আল্লাহর গুনাবলীকে অস্বীকারীর বিধান – শায়েখ আব্দুল্লাহ আল মুনির

আল্লাহর গুনাবলীকে অস্বীকারের বিধান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সুন্দরতম গুনাবলীকে অস্বীকার করা

আল্লাহর গুনাবলীকে অস্বীকারের বিধান শায়েখ আব্দল্লাহ আল মুনির এর প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ্ নেই। সুন্দরতম নামসমূহ তারই জন্য। (সুরা তহা-৮)

আপনি বলুন, আল্লাহ নামে ডাকো বা রহমান নামে ডাকো। (তাতে একজন স্বত্ত্বাকেই ডাকা হয়) কেননা তার রয়েছে সুন্দরতম নামসমূহ। (ইসরা-১১০)

রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, আল্লাহর রয়েছে, নিরানব্বইটি নাম। একশত অপেক্ষা একটি কম। যে কেউ সেগুলো মুখস্ত করে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (সহীহ্ বুখারী)

এই হাদীসে আল্লাহ তায়ালা এর গুনাবলী সম্বলীত নিরানব্বইটি নামের কথা বলা হয়েছে এবং সেগুলো মুখস্ত করার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। আল্লাহর এমন কিছু নামও রয়েছে যা কোনো সৃষ্টিকে জানানো হয় নি। অন্য একটি হাদীসে এসেছে, রসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,

হে আল্লাহ্ আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি এমন প্রতিটি নামের মাধ্যমে যা আপনি নিজের জন্য নির্ধারন করেছেন এবং কোনো কিতাবে তা নাযিল করেছেন বা কোনো একজন সৃষ্টিকে সেটা শিক্ষা দিয়েছেন অথবা ইলমে গায়েবে সেটা সংরক্ষিত রেখেছেন (কাউকে শিক্ষা দেন নি){ইবনে হিব্বান}। হাইছামী রঃ বলেন, “এই হাদীসটি ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল ও আবি ইয়ালা রঃ যে সনদে বর্ণনা করেছেন তার রাবীরা সহীহ্ শুধু আবু সালামা ছাড়া তবে ইবনে হিব্বান তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন।” (মাজমায়ে যাওয়ায়েদ)

মোট কথা, আল্লাহ তায়ালা এর বহু সংখ্যক সুন্দরতম নাম রয়েছে। প্রতিটি নাম কোনো না কোনো গুনাবলী হতে উৎসারিত এবং কোনো না কোনো ক্ষমতা ও কাজের প্রমাণ বহন করে। আর-রহমান অর্থ পরম দয়ালু। এ নামটি আল্লাহ তায়ালা এর অপার ও অসীম দয়ার প্রমাণ বহন করে সেই সাথে তিনি যে বান্দাদের উপর দয়া করে থাকেন সেটা প্রমাণ করে। আর-রাজ্জাক অর্থ রিযিক দাতা। আল্লাহ তায়ালা যে প্রতিটি সৃষ্টির সমস্ত প্রয়োজন পূরণ করে থাকেন এই নামটি সে কথাই বর্ণনা করে। এভাবে প্রতিটি নাম আল্লাহ তায়ালা এর কোনো না কোনো কাজ বা গুনাবলীর প্রতি ইঙ্গিত করে। এভাবে সুন্দরতম নামসমূহের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন,

কোনো কিছু তার মতো নয়। (সুরা শুরা-১১)

অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা এর গুনাবলী ও বৈশিষ্ট্যসমূহ সৃষ্টির গুনাবলী ও বৈশিষ্টের মতো নয়। সৃষ্টির কারো সাথে তার কোনো সাদৃশ্য নেই এবং তিনি সৃষ্টির কারো সাথে সাদৃশ্য রাখেন না। মানুষ যে দয়া প্রদর্শন করে সেটা কোনোভাবেই আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক প্রদর্শিত দয়ার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। কেননা মানুষের অন্তরে যে দয়া সেটা আল্লাহর সৃষ্টি আর আল্লাহ তায়ালা এর নিকট যে দয়া রয়েছে সেটা সৃষ্টি নয় বরং তার অনাদি-অনন্ত কালের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ যেমন অনাদি-অনন্ত কাল থেকে বিরাজমান তেমনি অনাদি-অনন্ত কাল থেকে তার মধ্যে দয়া নামক সিফাতটি বিরাজমান। একথা প্রতিটি গুণ-বৈশিষ্ট্য ও ক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মানুষের যে ক্ষমতা রয়েছে তা আল্লাহর সৃষ্টি কিন্তু আল্লাহ যে ক্ষমতা প্রদর্শন করেন সেগুলো সৃষ্ট নয় রবং সেগুলো তার অনাদি-অনন্ত কালের বৈশিষ্ট্য।

মোট কথা, আল্লাহ তায়ালা এর এমন কিছু গুনাবলী ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা তার পরিপূর্ণতা ও পবিত্রতার ঘোষণা দেয় তবে সেসব গুনাবলী কোনোভাবেই অন্যান্য সৃষ্টির গুনাবলী ও বৈশিষ্ট্যের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। এই বিষয়টি একটি চূড়ান্ত মূলনীতি। যারা এই মূলনীতিটি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে তারা আল্লাহ তায়ালা এর গুনাবলী ও বৈশিষ্ট্যসমূহের ব্যাপারে বিভিন্নরকম বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে। এই বিভ্রান্তি থেকে দুটি বিদয়াতী ফিরকার উদ্ভব ঘটেছে।

(১) সিফাত সম্পর্কে মু’তাজিলা ও জাহামিয়্যাদের ভ্রান্তি

একদল লোক মনে করে সৃষ্টির যেসব গুনাবলী রয়েছে, যেমন দয়া করা, ভালবাসা, ঘৃণা করা, রাগ করা ইত্যাদি, আল্লাহ সেসব গুনাবলী থেকে পবিত্র। কারণ তিনি সৃষ্টির মতো নন। তারা আল্লাহ তায়ালা এর দয়া, ভালবাসা, রাগ, ঘৃণা ইত্যাদি গুন ও বৈশিষ্ট্য আছে বলেই মনে করে না। জাহামিয়্যা ও মু’তাজিলা সম্প্রদায়ের এমন আক্বীদা ছিল। ইমাম বুখারী তার সহীহহাতে এই সকল বিদয়াতপন্থীদের বিরুদ্ধে পৃথক একটি অধ্যায় রচনা করেছেন। তিনি উক্ত অধ্যায়ের নামকরণ করেছেন কিতাবুত-তাওহীদ। সেখানে তিনি আল্লাহ তায়ালা এর বিভিন্ন গুনাবলি ও বৈশিষ্ট্যের পক্ষে বিভিন্ন প্রমানাদি পেশ করেছেন। পবিত্র কুরআনের বহু সংখ্যক আয়াত ও রাসুলে কারীমের বহু সংখ্যক হাদীসে আল্লাহ তায়ালার বিভিন্ন গুনাবলীর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে যেমনটি আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। আল্লাহ তায়ালা দয়ালু, তিনি মুমিনদের ভালবাসেন, কাফিরদের ঘৃণা করেন, তিনি রাগান্বিত হন ইত্যাদি বিষয়ে প্রচুর দলিল প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এর এইসব গুনাবলীকে অস্বীকার করা কুফরী যেহেতু সেগুলো দলিল প্রমাণের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। তবে জাহামিয়া ও মু’তাজিলা সম্প্রদায়কে কাফির বলা হয়নি কারণ তারা এসব বিষয়ে বিভিন্নরকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উল্লেখ করতো যার মাধ্যমে সরাসরি আয়াতকে অস্বীকার করা হয় না। যেমন তারা বলতো, “আল্লাহ জ্ঞানী তবে তার কোনো জ্ঞান নেই”, আল্লাহ দয়ালু তবে তার অর্থ এই নয় যে, তার মধ্যে দয়ার উদ্রেক হয়। তিনি অপরাধীকে ক্ষমা করেন, অসহায়কে সাহায্য করেন যেহেতু যার দয়া আছে সেই এগুলো করে থাকে সেকারণে বলা হয়েছে আল্লাহ্ দয়ালু। কিন্তু মানুষের মতো আল্লাহর স্বত্ত্বার মধ্যে দয়ার ভাব উদয় হয় এমন নয়। এভাবে তারা রাগ, ভালবাসা, ঘৃণা ইত্যাদি বিষয়কে আল্লাহর গুন হিসেবে স্বীকার করতো না বরং তার কাজ হিসেবে স্বীকার করতো। যেসব আয়াতে এসব গুনাবলীর কথা বলা হয়েছে তারা সেগুলো অস্বীকার করতো না বরং ভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করতো। কিন্তু তাদের ব্যাখ্যার ফলে মূলত আয়াতটির মূলভাব অস্বীকার করা হয় তাই ওলামায়ে কিরাম সর্বসম্মতিক্রমে তাদের বিদয়াতী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে যেহেতু তারা সরাসরি আয়াতটিকে অস্বীকার করতো না বরং এমনসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উল্লেখ করতো যে সম্পর্কে তাদের স্পষ্ট ধারণা ছিল না তাই তাদের কাফের বলা হয়নি।

ইমাম শাফেঈ রঃ বলেন,

আল্লাহ তায়ালা এর বেশ কিছু নাম ও গুনাবলী রয়েছে, কারো জন্য এটা বৈধ নয় যে, সে এগুলো অস্বীকার করে। যদি কেউ স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়ার পরও এগুলো অস্বীকার করে তাকে কাফির বলা হবে তবে স্পষ্টভাবে দলিল-প্রমাণ পাওয়ার পূর্বে কেউ এমন বললে অজ্ঞতার কারণে তাকে ছাড় দেওয়া হবে। (ফাতহুল বারী)

যারা তা’বিল বা ব্যাখ্যার মাধ্যমে কুরআনের কোনো আয়াতের ভিন্ন অর্থ করে তাদের তাকফির করার ব্যাপারে উলামায়ে কিরাম সর্বদা সতর্কতা অবলম্বন করতেন। এক্ষেত্রে সেটিই করা হয়েছে।

(২) সিফাত সম্পর্কে মুজাস্‌সিমাদের ভ্রান্তি।

জাহামিয়্যাদের বিপরীতে আরেকটি দল রয়েছে যারা আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির গুণাবলীতে বিশেষিত করে। তাদের বলা হয় মুজাস্‌সিমা বা মুশাব্‌বিহা। তারা মনে করে আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টির মতই। তার দেহ, হাত-পা ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও আকার-আকৃতি রয়েছে। তাদের মতবাদ আল্লাহর বাণী “কোনো কিছুই তার মতো নয়” এই আয়াতের সাথে সাংঘার্ষিক। একারণে ওলামায়ে কিরাম সর্বসম্মতিক্রমে তাদের বিদয়াতী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে বেশিরভাগ ওলামায়ে কিরাম তাদের কাফির বলেন নি কারণ তারা এক্ষেত্রে সরাসরি আয়াতটিকে অস্বীকার না করে বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের আশ্রয় নিয়ে থাকে। যেমন, তারা বলে, “আল্লাহর শরীর রয়েছে তবে তা অন্য সৃষ্টির শরীরের মতো নয়”। তাদের এই কথা বিদয়াত যেহেতু তারা আল্লাহর শরীর রয়েছে এমন দাবী করছে কিন্তু তাদের কাফির বলা হচ্ছে না কারণ তারা পরক্ষণেই বলছে, অন্যান্য শরীরের মতো নয়।

এইসকল ভ্রান্ত আক্বীদা জেনে নেওয়ার পর আমরা এ বিষয়ে সত্যপন্থী ওলামায়ে দ্বীন তথা আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের মতামত সম্পর্কে সুবিস্তারে আলোচনা করতে চাই এবং তার আলোকে বর্তমান যুগে বিরাজমান কিছু ভ্রান্তির মূলৎপাটন করতে চাই ইনশাল্লাহ।

আল্লাহ তায়ালার সিফাত সম্পর্কে আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা

আমরা পূর্বে বলেছি, সত্যপন্থী ওলামায়ে কিরাম আল্লাহ তায়ালা এর কোনো আয়াতকে অস্বীকার করেন না ফলে তারা একদিকে যেমন পবিত্র কুরআন ও সহীহ সুন্নাহতে বর্ণিত আল্লাহর গুনাবলী সমূহকে অস্বীকার করেন না বিপরীত দিকে ঐসকল গুনাবলীকে তারা সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে করেন না। সেই সাথে তারা আল্লাহ তায়ালার ব্যাপারে এমন কোনো সিফাত আরোপ করেন না যা তার মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয় না। সামগ্রিকভাবে সকল গুনাবলী ও বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে তারা এই মুলনীতি অনুসরণ করে থাকেন। এখানে কয়েকটি  বিষয়ের উপর পৃথকভাবে আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামাতের আক্বীদা বিশ্লেষণ করা হলো।

আল্লাহর গুনাবলীকে অস্বীকারের বিধান প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে আপনার বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করতে ভুলবেন না। এবং আল্লাহর গুনাবলীকে অস্বীকারের বিধান এর বাকি অংশ পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন।

পরবর্তি পোষ্ট: হাত, পা, চোখ ইত্যাদির ব্যাপারে আহলুস্‌সুন্নাহ্ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *