানিত। দ্বিতীয় প্রকারটি সম্পর্কে ওলামায়ে কিরামের বিস্তারিত মতামত বর্ণনা করলাম কারণ বর্তমানে কিছু লোক প্রথম ব্যাখ্যাটি গ্রহণ করে আর দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি বিদয়াত হিসেবে আখ্যায়িত করে। তারা দাবী করে সালফে সালেহীনরা প্রথম ব্যাখ্যাটির পক্ষে ছিলেন। অথচ আমরা স্পষ্ট বর্ণনা করেছি যে, সালফে সারেহীনরা যে কোনো প্রকার ব্যাখ্যা করার বিপক্ষে ছিলেন। তারা সিফাত সম্পর্কিত আয়াতগুলি তেলাওয়াতের পর পুরোপুরি নিরব থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা এটাও বলেছি যে, এসব ব্যাপারে নিরব থাকার মতটিই অধিক নিরাপদ তবে সঙ্গত ব্যাখ্যা করার সুযোগও আছে। ফলে তা বিদয়াত হবে না। আর যদি বিদয়াত হয়ই তবে উভয়প্রকার ব্যাখ্যাই বিদয়াত হবে কারণ উভয় স্থানে আয়াতের প্রকৃত অর্থকে পরিত্যাগ করে রুপর অর্থে আশ্রয় নিয়ে ব্যাখ্যা প্রদান করা হচ্ছে। যে বলে হাত অর্থ ক্ষমতা, চোখ অর্থ তত্ত্বাবধায়ন ইত্যাদি যে সেমন প্রকৃত হাত ও প্রকৃত চোখ বোঝাচ্ছে না একইভাবে যে বলে চোখ বা হাত বলতে এমন কিছু বোঝানো হচ্ছে যা কোনো অঙ্গ নয় এবং চোখ বা হাত বলতে আমরা যা বুঝি তা নয় সেও চোখ ও হাতের প্রকৃত ও বাধেগম্য অর্থ গ্রহণ করেনি কারণ চোখ বলতে আমরা যা বুঝি সেটিই চোখ শব্দের প্রকৃত অর্থ একই ভাবে হাত বলতে আমরা যা বুঝি সেটিই হাত শব্দের প্রকৃত অর্থ। যে চোখ বা হাত বলতে এই বোধগম্য অর্থের বাইরে ভিন্ন কোনো জিনিসকে বোঝে সে চোখ ও হাতের প্রকৃত অর্থ পরিত্যাগ করে এবং রুপক অর্থ গ্রহণ করে। মূলত সে চোখ বলতে এমন কিছু বোঝায় যা আসলে চোখ নয়। সুতরাং উভয় ব্যাখ্যাতেই এসব শব্দের রুপক অর্থ প্রহণ করা হয়েছে প্রকৃত অর্থ নয়। অতএব যদি ব্যাখ্যা করতেই হয় তবে একদল আরেকদলকে তিরস্কার করা নিরর্থক বরং একে অপরকে সমগোত্রীয় জেনে সদ্ভাব বজায় রাখাই শ্রেয়। সেই সাথে যারা কোনোরুপ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ উল্লেখ করে না বরং নিরবতা অবলম্বন করে তাদের পন্থাকে সর্বোত্তম হিসেবে স্বীকৃতিও দেওয়া উচিৎ যেহেতু এই মতটিই জমহুর সালফে সালেহীনদের মত। এবং এটিই বেশি নিরাপদ কারণ এতে ভ্রান্তিতে পতিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু যারা ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের পন্থা প্রহণ করে তাদের  ক্ষেত্রে যে কোনো মুহুর্তে মারাত্নক ভ্রান্তির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উভয়প্রকার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এমন ভ্রান্তি ঘটতে পারে।

জাহান্নামের উপর আল্লাহ নিজের পা রাখবেন এ সম্পর্কিত হাদীসটির ব্যাখ্যায় যারা মনে করে পা বলতে এখানে আল্লাহর সিফাত সমূহের মধ্যে একটি সিফাত বোঝানো হয়েছে তাদের তিরস্কার করে আব্দুর রহমান ইবনুল জাওজী রঃ বলেন,

আল্লাহর হাত পা চোখ
আল্লাহর হাত পা চোখ

পূর্ববর্তী সালফে সারেহীনরা এই সকল বিষয় শোনা মাত্র নিরাবতা অবলম্বন করতেন। এগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হতেন না। সেই সাথে তারা এ বিশ্বাস রাখতেন যে, কোনোভাবে পরিবর্তিত বা স্থানান্তরিত হতে পারে না। যে কেউ আল্লাহর ব্যাপারে এমন সব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হতে বিরত থকে যাতে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে হয় এবং আল্লাহর সাথে ঐরুপ যা কিছু সম্পর্কিত করা হয়েছে সে সেগুলোর কোনোরুপ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে না বরং নিরব থাকে সে সালফে সালেহীনদের পথ অনুসরণ করে। আর যে নিজেকে সালাফদের অনুসারী বলে দাবী করে কিন্তু মনে করে এই হাদীসে পা বলতে আল্লাহ তায়ালা এর স্বত্ত্বাগত সিফাত (বৈশিষ্ট্য) বোঝানো হয়েছে এবং এমন দাবী করে যে আল্লাহ জাহান্নামে এটা রাখবেন সে এটা বুঝতেই সক্ষম হয় নি যে, আল্লাহর ব্যাপারে কেমন কথা বলা উচিৎ আর কেমন কথা তার ব্যাপারে অসম্ভব। সে না সালফে সালেহীনদের নিরব থাকার নীতি অবলম্বন করেছে আর না সে (সঙ্গতিপূর্ণ) ব্যাখ্যার পথ অবলম্বন করেছে। তার এই তৃতীয় বিদয়াতপন্থী মতবাদটি কত নিকৃষ্ট! যারা বিদয়াতের বিরোধীতা করে তারাই এই বিদয়াত তৈরী করেছে। আবুল ওফা ইবনে আক্বীল বলেন আল্লাহ এ থেকে পবিত্র যে, তার একটি সিফাত থাকবে যা কোনো স্থানে অবস্থান করবে। এটিই তো পৃকৃত মুজাসসিমাদের আক্বীদা। তাছাড়া আল্লাহ তায়ালা কি এতটাই অক্ষম হয়ে গেলেন যে, জাহান্নামকে আদেশ দান করার মাধ্যমে নিরব করতে পারবেন না এমন কি নিজের স্বত্ত্বাগত একটি সিফাত (বৈশিষ্ট্য) ব্যবহার কতে (জাহান্নামের ভিরতে রাখতে) বাধ্য হলেন! (কাশফুল মুশকিল)

সালফে সালেহীনদের অনুসরণ করার দাবীদার কিছু লোকের পক্ষ থেকে এধরনের ভ্রান্তী বেশ কিছু ব্যাপারে ঘটেছে। এর মধ্যে সর্বাধিক ভয়াবহ হলো, আল্লাহর সুরত বা আকার-আকৃতি আছে এবং তিনি আকাশে অবস্থান করেন বলে দাবী করা । পরবর্তী পোষ্টে আমরা এ দুটি বিষয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা সুবিস্তারে বর্ণনা করবো ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহর হাত পা চোখ ইত্যাদির ব্যাপারে আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনির এর প্রবন্ধটি আপনার বন্ধুদের কাছে শেয়ার করুন।

আপনি আল্লাহর হাত পা চোখ সম্পর্কে কি আক্বীদা রাখতেন এবং এখন আল্লাহর হাত পা চোখ সম্পর্কে কি আক্বীদা তা কমেন্টে জানাবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *